
মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে এবং কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি বিক্রেতা ও ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে রাজধানীর পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়কের পাশেই বৃহৎ বিকল্প বাজারব্যবস্থা চালু হচ্ছে। ১২ বিঘা জায়গা নিয়ে ‘কৃষকের বাজার’ গড়ে উঠছে। কৃষকের বাজার (ফার্মার্স মার্কেট লিমিটেড) আগামী ১০ অক্টোবর উদ্বোধনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই বাজারে কৃষকরা সরাসরি নিজেদের উৎপাদিত শাক-সবজি, পেঁয়াজ, রসুন, আলু, মাছ, মাংস, ডিম, ফলসহ নানা পণ্য বিক্রি করবে।২০ টাকা বা তার চেয়েও কম দামে মিলবে সবজি। বেসরকারি খাতের কয়েকজন উদ্যোক্তার প্রয়াসে এ বাজার। সংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
সম্প্রতি সরেজমিনে কৃষকের বাজারটি ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে স্থাপনা নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।এরই মধ্যে সবজি, পেঁয়াজ, রসুন, আলু, মাছ-মাংস বিক্রির জন্য আলাদা করে বড় বড় শেড তৈরির করা হয়েছে। গরু ও মুরগির মাংস বিক্রির জন্যও আলাদা শেড করা হয়েছে। কৃষকদের জন্য বাজারব্যবস্থার পাশাপাশি ক্রেতাদের নানা সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে। বাজারের একপাশে একটি ফুড কোর্ট স্থাপন করা হয়েছে।
এই ফুড কোর্টে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫টি ফাস্ট ফুডের দোকান থাকবে। সাত হাজার স্কয়ার ফিটের একটি সুপারশপও করা হচ্ছে।
জানা গেছে, কয়েকজন উদ্যোমী উদ্যোক্তা মিলে কৃষকের বাজারটি বাস্তবায়ন করছেন। জায়গাটি আগামী ১০ বছরের জন্য ভাড়া নিয়েছেন তাঁরা। এরই মধ্যে বাজারের অবকাঠামো নির্মাণে প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
আগামীতে মিরপুর, হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় আরো তিনটি কৃষকের বাজার তৈরি করা হবে বলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে কৃষকের বাজারের (ফার্মার্স মার্কেট লিমিটেড) প্রধান উদ্যোক্তা মো. সুমন হাওলাদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা হলো ঢাকায় বাজার সিন্ডিকেট ভাঙা। এর পাশাপাশি কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। ভোক্তারা যাতে কম দামে ভালোমানের পণ্য পায় সেটিও নিশ্চিত করা হবে। এই বাজারে কৃষকের প্রায় ৫০০-এর মতো আড়ত থাকবে। এসব আড়তে পাইকারি দরে পণ্য বিক্রি করা হবে। পাশাপাশি এখানে খুচরাও বিক্রি করা হবে। একই সঙ্গে ক্রেতারা আমাদের অ্যাপস এবং ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনে অর্ডার করে ফ্রি ডেলিভারির পণ্য কিনতে পারবেন। ডেলিভারির জন্য ৫০টি নিজস্ব গাড়ি থাকবে। শতাধিক মোটরসাইকেল থাকবে। আমরা চাচ্ছি স্মার্ট বাজার ব্যবস্থাপনার দিকে যেতে, যাতে মানুষ খুব সহজে ভালোমানের পণ্য তার বাসায় বসে পেতে পারে এবং বাজারেও আসতে পারবে।’
তিনি বলেন, ‘খুচরা বিক্রেতাদের মালামাল আনতে কারওয়ান বাজার বা যাত্রাবাড়ী যেতে হয়। এখন আর এসব বাজারে যেতে হবে না। আমাদের অ্যাপসে ঢুকে এই পণ্যগুলো তারা ভিডিও দেখে খুব সহজেই কিনতে পারবে। পরবর্তী সময়ে আমরা নিজ দায়িত্বে তাদের দোকানে দোকানে পৌঁছে দেব। কিন্তু এখানে কোনো দাম ওঠানামা করবে না। যেমন—কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও বা যাত্রাবাড়ীসহ পাইকারি বাজারগুলোতে দাম ওঠানামা করে। এই বাজারে এটা করবে না। এতে ভোক্তারা স্বস্তি পাবে।
সুমন হাওলাদার আরো বলেন, ‘সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করে, তবে আমরা বাজারে সিন্ডিকেট ভেঙে দেব। আমরা ১৫ হাজার কৃষককে এবং সারা দেশের ১৮ হাজার পোলট্রি খামারিদের লিস্টেড করছি। বগুড়া, কুড়িগ্রাম, যশোর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জসহ যেসব পাইকারি বাজারে কৃষক পণ্য বিক্রি করে ওইখানে আমরা হাব খুলব। কিন্তু এখন আমরা সরাসরি কৃষকের পণ্য আনব। পরবর্তী সময়ে আমরা ১০ থেকে ১৫টা জেলায় হাব করব। ওই হাবগুলো যদি সরকার আমাদের সহযোগিতা করে তবে কৃষক ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করবে এবং ভোক্তারা ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে পারবে।’
