Image description

দুর্নীতির সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি বেস্ট হোল্ডিংস (লা মেরিডিয়ান হোটেল)। ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ব্যাংক ও শেয়ারবাজারসহ উভয় খাত থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কোম্পানির মালিক বিতর্কিত ব্যবসায়ী আমিন আহমেদ টাকা পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। যেসব জালিয়াতি ও দুর্নীতি করেছে প্রতিষ্ঠানটি, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-জমির ভুয়া দলিল তৈরি করে সম্পদ বাড়িয়ে দেখানো, বিনিয়োগ কাঠামোর নামে প্রতারণা, নিরীক্ষা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগসাজশ করে অতিরিক্ত সম্পদ ও আয় দেখানো এবং শেয়ারের উচ্চ প্রিমিয়াম নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও বিনিয়োগকারীদের বিপদে ফেলা। জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া অর্থের একটি বড় অংশ বিদেশে পাচার করেছে। এই ঘটনায় পতিত সরকারের মন্ত্রী, আলোচিত মাফিয়া, আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারক, উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং প্রভাবশালী রাজনীতিবিদরা সরাসরি জড়িত। এদের প্রত্যেকেই আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে অসাধু কাজে সহায়তা করেছেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কর্মকর্তারাও বড় অঙ্কের সুবিধা নিয়েছেন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর গঠিত বিএসইসির তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বৈরাচার শাসনামলে চামচা পুঁজিবাদ (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম) কীভাবে অশুভ যোগসাজশে (আনহোলি নেক্সাস) আর্থিক খাতকে চরমভাবে গ্রাস করে লুটপাট করেছে, এই কোম্পানি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

জালিয়াতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। উল্লেখযোগ্য সুপারিশ হলো-অভিযুক্ত কোম্পানিটির চেয়ারম্যান আমিন আহমেদ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান আহমেদকে তাদের ব্যক্তিগত দায়ের জন্য কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা করে মোট ২০ কোটি টাকা জরিমানা। এছাড়া সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি রেস ম্যানেজমেন্টের নিবন্ধন বাতিল ও ২৫ কোটি টাকা জরিমানা, আর্থিক খাতে ব্যাপক সমালোচিত চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ও রেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান তাহের ইমামের ২০ কোটি টাকা জরিমানা এবং আজীবন নিষিদ্ধ, বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান-ড. খায়রুল হোসেন ও শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামসহ কমিশনারদের আজীবন নিষিদ্ধ, পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির হোসেন ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইর সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মামুন খালেদকে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকের পদে অযোগ্য ঘোষণা এবং বেস্ট হোল্ডিংসের প্লেসমেন্ট শেয়ারে লকইন আরও তিন বছর বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়। তবে রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে ১০ মাস পর্যন্ত তদন্ত রিপোর্ট আটকে রেখেছে খোন্দকার রাশেদ মাকসুদের কমিশন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই ধরনের কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে মানুষ শেয়ারবাজার থেকে আরও আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, শেয়ারবাজারের মূল সমস্যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট। দীর্ঘদিনের সুশাসনের অভাবে এই সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে সংকট উত্তরণে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে এ ধরনের অপরাধের বিচার না হলে মানুষ আস্থা ফিরে পাবে না।

জানতে চাইলে বেস্ট হোল্ডিংসের কোম্পানি সেক্রেটারি একে আজাদ লিপন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, তদন্ত রিপোর্টটি অত্যন্ত কনফিডেন্টশিয়াল (গোপনীয়)। শুনেছি তদন্ত কমিটি বিএসইসিতে রিপোর্ট জমা দিয়েছে। কিন্তু রিপোর্টে কী আছে তা আমরা জানি না। অপরদিকে এটি বিচারাধীন ঘটনা। ফলে এ ব্যাপারে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই।

বিএসইসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কোম্পানিটি লোকসানি হলেও কাগজে-কলমে মুনাফা দেখানো হয়। কোম্পানিটির জমির দলিল ও মালিকানা জালিয়াতিতে ভরপুর। একটি জমির কাগজে মূল্য দেখানো হয় ৪ হাজার ৮১ কোটি টাকা। কিন্তু এই জমির প্রকৃত মালিকানা কোম্পানির নামে নেই। আবার কোম্পানির এই ভুয়া প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে ৫টি সরকারি প্রতিষ্ঠান এখানে ১ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে সোনালী ৫০০ কোটি, অগ্রণী ৫০০ কোটি, জনতা ৫০০ কোটি, রূপালী ব্যাংক ৩০০ কোটি এবং সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ১৬৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের চাপে বিনিয়োগ করতে বাধ্য হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। আর এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ৯শ কোটি টাকার ক্ষতি চিহ্নিত করেছে তদন্ত কমিটি। এক্ষেত্রে শুধু সোনালী ব্যাংকের ক্ষতি ৪২৩ কোটি টাকা। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান কম্পোট্রলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) রিপোর্টেই সোনালী ব্যাংকের এই ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই পুরো অর্থ জনগণের আমানতের টাকা। অন্যদিকে বিনিয়োগের এই অর্থ ব্যবহারের জন্য স্পেশাল পারপাস ভেহিকল নামে একটি বিনিয়োগ কাঠামো তৈরি করে বেস্ট হোল্ডিংস। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা জামানত ছিল না।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়-২০১৭ সালে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানটি অপকর্ম শুরু করে। ওই সময়ে বিএসইসির চেয়ারম্যান ছিলেন ড. খায়রুল হোসেন। পরবর্তী সময়ে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের কমিশনে অপরাধের পূর্ণতা পায়। আইন লঙ্ঘন করে মাত্র ৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিকে ১ হাজার ২শ কোটি টাকার বন্ড ছাড়ার অনুমতি দেয় ড. খায়রুল কমিশন। ফলে ওই সময়ে এটি অপরাধের বড় পথ তৈরি করে। এই বন্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে ১০ টাকার শেয়ারের বিপরীতে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কোম্পানির কাছ থেকে ৫৫ টাকা প্রিমিয়ামসহ ৬৫ টাকা নিয়েছে। তদন্ত কমিটি মনে করছে, এই শেয়ারের সর্বোচ্চ দাম হওয়া উচিত ছিল ৩৫ টাকা। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বেস্ট হোল্ডিংস এবং প্রতিষ্ঠানটির ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স চুক্তি লঙ্ঘন করে আর্থিক জালিয়াতি করেছে। সেখানে রেস ম্যানেজমেন্ট পরিচালিত দশটি মিউচুয়াল ফান্ড এবং অগ্রণী ব্যাংক ১০ টাকার শেয়ারে ৫৫ টাকা প্রিমিয়াম দিয়েছে। এক্ষেত্রে দশ মিউচুয়াল ফান্ড থেকে ২শ কোটি এবং অগ্রণী ব্যাংক থেকে ১২৫ কোটি টাকা নেওয়া হয়। অর্থাৎ ১০ টাকার শেয়ারে ৫৫ টাকা প্রিমিয়াম দিয়ে ৬৫ টাকায় কেনায় মিউচুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগকারী এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক শুরুতেই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, আইনলঙ্ঘন করে প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে সরাসরি তালিকাভুক্তির চেষ্টা করে। এর সঙ্গে জড়িত ছিল সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান রেস অ্যাসেট ও পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট। এর আগে রেসের মাধ্যমে প্লেসমেন্ট বিতরণ করে বেস্ট হোল্ডিংস। এছাড়াও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিটি তার মালিকায় থাকা মিউচুয়াল ফান্ড থেকে ৭০ কোটি টাকার পদ্মা ব্যাংকের বন্ড কেনে। ওই সময়ে ব্যাংকটির নাম ছিল ফার্মার্স ব্যাংক। এর মালিকানায় ছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, অর্থমন্ত্রীর কন্যা নাফিসা কামাল এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল নেতা অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন অন্যতম। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বেস্ট হোল্ডিংসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বেস্ট সার্ভিস লিমিটেড। মূল কোম্পানি থেকে এই সহযোগী প্রতিষ্ঠানে ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬৩০ কোটি ৩১ লাখ বিনিয়োগ করা হয়। কিন্তু ২০২২ সালে ওই বিনিয়োগ কমে ২৩৪ কোটি ৫১ লাখ টাকায় নেমে আসে। এক্ষেত্রে কোম্পানিটি ২০২১ সালে ২৮০ কোটি ৮০ লাখ এবং ২০২২ সালে ১১৫ কোটি ৯১ লাখ টাকা সমন্বয়ের কথা বলেছে। তবে ক্যাশ ফ্লোর (নগদ জমা) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২১ সালে ২৮০ কোটি ৮০ লাখ টাকার সমন্বয়ের বিপরীতে নগদ জমা হয়েছে ১৩৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা। ২০২২ সালে ১১৫ কোটি ৯১ লাখ টাকা সমন্বয়ের বিপরীতে কোনো নগদ অর্থই জমা হয়নি।

