Image description
সরজমিন হোমনা

পুরুষশূন্য গ্রাম। হোমনা উপজেলার আসাদপুর। কুমিল্লা শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তরে গ্রামটি। পুরুষশূন্য পুরো গ্রাম।  নারী, শিশুরা রয়েছেন ভয়ে ভয়ে। রাতে গ্রাম জুড়ে নেমে আসে ভুতুড়ে নীরবতা। কেন এমন হলো?  গত ১৮ই সেপ্টেম্বর কয়েক ঘণ্টায় বদলে দিয়েছে পুরো গ্রামের চিত্র। ওই গ্রামের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক আলেক শাহ’র  ছেলের একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে জ্বলে ওঠে উত্তেজনার আগুন। সেই আগুন গ্রাস করে নেয় গ্রামের চারটি মাজার, ঘরবাড়ি, দোকানপাট। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে গ্রাম। হোমনা থানার এসআই তাপস কুমার সরকার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ২২০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ভিডিও ফুটেজ ও স্থানীয় সূত্র ধরে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পথে দেখা হয় ওই গ্রামের  হাজী মোতালেব হোসেনের সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, মাজারে হামলার পর এ এলাকার যুবকরা সবাই আত্মগোপনে চলে গেছে। বাড়িতে শুধু বয়স্করা  আর বউ ঝি’রা থাকে। 

সম্প্রতি  দোকানদারসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাই ভয়ে কেউ দোকান খুলে না। সড়ক ধরে যতদূর চোখ যায় শুধু ইরি ধানের ক্ষেত। মাঠে কাজ করে দুপুরে খাবারের জন্য এসেছিলেন আছিয়া খাতুন। তিনি বলেন, মাজারে হামলার পর পুরো গ্রামের পুরুষ সবাই গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছে। আমার দুই ছেলে শহরে গিয়ে আছে। ঘরে শুধু আমি আর নাতিরা আছি। রামকৃষ্ণ কলেজের শিক্ষার্থী রাফি হোসেন বলেন, মহানবী (সা.)কে নিয়ে কটূক্তি করায় আশপাশের কয়েক এলাকার মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে হামলা চালিয়েছে মাজার ও বাড়িঘরে। এখানে কোনো দলের লোক ছিল না সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে এসেছিলেন। ২২০০ লোকের নামে মামলা হওয়ায় আসাদপুর গ্রামের সবাই আতঙ্কিত। এ গ্রাম সব সময় শান্তশিষ্ট থাকে। মাজারের কর্মকাণ্ড নিয়ে আগে থেকেই বিতর্ক ছিল। তারা এখানে নাচ, গান গাঁজার আসর বসাতো। এ নিয়ে আগে থেকেই ক্ষোভ বিরাজ করছিল এলাকায়। সর্বশেষ মহানবী (সা.)কে নিয়ে কটূক্তি করায় ক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়। হামলার পর পুলিশ যাকে পায় তাকেই সন্দেহ করছে। তাই গ্রামের পুরুষরা পালিয়েছে। 
টাকায়ও রক্ষা মিলেনি: ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে যখন উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে তখন হামলা ঠেকাতে পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি টাকা দাবি করে। আতঙ্কগ্রস্ত আলেক শাহ ও তার স্বজনরা কয়েক দফায় অর্ধ লাখ টাকা দেন স্থানীয় কয়েকজনকে। তার মধ্যে শুধু থানার এক এসআইকেই দিতে হয়েছে ৪০ হাজার টাকা।

কিন্তু তাতেও রক্ষা পাননি তারা। সরজমিন দেখা যায়, আসাদপুর বাজারের কফিল উদ্দিন শাহ মাজারে এখন কাঠমিস্ত্রিরা ঘর মেরামত করছেন। চারদিকে ভাঙা কাঁচ, ছাই হয়ে যাওয়া খাট-বিছানা, পোড়া টিন। সব কিছু ভুলে নতুন আশায় আবার আলেক শাহ তার হোমিওপ্যাথিক হলে রোগী দেখা শুরু করেছেন। আলেক শাহ এ প্রতিনিধিকে বলেন, আমার ছেলে অন্যায় করেছে, আমি বলেছি আইন তাকে বিচার করুক। কিন্তু আমার ফার্মেসি, বসতবাড়ি, মাজার সব কেন পোড়ানো হলো? আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। তিনি আরও  বলেন, গত ১৭ই সেপ্টেম্বর  আমার ছেলে মহানবী (সা.)কে নিয়ে কটূক্তিমূলক পোস্ট করলে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এ সুযোগে কয়েকজন টাকা আদায়ের পাঁয়তারা করেন। স্থানীয় চঞ্চল নামে একজন ২টা মাদ্রাসা ম্যানেজ করার নামে ১৫ হাজার টাকা দাবি করেন। পরে আমি তাকে ৫ হাজার টাকা দেই। কিন্তু এরপরেও রাতে সে আবার আমার কাছে টাকা চায়। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলেন, হোমনা থানার  এসআই আকবরকে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছি। কিন্তু তারপরও হামলা ঠেকানোয় কেউ এগিয়ে আসেনি। এ ছাড়া তার স্ত্রী মানোয়ারা বেগম স্থানীয় দরিকান্দি এলাকার  রহমানকে   ১০ হাজার টাকা দেন হামলার আগের রাতে । তিনি আরও বলেন, আমার ছেলে সমাজে বিদ্বেষমূলক কথা বলার জন্য তার সঙ্গে আমার আরও আগে থেকেই কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি এটা সবাই জানে।