কৃষকের বাজারের এই উদ্যোক্তা আরো বলেন, ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বর্তমানে ক্যাবের সভাপতি এ এইচ এম শফিকুজ্জামান স্যারের পরামর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা কৃষকের বাজারের উদ্যোগ নিয়েছি। তাঁর দিকনির্দেশনা আমাদের পথ দেখাচ্ছে, কিভাবে বাজারে সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে প্রান্তিক কৃষক ও খামারিদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা যায় এবং ভোক্তাদের জন্য স্বস্তি ফেরানো যায়। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই উদ্যোগই হবে উৎপাদক ও ভোক্তার মাঝে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের সেতুবন্ধ।’
জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাজারব্যবস্থাকে যদি কৃষকের অনুকূলে নেওয়া যায় তাহলে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ই লাভবান হবে। এই রকম একটি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রচেষ্টা চলছে। বিগত সরকারের আমলে রাজধানী ঢাকায় কৃষকের বাজার গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সরকারি আমলাতন্ত্রের জটিলতায় এটা তেমন কার্যকর হয়নি। এখন যদি বেসরকারি খাতে এ ধরনের কৃষকের বাজার গড়ে ওঠে, যেখানে কৃষকরা সরাসরি তাদের পণ্য নিয়ে আসতে পারবে, তাহলে একটা দক্ষ বাজারব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এই বাজারব্যবস্থাপনার সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানেরও সংযুক্ত থাকা দরকার। কারণ বর্তমানে সরকারের সহাযোগিতা ছাড়া এ রকম সরাসরি বাজারব্যবস্থা গড়ে তোলা খুবই ডিফিকাল্ট। এই উদ্যোগটি যদি সফল হয়, তাহলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। তাতে ভোক্তারা লাভবান হবে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকরাও লাভবান হবেন।’
কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই বাজারটি কৃষকের বাজার নামে পরিচিতি পাবে। এই উদ্যোগের মূল সুবিধাভোগী হবেন কৃষকরা। তাঁরা সম্মিলিতভাবে ১০ বা ১৫ জনের দল হিসেবে সরাসরি এখানে পণ্য নিয়ে আসার সুযোগ পাবেন। এর ফলে মাঝের কয়েক ধাপ কমে যাবে। এটি চালু হলে বাজারে স্বাভাবিকের চেয়ে কম দামে পণ্য পাওয়া যাবে, যার ফলে মানুষ কিনতে যাবে। এই বাজারে শুধু শাক-সবজিই নয়, কৃষকের উৎপাদিত অন্যান্য পণ্যও বিক্রি করা হবে। ক্রেতারা নিঃসন্দেহে একটু ভালো দামে ফ্রেশ জিনিস পেলেই বাজারে আসতে চাইবেন। বাজারে পাইকারি ও খুচরা উভয় ধরনের ক্রেতার জন্যই ব্যবস্থা থাকবে।’
সম্প্রতি ক্যাবের কার্যক্রম অবহিতকরণ বিষয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ক্যাবের নতুন এই সভাপতি বলেছেন, ‘৩০০ ফুট সড়কের পাশে একটি হাব চালু হতে যাচ্ছে। কারওয়ান বাজারের সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে চাই আমরা। সেখানে কৃষকরা সরাসরি তাঁঁদের সবজি বিক্রি করবেন। তাঁদের কাছ থেকে পণ্য কিনে নিয়ে সরাসরি বাজারে চলে যাবেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। ২০ টাকা বা তারও কমে আপনি সেখান থেকে সবজি কিনতে পারবেন। দেশে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন মূল্য যৌক্তিক নয়। শাক-সবজির উৎপাদন খরচ পাশের দেশের চেয়ে বেশি। বিপণনব্যবস্থাও ত্রুটিযুক্ত। ফড়িয়া থেকে আড়তদার, আড়তদার থেকে পাইকারি, পাইকারি থেকে খুচরা এভাবেই পণ্যের দাম বাড়ে।’
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, কারওয়ান বাজারের উত্তর গেট দিয়ে ৩০ টাকার পটোল প্রবেশ করে সেটি অন্য গেট দিয়ে পাইকারি বা খুচরা বাজারে যখন আসে, তখন দাম বেড়ে হয় ৭০ টাকা। আমি যে সবজি ১০০ টাকায় কিনছি, সেটির ৮০ টাকা যদি কৃষক পেতেন, তাহলেও আমার-আপনার কষ্ট হতো না। কিন্তু কৃষক তো পাচ্ছেন ৩০ টাকা। মাঝখানে আমি ভোক্তা সেই জিনিস ১০০ টাকায় কিনছি। ওই ৭০ টাকা তো পথে পথে চলে যাচ্ছে। উৎপাদন খরচ হ্রাস ও বিপণনব্যবস্থা আধুনিক না করতে পারার কারণে এমন সমস্যা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।