Image description
সাত হাজার মানবপাচার মামলা

‘মানব পাচার মামলা’য় সাজার হার মাত্র ১ শতাংশ। আর ৯৯ শতাংশ আসামিই বেকসুর খালাস পেয়ে যাচ্ছে। এ জন্য আইনি দুর্বলতা, দুর্বল তদন্ত, ভুল ধারা প্রয়োগ, রাজনৈতিক প্রভাব, প্রভাবশালী আসামিপক্ষের চাপে আদালতের বাইরে আপোস-মীমাংসা করাসহ বিভিন্ন কারণকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন ও আইনমন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মানব পাচারের ঘটনা দিনকে দিন বাড়ছে। সে অনুযায়ী এ সংক্রান্ত অপরাধের বিচার হচ্ছে না। শাস্তিও পাচ্ছে না পাচারের সঙ্গে জড়িত অপরাধী চক্র। বিশ্লেষকদের মতে,শাস্তি না পাওয়াই হচ্ছে মানব পাচার বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ। তবে মানব পাচারের শাস্তি ভয়াবহ হলেও বিচার না হওয়ার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান এখন দ্বিতীয় কাতারে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিকভাবে এক ধরণের চাপেও রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে ২০২০ সালের মার্চে ‘মানব পাচার অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করে। দেশে এখন বিভাগওয়ারি ৭টি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে।

আদালত সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন আদালতে প্রায় ৭ হাজার মানব পাচারের মামলা বিচারাধীন। বিভিন্ন আদালত নিজস্ব এখতিয়ারবলে মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হতো। কিন্তু স্বতন্ত্র আদালত না থাকায় এ সংক্রান্ত বিচারগুলো দীর্ঘসূত্রিতায় পর্যবসিত হয়। অপরাধীরা আইনের ফাঁক গলে জামিনে মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদের শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিলো আইনগত দুর্বলতাও। এ প্রেক্ষাপটে তৎকালিন সরকার ২০১২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সংসদে ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২’ প্রণয়ন করে। আইনটিতে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িতের অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আইনটি পাস হলেও কার্যকর করতে লেগে যায় ৮ বছর। কারণ আইনের ২১(১) ধারায় এ আইনে বিচাররের জন্য পৃৃথক ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের কথা বলা হয়। একটি কেন্দ্রীয় ‘মনিটরিং সেল’ গঠনেরও বাধ্যবাধকতা রয়েছে আইনে। তা সত্ত্বেও সরকার ট্রাইব্যুনাল স্থাপনে কালক্ষেপণ করে। সরকারের নিি ষ্ক্রয়তা চ্যালেঞ্জ করে একাধিক রিট হয়। একপর্যায়ে ২০২০ সালের মার্চে গঠিত হয় ট্রাইব্যুনাল। পরে এক আদেশে বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন মানব পাচারের মামলা ‘মানব পাচার দমন ট্র্রাইব্যুনাল’র এ স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা,চট্টগ্রাম,সিলেট,খুলনা,রাজশাহী,রংপুর এবং বরিশালে ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয়।

থেমে নেই মানব পাচার : আড়াই হাজার, নারায়ণগঞ্জের সালমা খাতুন। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ইতালি যাওয়ার জন্য লাইন দেন। কম টাকায় স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে ২০২১ সালে যাত্রা করেন এ নারী। প্রথমে তাকে যাওয়া হয় ভারতে। সেখান থেকে বিমানে ইতালি পাঠানোর কথা । ভারতীয় একটি মানবপাচার চক্র তাকে সেখানে আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন চালায়। তাকে পণবন্দী করে অর্থ আদায় করা হয় পরিবারের কাছ থেকে। পরে তাকে বিনা ট্রাভেল ডকুমেন্টে ছেড়ে দেয়া হয়। এক সময় ভারতীয় পুলিশ তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশের অপরাধে গ্রেফতার করে। টানা ৬ মাস কারাগারে ছিলেন তিনি। একটি মানবাধিকার সংস্থার মাধ্যমে দেশে ফিরে সাত জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই মামলায় সব আসামি জামিনে বেরিয়ে আসেন। সালমা এখনো বিচার পান নি।