অন্যদিকে রহস্যজনক কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে বেস্ট সার্ভিস লিমিটেড ‘বাংলাদেশ ফিক্সড ইনকাম স্পেশাল পারপাস ভেহিকেলে’ ৩৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে। একই সময়ে এই প্রতিষ্ঠানে মূল কোম্পানি বেস্ট হোল্ডিংস ইক্যুইটি বিনিয়োগ করে ৭৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর বিনিময়ে ৭ কোটি ৬৫ লাখ শেয়ার ইস্যু করা হয়। এর মানে হলো বেস্ট হোল্ডিংস তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তহবিল স্থানান্তর করেছে। পরে ওই অর্থ বাংলাদেশ ফিক্সড ইনকাম স্পেশাল পারপাস ভেহিকেলের মাধ্যমে কোম্পানিতে বিনিয়োগ দেখিয়ে তার বিপরীতে শেয়ার ইস্যু করেছে। দ্বিতীয়ত ২০১৭-২০১৯ অর্থবছরে বেস্ট হোল্ডিংস জমির বিপরীতে আগাম (‘অ্যাডভান্স এগেইনস্ট ল্যান্ড-নোয়াখালী এবং ‘অ্যাডভান্স এগেইনস্ট উইস্টেরিয়া) প্রজেক্ট শিরোনামে ক্যাপিটাল বনানী ওয়ান লিমিটেডে উল্লেখযোগ্য অঙ্কের বিনিয়োগ করেছে। পরবর্তী সময়ে ওই প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ ক্যাপিটাল বনানী ওয়ান ২০২০ সালে বেস্ট হোল্ডিংয়ে ১১৯ কোটি ৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ১১ কোটি ৯০ লাখ শেয়ার কেনে। এসব লেনদেন সন্দেহজনক। কোম্পানির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে ২০১৯ সাল থেকে ধামসুর অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করে আসছে বেস্ট হোল্ডিং।

২০১৯ সালে এই বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২০ কোটি ২ লাখ টাকা। ২০২২ সালে তা বেড়ে ২১৬ কোটি ৫২ লাখ টাকায় উন্নীত হয়। ২০১৯ সালে এ বিনিয়োগকে ‘অ্যাডভান্স এগেইনস্ট ল্যান্ড’ হিসাবে দেখানো হয়েছিল। ২০২০ সালে ‘শেয়ার প্রিমিয়াম’ হিসাবে এবং ২০২১ ও ২০২২ সালে ‘ইনভেস্টমেন্ট’ হিসাবে দেখানো হয়। অন্যদিকে ধামসুর অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০২১ ও ২০২২ সালের হিসাবে এই অর্থকে দায় হিসাবে মূল কোম্পানির কাছে পাওনা হিসাবে দেখায়। তদন্ত কমিটির মতে এসব কর্মকাণ্ড মানি লন্ডারিং এবং কারসাজির ইঙ্গিত দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, লেনদেন ও তহবিল স্থানান্তর প্রক্রিয়াসহ সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে বেস্ট হোল্ডিংসের পরিচালকরা বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন। ফলে বিএসইসিকে দ্রুত একটি স্বাধীন ফরেনসিক অডিট করতে হবে। এর সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি জড়িত থাকতে পারে। ফলে যে সময় কোম্পানিটি আইডিএলসি অর্থায়ন কাঠামোর সুবিধা গ্রহণ করেছিল, ওই সময়ের বিস্তারিত লেনদেন খতিয়ে দেখতে হবে। এছাড়াও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় আলাদা তদন্ত করার জন্য বিষয়টি দুদকে পাঠানো উচিত।