এ ঘটনার পরে আমি ভয়ে কোনো মামলা করিনি। কিন্তু পুলিশ বাদী মামলায় ২ জনকে গ্রেপ্তার করলে তাদের আত্মীয়স্বজনরা আমার কাছে এসে বলেছিল যেন পুলিশকে কল দিয়ে অনুরোধ করি তাদের ছেড়ে দিতে। আমি ভয়ে পুলিশকে কল দিয়েছিলাম ছেড়ে দিতে কিন্তু পুলিশ বলেছে মামলা তারা করেছে তাই আমার অনুরোধে কাজ হবে না।  উনারা ভিডিও দেখে দেখে জড়িতদের গ্রেপ্তার করছেন। তিনি বলেন, আমরা শুনেছি আমাদের সহয়ায়তা করা হবে। কিন্তু এখনো তেমন কিছু পাইনি। মফিজ মেম্বার ৪ বান টিন এবং কিছু টাকা দিয়েছেন। আলেক শাহ’র দাবি, প্রায় ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। তার মধ্যে শুধু হোমিওপ্যাথিক ওষুধেই ছিল ২০ লাখ টাকার বেশি।

কীভাবে হামলা হলো: ভুক্তভোগীরা জানায়, আলেক শাহ‘র ছেলে মহসিন তার ফেসবুক আইডি থেকে গত ১৭ই সেপ্টেম্বর  বুধবার সকাল ১০টা ৫২ মিনিটে মহানবীকে নিয়ে কটূক্তিমূলক একটি পোস্ট করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় স্থানীয় একদল মানুষ হোমনা থানা ও মাজারের  সামনে জড়ো হয়ে মহসিনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেন। পরে ওই দিন দুপুরেই পুলিশ মহসিনকে আটক করে নিয়ে যায়। কিন্তু ক্ষোভ থামেনি। ক্ষোভ থামাতে ভুক্তভোগী  আলেক শাহ বিকাল থেকে স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাফ চান এবং হামলা না চালানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু এর মধ্যেই ছেদপুর, নোয়াগাঁও, ধরিকান্দি, দত্তের কান্দি, গোনিয়ার চর, কলাগাছি এলাকায় মাইকিং করা হয় মাজারে হামলা করার জন্য। পরিস্থিতি খারাপ দেখে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান আলেক শাহ। পরদিন বৃহস্পতিবার সকাল ৮ টায় প্রথম দফায় কফিলউদ্দিন আলেক শাহের বাড়িতে অবস্থিত তার বাবা কফিল উদ্দিন শাহ’র মাজারের গ্লাস ভাঙচুর করে একদল উত্তেজিত জনতা। হামলা শেষে তারা নয়াবাজারে যান এবং সেখান থেকে পুনরায়, ৯ টার দিকে এসে মহসিনদের তিনটি বসতঘরে ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়। এরপর একই গ্রামে অবস্থিত আবদু শাহের মাজার, কালাই (কানু) শাহের মাজার এবং হাওয়ালি শাহের মাজারে হামলা চালানো হয় । এ হামলার পেছনে বোরহান নামে একজন প্রধান ভূমিকা রেখেছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। 

প্রাণ বাঁচাতে প্রতিবেশীর সাহায্য: হামলার সময় আলেক শাহ’র মেয়ে কানন রান্না করছিলেন। ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে মাজারের পেছন দিয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন। কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা তাকে খুঁজতে যায় সেখানে। পরবর্তীতে সেনাবাহিনী এলাকায় প্রবেশ করলে তিনি নিরাপদে বের হতে পারেন। তিনি বলেন, স্থানীয় কোনো রাজনৈতিক নেতা আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি। শুধু আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু থামায়নি হামলা। তার ভাষায়, যদি প্রতিবেশী রেজাউলের মতো আরও ১০ জন মানুষ এগিয়ে আসতেন তবে এত বড় ধ্বংসযজ্ঞ হতো না। তিনি আরও বলেন, কেউ থামায়নি হামলা সব ধ্বংস করে দিয়ে গেছে, টিউবওয়েল পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে। পানি যে খাবো সে পরিস্থিতিও ছিল না। আতঙ্কে মামলা করতে পারিনি। হোমনা উপজেলার নির্বাহী অফিসার ক্ষেমালিকা চাকমা বলেন, ভুক্তভোগীদের নিরপত্তায় পুলিশের টহল চলমান রয়েছে। যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।  অন্যায়ভাবে কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না। এতে আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। এ ছাড়া ভুক্তভোগীদের সহায়তায় কিছু টিন এবং টাকা দেয়া হয়েছে।