মামলা সাত হাজার : শুধু এক সালমা নন। মানব পাচারের ঘটনায় অর্ধ যুগে মামলা হয়েছে অন্তত: ৭ হাজার। এসব মামলায় আসামি রয়েছেন ২০ হাজারের বেশি। তবে মামলায় শাস্তির হার খুবই নগন্য। শতকরা এক শতাংশ আসামির শাস্তি হয়। ৯৯ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া মানব পাচারকারীদের হাত ধরে বিদেশ যাওয়ার সময় নৌপথে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত: ৭২ ভুক্তভোগী।

ঢাকা বারের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানের মতে,দুর্বল আইন, দুর্বল তদন্ত এবং পুলিশের দুর্নীতির কারণে মানবপাচারকারীরা অধরা থেকে যাচ্ছে। তবে সরকারপক্ষীয় আইনজীবীরা জানান, মামলা হলেও সাক্ষী পাওয়া যায় না। দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচারপ্রার্থীদের অনাগ্রহ ইত্যাদি কারণেও অপরাধীরা ছাড় পেয়ে যায়।

মানব পাচারের মামলা মনিটরিংয়ের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের। দফতরটির পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মানব পাচারের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার। এসব মামলার আসামি ১৯ হাজার ২৮০ জন। বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে সাজা হয়েছে মাত্র ১৫৭ জনের। এর মধ্যে ২৪ জনের যাবজ্জীবন ও ১৩৩ জনকে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তি। মামলায় গুরুতর অভিযোগ থাকলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোনো নজির স্থাপিত হয়নি। বরং গত ৬ বছরে মানব পাচারের মামলায় বেকসুর খালাস পেয়েছে ৩ হাজার ১৪১ জন আসামি। সবচেয়ে বেশি আসামি খালাস পেয়েছে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে আওয়ামী সরকার আমলে। এ কারণ হিসেবে জানাযায়, মানবপাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা আওয়ামী নেতাদের ছত্রছায়ায় অপরাধ করতো। ফলে স্থানীয় প্রভাবে অনেক সাক্ষী অপরাধীদের ভয়ে আদালতে সাক্ষী দিতে আসেন নি।

টিকটকের আড়ালে টিনএজ কিশোরীদের ভারতে পাচার করে আসছে একটি চক্র। পাচারের শিকার হওয়া এক তরুণী ২০২১ সালের ৭ মে পালিয়ে দেশে এসে পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করেন। হাতিরঝিল থানায় ওই বছরের ১ জুন দায়ের মামলায় ১২ জনকে আসামি করা হয়। চার বছরেও আলোচিত মামলাটি চার্জশিট হয়নি। অথচ একই ঘটনায় ভারতে গ্রেফতার আসামিদের বিচার-পরবর্তী শাস্তিও নিশ্চিত করা হয়েছে।

সিলেট হবিগঞ্জের সোহেল নামে এক টিকটকার তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে ২০২২ সালে ভারতে যান। কথা ছিল তারা টিকটক ভিডিও বানাবেন। কিন্তু নারী পাচারকারী কয়েকজনের হাতে স্ত্রীকে তুলে দিয়ে সটকে পড়েন সোহেল। এ ঘটনায় তার শ্বশুর মামলা করলেও অদ্যাবধি চার্জশিট হয়নি।

