
ভাগ্য বদলে বিদেশে কাজের জন্য যাওয়া অনেক বাংলাদেশির কাছেই ‘সোনার হরিণ’ ধরার মতো ব্যাপার। আর এ সোনার হরিণ ধরতে বেশির ভাগ মানুষের হাতে থাকে না পর্যাপ্ত অর্থ। সেই টাকা জোগাড়ে তারা জমি বিক্রি করেন। বন্ধক রাখেন স্বর্ণালংকার। অনেকে আবার বিভিন্ন মহাজনের কাছ থেকে উচ্চ হারে ঋণ নেন। বিদেশে যাওয়ার ঋণের টাকা জোগাড় করতে না পেরে সর্বস্বান্ত হয়েছে বহু পরিবার। কেউ কেউ এ টাকা জোগাড়ে নিজের শেষ সম্বল ভিটেমাটি ও বাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করে দিচ্ছেন। কিন্তু এত কষ্ট করেও ভালো নেই বহু প্রবাসী শ্রমিক। তাদের কেউ কেউ এখন বন্দিশিবিরে আটক।
তৃণমূল অভিবাসীদের সংগঠন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ)-এর এক গবেষণায় জানা যায়, বিদেশে অভিবাসনের ক্ষেত্রে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার মানুষ গড়ে খরচ করেন ৪ লাখ ৬১ হাজার ২২০ টাকা। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ টাকা সংগ্রহ করেন জমি বিক্রি করে। আর ১৮ শতাংশ নিয়েছেন চড়া সুদের ঋণ।
বাংলাদেশের অভিবাসীদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ যান গ্রামাঞ্চল থেকে। আর এ অভিবাসীদের বয়স ২৫ থেকে ৩৫ বছর। তাদের বেশির ভাগই সর্বোচ্চ মাধ্যমিক পাস এবং ৬০ ভাগের বেশি বিবাহিত। বিদেশে যেতে একজন অভিবাসীর পাসপোর্ট ফি, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিবহন ব্যয়, মেডিকেল ফি, দালাল ফি, ভিসা ফি, নিরাপত্তা ছাড়পত্রসহ অন্য খরচ দিতে হয়। অভিবাসী কর্মীদের নিয়োগ ব্যয় বহনের জন্য ৮০ শতাংশের বেশি পুরুষ কর্মীদের ঋণ করতে হয়। আর নারী কর্মীদের ক্ষেত্রে তা ৫০ শতাংশের বেশি। এজন্য ৪১ শতাংশ মানুষ বন্ধু ও আত্মীয়ের কাছ থেকে, ২৮ শতাংশ পরিবারের সদস্য থেকে, ২১ শতাংশ এনজিও এবং ১৫ শতাংশ মহাজন থেকে ঋণ নেন। আর জমি বিক্রি বা বন্ধক রেখে ১৫ শতাংশ মানুষ এ ঋণ নেন।
কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার মনপাল গ্রামের দিনমজুর বাবুল মিয়ার (ছদ্মনাম) বড় ছেলে কামাল হোসেন (২২) ওয়ার্কশপে কাজ করতেন। কামালের আয়ে পরিবারের ভরণপোষণ পূরণ হচ্ছিল না। এজন্য পরিচিত এক স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সৌদি আরবে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কামালের সেই স্বজন ফ্রি ভিসায় (কাজের নিশ্চয়তা নেই) তাকে সৌদি আরব পাঠানোর আশ্বাস দেন। এজন্য তাকে দিতে হবে ৫ লাখ টাকা। কামালদের কোনো জমি নেই। শেষ সম্বল শুধু ঘরের জায়গা। সৌদি যেতে সেটিও বিক্রি করে দিয়েছেন। সেখান থেকে স্বজনকে দিয়েছেন ৩ লাখ টাকা। আগামী সপ্তাহে প্লেনের টিকিট কাটতে হবে। সেই টাকা জোগাড় করতে এখন হন্যে হয়ে ঘুরছেন কামালের বাবা। কিন্তু কামাল কাজ না পেলে কী করবেন এমন প্রশ্নে বাবুল মিয়া বলেন, ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।
মাদারীপুর সদর উপজেলার পাঁচখোলা গ্রামের স্বপন হাওলাদার ইট-বালুর ব্যবসা করে সংসার চালাতেন। অভাব ছিল না সংসারে। কিন্তু ইতালিতে উন্নত জীবনের প্রলোভনে সব বিক্রি করে টাকা দেন দালালের হাতে। লিবিয়ায় নিয়ে তাকে বন্দিশিবিরে আটকে নির্যাতন চালানো হয়। সেখানে তিনি পঙ্গুত্ববরণ করেন। পরে অনেক চেষ্টা করে দেশে ফিরলেও এখন তাকে সারাজীবন পঙ্গুত্ব নিয়ে কাটাতে হচ্ছে। একই গ্রামের এলেম ফকির তার ছেলে সিরাজুল ফকিরকে ইতালি পাঠানোর জন্য ঋণ করেন ও জমি বন্ধক রাখেন। টাকা দিয়েও কোনো সুফল মেলেনি। সিরাজুল গত তিন মাস ধরে লিবিয়ার একটি বন্দিশিবিরে আটক রয়েছেন। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে বলেন, দালালের খপ্পরে পড়ে সবকিছু হারালেও তারা কোনো আইনি প্রতিকার পান না। মামলা করেও সমাধান মেলে না। মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াদিয়া শাবাব বলেন, ‘অনেকেই উন্নত জীবনের আশায় বিদেশে যেতে গিয়ে দালালের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। আমরা তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সরকারের নীতিমালা মেনে বৈধভাবে বিদেশ যেতে উৎসাহিত করি।’
সৌদি ফেরত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরের নোমান মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে প্রবাসে গিয়েছিলাম পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য। সেখানে বিড়ম্বনায় পড়ি। ভিসার সঙ্গে কাজের মিল না হওয়ায় আমার যে টাকা খরচ হয়েছে তা এখনো তুলতে পারিনি। কী করব বুঝতে পারছি না। স্থানীয় এক সর্দারের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা সুদের বিনিময়ে ধার নিই। সে টাকা দিয়ে বিদেশে আসি। পরে সুদাসলে মিলে ৭ লাখ টাকা পরিশোধ করি। ঋণ পরিশোধের আশা নিয়ে দেশ ছাড়লেও সেই ঋণ এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কসবা উপজেলার প্রবাসী মেহেদী মিয়া জানান, প্রায় পাঁচ বছর আগে লাভের ওপর টাকা নিয়ে সাড়ে ৫ লাখ টাকা খরচ করে আরব আমিরাতে যাই। হোটেলে চাকরির কথা বলে ভিসা নিয়েছিলাম। এখন ধার পরিশোধ করব নাকি পরিবারের ভরণপোষণের টাকা পাঠাব তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন কুমিল্লা, মাদারীপুর এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়া প্রতিনিধি)