পারস্পরিক সম্পৃক্ততা : বেস্ট আইপিও প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে সমালোচিত চৌধুরী নাফিজ সরাফাত পদ্মা ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান। স্পন্সর হিসাবে পদ্মা ব্যাংক ওই সময়ে বাংলাদেশ ফিক্সড ইনকাম স্পেশাল পারপাস ভেহিকল (বিএফআইএসপিভি) গঠন করে। সেখানে রেস এই কোম্পানির উদ্যোক্তাদের একটি পক্ষ ছিল। সেন্টিনেল ট্রাস্টি অ্যান্ড কাস্টডিয়াল সার্ভিসেস ছিল এই কোম্পানির ট্রাস্টি। রেস পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট ছিল সেবা সরবরাহকারী (সার্ভিস প্রোভাইডার)। অন্যদিকে বিএইচএল বন্ডের রেটিং এজেন্সি আর্গাস ক্রেডিট রেটিং অ্যান্ড সার্ভিসেসের সঙ্গে রেসের সম্পৃক্ততা মিলেছে। এভাবেই কোম্পানিটি গড়ে তুলেছে অশুভ যোগসাজশ। ফাইন্যান্সিংয়ের ভাষায় একে কনফ্লিক্ট অব ইনটারেস্ট (স্বার্থের দ্বন্দ্ব) বলা হয়। কিন্তু এমন স্পর্শকাতর কর্মকাণ্ড বন্ধে হস্তক্ষেপ করেনি কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা। অর্থাৎ রাজনৈতিক বা আর্থিক প্রভাব, নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতা ও পক্ষপাতিত্বের প্রমাণ মিলেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযুক্তদের মধ্যে চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ক্ষমতাসীন (আওয়ামী লীগ) রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ড. হাসান তাহের ইমাম তার সহযোগী। এ ধরনের কর্মকাণ্ড স্বৈরাচারী শাসনামলে চরম ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। আবার বেস্ট হোল্ডিংসের আইপিও প্রক্রিয়ায় ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি হিসাবে নিয়োগ পায় ‘ইমার্জিং ক্রেডিট রেটিং’। এই কোম্পানির চেয়ারম্যান ড. জামালউদ্দিন আহমেদ। একই সঙ্গে তিনি কাস্টডিয়ান প্রতিষ্ঠান সেন্টিনেল ট্রাস্টি অ্যান্ড কাস্টডিয়াল সার্ভিসেসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠান বিএফআইএসপিভি গঠনে সহযোগী ছিল। আবার রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন ড. জামালউদ্দিন। তিনিই জনতা ব্যাংক থেকে বেস্ট হোল্ডিংস ৫০০ কোটি টাকার ইক্যুইটি বিনিয়োগ অনুমোদন দেন। সেখানে ১০ টাকার শেয়ার ৬৫ টাকায় কেনা হয়। অন্যদিকে যে কোম্পানি বিএইচএলের পাবলিক ইস্যু মূল্যায়ন করেছে, সেই হোদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কো. চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের অংশীদার ছিলেন জামাল উদ্দিন। ওই সময়ে তিনি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ছিলেন। এছাড়াও তিনি আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন।

সুপারিশ : অভিযুক্ত কোম্পানিটির চেয়ারম্যান আমিন আহমেদ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান আহমেদকে তাদের ব্যক্তিগত দায়ের জন্য কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা করে মোট ২০ কোটি টাকা জরিমানার সুপারিশ করেছে কমিটি। রেস ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. হাসান তাহের ইমামকে ব্যক্তিগতভাবে ন্যূনতম ১০ কোটি টাকা করে ২০ কোটি এবং অন্য প্রত্যেক পরিচালককে আলাদাভাবে ১ কোটি টাকা জরিমানার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া নাফিজ সরাফাত এবং ড. হাসান ইমামকে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ও মুদ্রাবাজার থেকে স্থায়ীভাবে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা। অর্থাৎ তারা পুঁজিবাজার ও মুদ্রাবাজার থেকে তহবিল সংগ্রহ বা বিনিয়োগ ফান্ড ব্যবস্থাপনা করাসহ সব ধরনের কাজ থেকে নিষিদ্ধ থাকবেন। বড় ধরনের অনিয়ম করায় বাংলাদেশ রেস ম্যানেজমেন্টের নিবন্ধন বাতিল এবং কমপক্ষে ২৫ কোটি টাকা জরিমানা করতে হবে।

এছাড়াও বিএফআইএসপিভির লাইসেন্স বাতিল করার সুপারিশ করা হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বকেয়া লভ্যাংশ ও সুদের টাকা পরিশোধ করেনি বেস্ট হোল্ডিংস। এই টাকা দ্রুত পরিশোধ না করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। বেস্ট হোল্ডিংসে সংগঠিত অপরাধের জন্য বিএসইসির তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন, তার পরবর্তী চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম এবং কমিশনার হেলাল উদ্দিন নিজামীকে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট যেকোনো প্রতিষ্ঠান থেকে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয়। তাদের অর্থ পাচারের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে দুদকে ফাইল পাঠাতে বলা হয়। খায়রুল কমিশনের অপর দুই কমিশনার আমজাদ হোসেন ও সালাম শিকদার ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ। শিবলী কমিশনের অপর ৪ জন কমিশনারকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়। এক্ষেত্রে অভিযুক্তরা বিএসইসি বা স্টক এক্সচেঞ্জের অনুমতি ছাড়া গণমাধ্যমে কথা বলতে পারবেন না।

সুপারিশে আরও রয়েছে-বেস্ট হোল্ডিংসের সাবেক স্বতন্ত্র পরিচালক শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির হোসেন, সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইর সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) শেখ মামুন খালেদ এবং স্বতন্ত্র পরিচালক এসএম মুনীরকে স্থায়ীভাবে পরিচালক পদে অযোগ্য ঘোষণা। বিএসইসির এনফোর্সমেন্ট ও মিউচুয়াল ফান্ড বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা ও লিখিত ভর্ৎসনা। বেস্ট হোল্ডিংয়ের প্রি-আইপিও প্লেসমেন্ট শেয়ারে লকইনের সময় আরও তিন বছর বাড়ানো। বিএসইসির সাবেক কমিশনার আরিফ খানকে বিএসইসির অফিস ও কার্যক্রমে ৩ বছরের জন্য নিষিদ্ধ।

শান্তা ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট এবং আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের নিবন্ধন তিন বছরের জন্য স্থগিত, ইমার্জিং ক্রেডিট রেটিংকে তিন বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা, একই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ড. জামালউদ্দিন আহমেদকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হোদা ভাসী চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানিকে তিন বছরের জন্য আইপিও মূল্যায়ন নিষিদ্ধ করা এবং আরেকটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান আর্টিসান চাটার্ড অ্যাকাউট্যান্টকে ৫ বছরের জন্য আইপিও অডিট নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া দায়িত্বহীন কাজ করায় বেস্ট হোল্ডিংসের ট্রাস্টি গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সকে কমপক্ষে ৩০ লাখ টাকা জরিমানার সুপারিশ করা হয়। নিয়ম ভেঙে বিনিয়োগ করায় আইসিবিকে ন্যূনতম ১০ লাখ এবং বিজিআইসিকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করতে হবে। সুপারিশে আরও বলা হয়, মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর অর্থ অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানে সন্দেহজনক বিনিয়োগের মাধ্যমে তহবিল অপব্যবহার করেছে। এতে ফান্ডের বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। যার কিছু ক্ষতি পুনরুদ্ধার অসম্ভব। তাই বিনিয়োকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ১০টি মিউচুয়াল ফান্ডের নিবন্ধন সনদ দ্রুত বাতিল করা উচিত।