Image description

সুলতান মিয়া। একসময় শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন। এখন সিভিল সার্জন অফিসে তদবির করে বেড়ান। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে কালিয়াকৈরে কোথাও তার দেখা মেলেনি। কালিয়াকৈরে কোথাও মিছিল করেছেন এমন ছবিও নেই তার। অথচ জুলাইযোদ্ধা হিসেবে আহতের তালিকায় তার নাম উঠেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ভালো পা ব্যান্ডেজ করে আহত সেজেছিলেন সুলতান মিয়া। ব্যান্ডেজের আগমুহূর্তের ভালো পায়ের ছবি ও ব্যান্ডেজের পরের মুহূর্তের ছবিও রয়েছে মানবজমিনের হাতে। ব্যান্ডেজের ওপর কালো কালি লাগিয়েছেন আহত দেখানোর জন্য। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক এক নেতার কাছে এই প্রতারণার কথা স্বীকারও করেছেন তিনি। একইভাবে জুলাই আহতের তালিকায় নাম তুলেছেন আশিকুর রহমানও। তিনি পেশায় একজন রিকশাচালক। জুলাই আন্দোলনে অংশ নেননি। এমনকি কখনো আহতও হননি। অথচ তিনিও ভালো পা ব্যান্ডেজ করে জুলাইযোদ্ধা সেজেছেন। একটি সিন্ডিকেটকে পাঁচ হাজার টাকা উৎকোচ দিয়ে নাম তুলেছেন আহতের তালিকায়। তারও ব্যান্ডেজের আগমুহূর্তের ভালো পায়ের ছবি ও ব্যান্ডেজের পরের মুহূর্তের ছবিও রয়েছে মানবজমিনের হাতে। সেখানে দেখা গেছে, ব্যান্ডেজের ওপর পবিসেফ লিকুইড লাগিয়েছেন আহত দেখানোর জন্য। এদিকে, ফ্রান্স প্রবাসী বাবু তাহের। তার পিতার নাম আবু তাহের। জুলাই আন্দোলনের সময় বাবু তাহের ফ্রান্সে ছিলেন। সরকার পতনের দুই মাস পর অক্টোবরে তিনি দেশে ফিরেন।

তিনিও জুলাইযোদ্ধাদের আহতের তালিকায় নাম তুলেছেন। আন্দোলনের সময় বাবু তাহের ফ্রান্সে ছিলেন বলে স্বীকার করেছেন তার ভাগ্নে সাকিন। একইভাবে ভুয়া জুলাইযোদ্ধা সেজে তালিকায় নাম তুলেছেন কালিয়াকৈরের মো. সাইফুল্লাহ, সফিপুর এলাকার মো. ফরিদুল ইসলাম, মো. মোস্তফাসহ অন্তত ২৫ জন। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তালিকায় এসব ভুয়া নাম তোলার নেপথ্যে ছিলেন কালিয়াকৈরের ছাত্র প্রতিনিধি মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মোরসালিন ওরফে সাকিন, মো. আনিসুর রহমান হোসেন আলী, সাদিক হোসেনের সিন্ডিকেট। এমন অভিযোগ করেছেন কালিয়াকৈরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক নেতা রেদোয়ান রহমান আদনান। এদিকে, জুলাই আহতের তালিকায় এসব ভুয়া নাম অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদ জানিয়ে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার বরাবর একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে কালিয়াকৈরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে।

জানা গেছে, জুলাই আহতের তালিকা প্রথমে যাচাই করা হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কেউ জুলাই আন্দোলনে আহত হলে মেডিকেল সার্টিফিকেট নিয়ে সেখানে গিয়ে তার ভেরিফিকেশন করতে হয়। তাকে একজন ছাত্র প্রতিনিধি আহতের বিষয়টি শনাক্তের জন্য সুপারিশ করে দেন। এরপর উপজেলা নির্বাহী অফিসার তালিকা চূড়ান্ত করেন। কালিয়াকৈরে দুই ধাপের তালিকা গেজেট হয়েছে। প্রথম ধাপে ১৮৭ জন ও দ্বিতীয় ধাপে ৮৯ গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। তৃতীয় ধাপের তালিকাও যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত হয়ে গেছে। শেষ দুই ধাপে অন্তত ২৫ জন ভুয়া আহতের নাম ঢোকানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। 

