Image description

আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠ প্রশাসনে রদবদল শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। মাঠ প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে পরিচিত জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদেও নতুন নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি জেলায় এই পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্য রয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। নির্বাচন কমিশনও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে জোর কদমে। 

সূত্র মতে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে প্রশাসনে ব্যাপক রদবদলের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এ লক্ষ্যে যোগ্য কর্মকর্তা বাছাই (ফিটলিস্ট) করা হয়েছে, হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনে জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। তবে আগামী নির্বাচনে ডিসিরা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকবেন কিনা, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানায়নি। তবে শেষ পর্যন্ত ডিসিদেরকে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে রাখা হলে নির্বাচনে তাদের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সেটি বিবেচনায় নিয়ে যোগ্যদের নিয়োগ দিচ্ছে সরকার।

ইতিমধ্যে ৯ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জেলাগুলো হলো পটুয়াখালী, কুষ্টিয়া, কুড়িগ্রাম, মেহেরপুর, নেত্রকোণা ও খুলনা। এর মধ্যে তিনজন কর্মকর্তাকে নতুন ডিসি ও তিনজন ডিসিকে বদলি করা হয়েছে। ২৫শে আগস্ট এসব জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, নরসিংদী ও নওগাঁয় নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দিয়েছে সরকার। গত ২১শে সেপ্টেম্বর এ তিন জেলায় ডিসি নিয়োগ দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া এ প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে এখনই মাঠ প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। যোগ্য, অভিজ্ঞ, দক্ষ, কৌশলী ও সাহসী কর্মকর্তাদের মাঠ প্রশাসনে নিয়োগ দিতে হবে। কোনো তদবিরের মাধ্যমে মাঠ প্রশাসন সাজানো হলে সেখানে ভালো কিছু আশা করা যায় না। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন,  জনপ্রশাসন ও কেবিনেট বিভাগ মিলে বিচক্ষণতার সঙ্গে যোগ্যদের ভালোভাবে যাচাই বাছাই করে মাঠ প্রশাসনে পাঠাবেন। তিনি বলেন, আরও আগেই মাঠ প্রশাসন সাজানো দরকার ছিল। কারণ ডিসিকে ওখানকার তথা জেলার পরিস্থিতি বুঝতে একটু সময় দিতে হয়। নির্বাচন শুধু ডিসিদের উপরই নির্ভর করে না উল্লেখ করে তিনি বলেন,  সেখানে পুলিশ ও নির্বাচন কমিশন রয়েছে। সরকারের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে মাঠ প্রশাসনকে কাজ করতে হয় বলেও তিনি  মন্তব্য করেন। 

জানা যায়, বিগত সরকার নির্বাচনের কয়েক মাস আগে অনেক জেলায় ডিসি পদে পরিবর্তন এনেছিল। গত বছর গণ-অভ্যুত্থানের পর বর্তমান সরকার দায়িত্ব নিয়ে আগের ডিসিদের প্রত্যাহার করে পর্যায়ক্রমে সব জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেয়। তবে তখন এই নিয়োগ নিয়ে সচিবালয়ের ভেতরে কর্মকর্তারা হাতাহাতি, হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটান। তখন ৯ জন ডিসির পদায়ন বাতিল করা হয়েছিল। রদবদল করা হয়েছিল চার জেলার ডিসিকে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কয়েক মাস আগে বলেছিলেন, যেহেতু সামনে জাতীয় নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন রয়েছে, তাই মাঠ প্রশাসনের এই গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ্য কর্মকর্তাদের আনার চেষ্টা চলছে। এবার নতুন করে ২৮তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারের কিছুসংখ্যক কর্মকর্তাকে ডিসি পদে নিয়োগের চিন্তাভাবনা চলছে। ইতিমধ্যে ২৮তম ব্যাচের বেশ কিছুসংখ্যক কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারও নেয়া হয়েছে। বর্তমানে ২৪তম, ২৫তম ও ২৭তম বিসিএসের কর্মকর্তারা ডিসি পদে দায়িত্বে আছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র বলছে, ২৪তম বিসিএসের কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে সেখানে নতুন ডিসি নিয়োগের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে। একই সঙ্গে আরও কিছু জেলায়ও পরিবর্তন আসতে পারে।
এদিকে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাঠ প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ডিসি পদে রদবদল নিয়ে অভিযোগ উঠেছে।

গত ২২শে সেপ্টেম্বর বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেছেন, প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের লোকজনকে ডিসি-এসপি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, ছাত্রদলের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রশাসনের অনেক মেধাবী কর্মকর্তাকে গুরুত্বহীন পদে সরিয়ে রাখা হচ্ছে।  তিনি আরও অভিযোগ করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে শেখ হাসিনার শাসনকালের মতোই প্রশাসনে বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া ২১ জন ডিসিকে প্রত্যাহার করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, যেহেতু সামনে জাতীয় নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন রয়েছে, এবার নতুন করে ২৮তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারের কিছুসংখ্যক কর্মকর্তাকে ডিসি পদে নিয়োগের চিন্তাভাবনা চলছে। ২১ জেলায় বর্তমানে যারা ডিসির দায়িত্বে আছেন, তারা গত মার্চে উপ-সচিব থেকে পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব হয়েছেন। তবে ডিসির পদটি উপ-সচিব পদমর্যাদার। ফলে এই জেলাগুলোতে বদলির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কক্সবাজার, ঝিনাইদহ, পঞ্চগড়, মাগুরা, সাতক্ষীরা, ঝালকাঠি, নোয়াখালী, চাঁদপুর, পিরোজপুর, চুয়াডাঙ্গা, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, ঢাকা, মাদারীপুর, গাইবান্ধা, কিশোরগঞ্জ ও জয়পুরহাট জেলার ডিসিরা ২৪তম বিসিএসের কর্মকর্তা। ডিসি পদে এই ব্যাচের ২৬ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচজনের পদোন্নতি হয়নি।

এদিকে, ডিসি নিয়োগে আর্থিক অনিয়মসহ নানা বিতর্কের মুখে চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানকে সরিয়ে দেয়ার পর এই পদ দখলে নিতে বিএনপি ও জামায়াতপন্থি আমলাদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। জাতিসংঘের অধিবেশন থেকে প্রধান উপদেষ্টা দেশে ফিরলেই জনপ্রশাসন সচিব নিয়োগসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে সচিব পদে রদবদল করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে বিশ্বব্যাংকে বদলি করা হতে পারে- এমন খবরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদ পেতেও দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনের মাঠ সাজানোর দায়িত্ব পালন করবেন জনপ্রশাসন সচিব। এ কারণে এই পদে কে আসছেন তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সচিবের রুটিন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ওই মন্ত্রণালয়ের ১৮ ব্যাচের অতিরিক্ত সচিব ড. আবু শাহীন মো. আসাদুজ্জামানকে।