এ বিষয়ে পুলিশের বক্তব্য হচ্ছে, মানবপাচারের মামলাগুলোর অন্যতম চ্যালেঞ্জ যথাসময়ে সাক্ষী হাজির না হওয়া। আবার অনেক সময় দেখা যায়, বাদী-বিবাদী নিজেদের মধ্যে বিষয়টি মীমাংসা করে ফেলেন। কোনো পক্ষ দেশের বাইরে থাকলেও বিচারের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। জিম্মি হওয়া ব্যক্তি যদি দেশের ভেতরে থাকে, তাহলে তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। তবে দেশের বাইরে ঘটনা ঘটলে ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, পাচারকারীরা একপ্রকার ধরেই নিয়েছে মানব পাচার মামলার বিচার হয় না। এজন্য তারা বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মানব পাচার মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টে একটি রিটও হয়। আবার অনেক অভিযোগ মামলা পর্যন্ত গড়ায় না। কখনো মামলা হলেও বিচার শেষ হতে লম্বা সময় লেগে যায়। সে ক্ষেত্রে অনেক ভুক্তভেগী সমঝোতার পথ বেছে নেন।

পুলিশের দুর্বল তদন্ত : আইনের দুর্বলতাতো রয়েছেই। এর ওপর রয়েছে তদন্তের দুর্বলতা। পুলিশের দুর্বল তদন্তের কারণে মানব পাচারের অধিকাংশ মামলায় আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে। মানব পাচারের মামলাগুলো যেন পুলিশের জন্য লাভজনক মামলায় পরিণত হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিস্টরা উভয় পক্ষের কাছ থেকেই আর্থিকভাবে লাভবান হয়। তারা বিচারের সময় সাক্ষী-প্রমাণ হাজির করেন না। আবার এসব মামলার তদন্তে আগে এক ধরণের নজরদারির ব্যবস্থা ছিল। এখন সেটিও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ফলে পুলিশ যেনতেন একটা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে আদালতে। দায়সারা এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিচার হলে আসামির খালাস পেয়ে যাওয়াটাই বরং স্বাভাবিক।

শাস্তির হার উল্লেখ করার মতো না হলেও দালালচক্রের হাত ধরে অবৈধ পথে বিদেশে যেতে গিয়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে অনেক। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, দেশে বেকারত্ব বাড়ছে। এ কারণে যেনতেন প্রকারে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টাও তরুণ বাংলাদেশীদের বিদেশে যাওয়ার চাহিদা ক্রমান্বয়েই বাড়ছে। এটিকে পুঁজি করে একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী সংঘবদ্ধ চক্র নানা কর্মসংস্থানের আশ্বাস দিয়ে প্রতারিত করছে। গত বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে ইতালি যাওয়ার পথে একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভূমধ্যসাগরের তিউনিসিয়া উপকূলে ডুবে যায়। এতে অনেক প্রাণহানি ঘটে। এর মধ্যে বাংলাদেশীই ছিলেন ৮ জন। এছাড়া ২০২০ সালে লিবিয়ার মিজদাহে পাচারকারীদের গুলিতে নিহত হন ২৬ বাংলাদেশী। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে ৩৯ বাংলাদেশীর সলিলসমাধি ঘটে।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো: ওমর ফারুক ফারুকী মানব পাচার মামলা সম্পর্কে বলেন, আমাদের এখানে মানবপাচারের মামলাগুলোর বেশির ভাগই প্রতারণাসংক্রান্ত। যেমন ধরুন, কেউ ভিসা নিয়ে বিদেশে গেছেন, কিন্তু সেখানে গিয়ে কাঙ্খিত চাকরি পাননি। তখন দেশে তার আত্মীয়-স্বজন মানব পাচারের মামলা করে দেন। পরে দেখা যায়, বিচার চলা অবস্থায়ই বাদী ও বিবাদী পক্ষ আপস করে নেন। সেই আপসনামার ভিত্তিতে এক পর্যায়ে আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। এর বাইরে প্রকৃত মানব পাচারের যে মামলাগুলো আসে, যেমন ধরুন ভারতের পতিতালয় কিংবা লিবিয়া ও লেবাননে নারী পাচার হয়ে থাকে। এসব ঘটনায় যে মামলাগুলো হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে সঠিক বিচার নিশ্চিত করা যায়।