কালিয়াকৈরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক নেতা রেদোয়ান রহমান আদনান মানবজমিনকে বলেন, আমাদের কাছে একটি সূত্রের মাধ্যমে তথ্য আসে- অর্থের বিনিময়ে জুলাই আহতের তালিকায় ভুয়া নাম অন্তর্ভুক্ত করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ছাত্র প্রতিনিধি সাকিনসহ একটি সিন্ডিকেট। পরে তাকে কৌশলে ডেকে এনে তালিকায় আমার একটি নাম ঢোকানোর অনুরোধ করি। তখন সাকিন বললো- সুলতানকে ৫০০০ টাকা দিলে প্রেসক্রিপশনসহ সব ব্যবস্থা করে দেবে। তখন সুলতানকেও ঢেকে আনি। এ সময় তাদের চাপ দেই- কতোজনকে এভাবে ভুয়া নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে, তা বলার জন্য। তখন তারা আমার কাছে স্বীকার করে দুই ধাপে অন্তত ২৫ জনকে এই তালিকায় নাম ঢুকিয়েছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্র প্রতিনিধি সাকিন অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।     

ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার বরাবর অভিযোগ
কালিয়াকৈর উপজেলার জুলাই আহত তালিকার গেজেট সংস্কার করা ও সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার বরাবর অভিযোগ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক নেতা জাহিদুর রহমান ও রেদোয়ান রহমান। গত ২৭শে আগস্ট এ অভিযোগ করেন তারা। অভিযোগে তারা বলেন, কালিয়াকৈর উপজেলার জুলাই আহত তালিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে নানা ধরনের অনিয়ম ও ত্রুটি লক্ষ্য করা গেছে। তালিকায় প্রকৃত আহতদের নাম বাদ পড়েছে এবং অপরদিকে অপ্রাসঙ্গিক ব্যক্তিদের নাম (যারা আন্দোলনে যুক্ত নয় বা প্রকৃত আহত হয়নি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে প্রকৃত আহতরা তাদের যথাযথ মর্যাদা ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং জুলাই আন্দোলন বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। এসব বিষয় নিয়ে সিভিল সার্জন অফিসে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি বারবার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। সিভিল সার্জন আমাদের জানিয়েছেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এই তালিকা তার নিজ দায়িত্বে করেছেন। ছাত্র প্রতিনিধিরা তাদের ওপরে অর্পিত দায়িত্ব অবহেলা করে নিজ পরিবারের কিছু সদস্য যারা প্রকৃত আহত নয় অন্তর্ভুক্ত করেছে। মো. আনিসুর রহমান হোসেন আলী, সাদিক হোসেন এবং মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মোরসালিন ওরফে সাকিন একটি সিন্ডিকেট পরিচালনা করে ভুয়া জুলাই আহত তালিকা করার জন্য এবং এই ক্ষেত্রে তারা অর্থের অনৈতিক লেনদেন করে। বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নির্দিষ্ট দলের পৃষ্ঠপোষকতায় ভুয়া জুলাইযোদ্ধা তালিকা তৈরিতে সহায়তা করেন। ছাত্র প্রতিনিধিদের সামনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হিসাবরক্ষক মামুন হোসেন ছাত্র প্রতিনিধিদের স্বাক্ষরবিহীন ও কোনোরকম তদন্তবিহীন একটি ফাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জমা দেন। যা পরবর্তী গেজেটে অন্তর্ভুক্তের অপেক্ষায় রয়েছে। এ বিষয়ে ছাত্ররা অভিযোগ করে গত ১৭ই আগস্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর আবেদনপত্র দেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমতাবস্থায়, জনস্বার্থে অনুরোধ করছি- ১. কালিয়াকৈর উপজেলার জুলাই আহত তালিকার গেজেট পুনঃসংস্কার করা। ২. তালিকা প্রণয়ন ও প্রকাশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা ও অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে প্রতারণা করার জন্য উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা। ৩. প্রকৃত আহতদের যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করে একটি স্বচ্ছ ও সঠিক গেজেট প্রকাশ করা।

কালিয়াকৈর উপজেলার এনসিপি’র সমন্বয়ক মো. মাহবুব মানবজমিনকে বলেন, কালিয়াকৈরে আওয়ামী লীগের সরকারের সাজানো প্রশাসন এখনো বহাল রয়েছে। তাদের তত্ত্বাবধানে ভুয়া জুলাই আহতের লিস্ট হয়েছে। আমি এগুলো নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মামলা খেয়েছি, আমার ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা করা হয়েছে। কাউকে পাশে পাই না। তাই চুপচাপ আছি। 

এ বিষয়ে কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী অফিসার কাউছার আহম্মেদ মানবজমিনকে বলেন, কালিয়াকৈরে প্রথম তালিকায় ১৮৭ জন ও দ্বিতীয় তালিকায় ৮৯ জনের নাম গেজেট হয়েছে। তৃতীয় তালিকায় যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। তবে কেউ যদি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে জুলাই আহতের তালিকায় নাম তোলেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে। আমরা যাচাই-বাছাই করে এ রকম ভুয়া জুলাই আহতের নাম পেলে তার নাম কর্তনের সুপারিশ করবো। একইসঙ্গে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবো।