
শিক্ষকতাকে মহান পেশা হিসেবে অভিহিত করা হলেও মান-মর্যাদার দিক দিয়ে একেবারেই পিছিয়ে রয়েছেন বাংলাদেশের শিক্ষকরা। দেশের সব পর্যায়ের শিক্ষকই বেতন-ভাতায় সন্তুষ্ট নন।
প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর মর্যাদা পান। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা শুধু মূল বেতন (বেসিক) পান।
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা, অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষকসহ অনেক নন-এমপিও শিক্ষক রয়েছেন, যাঁরা বেতন-ভাতাই পান না। ফলে আমাদের দেশে শিক্ষাদানের চেয়ে বছরজুড়েই চলতে থাকে শিক্ষকদের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন।
এ অবস্থায় আজ রবিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২৫। ইউনেসকো এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘শিক্ষকতা পেশা : মিলিত প্রচেষ্টার দীপ্তি’।
দিবসটি উপলক্ষে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘গুণী শিক্ষক সম্মাননা’র আয়োজন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন সেমিনারসহ নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করছে।
সূত্র জানায়, দেশে ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ। তাঁদের মধ্যে তিন লাখের বেশি সহকারী শিক্ষক এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী।
তাঁরা ১৩তম গ্রেডে বেতন পান। এই গ্রেডে ১১ হাজার টাকার স্কেলে শিক্ষকরা বেতন পাবেন সাকল্যে ১৮ হাজার টাকা। তবে প্রধান শিক্ষকদের সম্প্রতি দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা হলেও এখনো তাঁরা সমপদের বেতন-ভাতা পাননি।
শিক্ষকরা জানান, তিন দফা দাবিতে আগামী ১৭ অক্টোবর থেকে অনশন কর্মসূচি পালন করবে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের মোর্চা ‘প্রাথমিক সহকারী সংগঠন ঐক্য পরিষদ’। তাদের দাবিগুলো হচ্ছে সহকারী শিক্ষকদের এন্ট্রি পদে বেতন ১১তম গ্রেডে নির্ধারণ, চাকরির শুরু থেকে ১০ বছর ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড সমস্যার সমাধান এবং প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ পদোন্নতি।
বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের আশার বাণী দেওয়া হয়, কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা হয় না। আমি নিজেও ১৬ বছর চাকরি করে ১৩তম গ্রেডে বেতন পাই। শিক্ষকরা যদি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী না হন, তাহলে পাঠদানে কিভাবে মনোযোগী হবেন?’
জানা যায়, আমাদের দেশের ৯৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির মাধ্যমে প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীকে মূল বেতন দেয় সরকার। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও বেতন-ভাতা নিয়ে সন্তুষ্ট নন। যেসব শিক্ষকের বিএড নেই, তাঁরা শুরুতে ১১তম গ্রেডে ১২ হাজার ৫০০ টাকা মূল বেতন পান। আর বিএড থাকলে দশম গ্রেডে যান। এর বাইরে তাঁরা এক হাজার টাকা বাড়িভাড়া এবং ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। এখন একজন শিক্ষক যদি দশম গ্রেডেও বেতন পান তাহলে শুধু মূল বেতন হবে ১৬ হাজার টাকা। এর বাইরে দেড় হাজার টাকা অন্যান্য ভাতা রয়েছে। অন্যদিকে কলেজ পর্যায়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা নবম গ্রেডে ২২ হাজার টাকা মূল বেতন পান। তাঁরা সরকারি চাকরিজীবীদের মতো পূর্ণাঙ্গ বাড়িভাড়া, চিকিৎসাসহ অন্যান্য ভাতা পান না। এত দিন শিক্ষকরা মূল বেতনের মাত্র ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতাও পেলেও সম্প্রতি তা ৫০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে।
এ ছাড়া দেশে সাড়ে ছয় হাজার নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী, অনার্স-মাস্টার্স কলেজের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষক ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রায় ২০ হাজার শিক্ষক সরকারি বেতন পান না। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা এমপিওভুক্তির দাবি করে আসছেন। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরাও পূর্ণাঙ্গ বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ অন্যান্য দাবিতে আন্দোলন করছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া মূল বেতনের ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়নের সভাপতি আবুল বাশার হাওলাদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইউনেসকো ১৯৯২ সালের এক সনদে বলেছে, শিক্ষকরা থাকবেন সব পেশার ঊর্ধ্বে। বাংলাদেশও সেই সনদে স্বাক্ষর করেছে। অথচ আমাদের দেশের শিক্ষকরা বেতন-ভাতায় সবচেয়ে পিছিয়ে। অভাব-অনটন নিয়ে তো ভালো শিক্ষাদান আশা করা যায় না। এ ছাড়া শিক্ষকদের হেনস্তা, চাকরিচ্যুতি, অবহেলা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আমাদের আশা থাকবে, আগামী দিনে যারাই সরকার গঠন করুক না কেন, তারা যেন শিক্ষা খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মোট বিশ্ববিদ্যালয় ১৭২টি। এর মধ্যে সরকারি ৫৬টি আর বেসরকারি ১১৬টি। বেসরকারি কয়েকটি নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ীই ভালো বেতন পান। এর পরের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় বেতন দেয় গড়পড়তা। তবে বেশির ভাগেই শিক্ষকরা নামমাত্র বেতন পান, যা দিয়ে সংসার চালানোই কষ্টকর। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরকারি স্কেল অনুযায়ী বেতন পেলেও বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় তা যথেষ্ট নয়।
কয়েকটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন স্কেল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আমাদের দেশে একজন প্রভাষকের মূল বেতন ২২ হাজার এবং অধ্যাপকের ৬৪ হাজার ৬০০ টাকা। তবে বেশির ভাগ দেশেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রভাষকের পদ নেই।
তাদের শুরু সহকারী অধ্যাপক দিয়ে। ভারতে সহকারী অধ্যাপকদের বেতন স্কেল ৫৫ হাজার টাকা, সহযোগী অধ্যাপকের ৯০ হাজার টাকা এবং অধ্যাপকের মূল বেতন এক লাখ ১০ হাজার টাকা। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায়ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বেশ ভালো। ফলে সেই তুলনায় আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরাও পিছিয়ে আছেন।