Image description

পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাতের মূলে রয়েছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কর্মকা-ের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির জন্য খ্যাত এই পাহাড়ি জনপদ। নিরাপত্তাহীনতায় থমকে গেছে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর তিন পার্বত্য জেলার উন্নয়ন-বিনিয়োগ। বিশেষ করে জুলাই বিপ্লবের পর ভারতের প্রত্যক্ষ মদদে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের রাষ্ট্রঘাতি কার্যকলাপ শুধু পাহাড়ের জনগোষ্ঠীর ওপরই নয়, বরং সমগ্র দেশের নিরাপত্তা সর্বোপরি জাতীয় অখন্ডতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সর্বশেষ মারমা কিশোরীকে কথিত ধর্ষণের অজুহাতে খাগড়াছড়িতে তাদের লাগাতার সহিংসতা দেশ-প্রেমিক সচেতন মহলকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে নির্মূলের দাবি উঠেছে। তারা একই সাথে পাহাড়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সেনা ক্যাম্প বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। পাহাড়ে এনজিওর আড়ালে খ্রিস্টানকরণ ও বিচ্ছিন্নতাবাদি অপতৎপরতা রোধে আরো কঠোর হওয়ার দাবিতে সোচ্চার হয়েছে বিভিন্ন মহল।

পাহাড়-পর্বত ও সবুজ বনজঙ্গলে ঘেরা অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমগ্র দেশের ভূখন্ডের এক-দশমাংশ এই পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের জন্য ভূ-রাজনৈতিক দিক দিয়ে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি অনাহরিত সম্পদের বিশাল ভান্ডার হিসেবেও সম্ভাবনাময়। কিন্তু এই অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদি সশস্ত্র গোষ্ঠীর অপকর্ম সবকিছুকে স্থবির করে দিয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার এক নজিরবিহীন অভ্যূত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর আধিপত্যবাদি ভারতের প্রত্যক্ষ মদদে পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা শুরু হয়। ইউপিডিএফসহ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো পার্বত্য অঞ্চলে মেতে উঠেছে সন্ত্রাস ও অরাজকতা সৃষ্টিতে।

স্থানীয়রা বলছেন, পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করে ১৯৯৮ সালে ২৬ ডিসেম্বর ইউপিডিএফ গঠিত হয়। এর পর থেকেই এই গোষ্ঠী পার্বত্য চুক্তির বিভিন্ন ধারা বাস্তবায়নের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। তারা নিজেদের ‘পার্বত্য জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের’ সংগঠন হিসেবে দাবি করলেও কার্যত তাদের কর্মকা- স্থানীয় জনগণের জন্য ভয়াবহ আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে প্রতিনিয়ত। চুক্তির পর শান্তি প্রতিষ্ঠার যে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল, ইউপিডিএফের চাঁদাবাজি, অপহরণ, গুম, অস্ত্রবাজি ও সহিংসতায় তা বারবার ব্যাহত হয়েছে। দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সুযোগে তারা ফের বেপরোয় হয়ে উঠেছে। কথায় কথায় সংঘাত-সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি তারা নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে।

জানা গেছে, সম্প্রতিক সময়ে খাগড়াাছড়ি ও রাঙামাটি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় রবিসহ মোবাইল টাওয়ার কোম্পানির কাছ থেকে বিপুল অংকের চাঁদা দাবি করে ইউপিডিএফ। দাবি পূরণ না হওয়ায় তারা টাওয়ার ধ্বংস, নেটওয়ার্ক ও বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া এবং অফিস ভাঙচুর করে। একইসাথে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী একাধিকবার বিপুল অস্ত্র চালান আটক করেছে, যা ইউপিডিএফ’র আন্তর্জাতিক অস্ত্র চোরাচালান নেটওয়ার্কে জড়িত থাকার প্রমাণ বহন করে। এছাড়া, সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে তাদের ৬টি ক্যাম্প রয়েছে। যা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে সংগঠনটি সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগসাজশ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে।

এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে খাগড়াাছড়ি ও গুইমারা এলাকায় ইউপিডিএফ এবং তাদের সহযোগী এবং অঙ্গসংগঠনসমূহ বিক্ষোভ, হরতাল, রাস্তা অবরোধ, হামলা এবং অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে অরাজকতা সৃষ্টি করে চলেছে। উক্ত ঘটনায় কর্মকর্তাসহ ১১ জন সেনা সদস্য আহত হয়েছেন। ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা নির্বিচারে বাঙ্গালীদের বাড়িÑঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজ চালিয়েছে। তারা নিজেদের বাড়িতে আগুন নিয়ে তার দায় বাঙ্গালী এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করেছে। তাদের এই অপকর্মে সহযোগী হয়েছে দেশের চিহ্নিত কিছু মিডিয়া হাউস। খাগড়াছড়ির স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এসব মিডিয়া একতরফা সংবাদ প্রচার করে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পক্ষ নিয়েছে। খাগড়াছড়িতে এক মারমা কিশোরীকে অপহরণ করা হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা খবর পেয়ে খুব কম সময়ে তাকে উদ্ধার করে।

এরপর দাবি করা হয়ে ওই কিশোরী গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাকে তাৎক্ষণিক মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য নেয়া হয়। কিন্তু পরীক্ষায় ধর্ষণের কোন আলামত পাওয়া যায়নি। অথচ কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়েছে এমন অভিযোগ তুলে তা-ব শুরু করে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা। তারা ‘জুম্ম ছাত্র-জনতার’ ব্যানারে অবরোধের নামে নৈরাজ্য আর পাহাড় থেকে সেনা প্রত্যাহারের দাবিতে পুরো খাগড়াছড়িকে কার্যত জিম্মি করে ফেলে। তাদের হয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংগঠন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিষোধগার শুরু করে। চলে তথ্য সন্ত্রাস। নিরাপত্তাবাহিনীর ওপর আক্রমনের উসকানি দেওয়া হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন মিডিয়ায়। দেশের চিহ্নিত ওইসব মিডিয়াও তাদের সাথে দেশবিরোধী কোরাসে শরিক হয়।

তারা সন্ত্রাসীদের অপকর্ম আড়াল করে উল্টো বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে। সন্ত্রাসীরা সেখানে বাঙ্গালীদের বাসা-বাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জ¦ালিয়ে দেয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন মসজিদ মাদরাসায় আগুন দেয়। এসব খবর এড়িয়ে যায় ওইসব মিডিয়া। পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা ঘোষণা নিয়ে সেনাবাহিনীর টহল দলসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। রক্তাক্ত আহত হন সেনা ও পুলিশ সদস্যরা। অথচ ওইসব মুখচেনা মিডিয়া আধিপত্যবাদী শক্তির ইশারায় শুধু কিছু সন্ত্রাসীকে হামলার শিকার হিসাবে তুলে ধরে। পাহাড়িদের নিয়ে কথিত মানবিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে তারা মূলত ভারতীয় এজেন্ডা অনুযায়ী পাহাড়ে সংঘাত সৃষ্টির নীলনকশা প্রনয়ণ করে। কিন্তু দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনী এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দৃঢ় সংযম ও মানবিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিহত করে। স্থানীয়রা বলছেন, এর পরও ইউপিডিএফসহ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো তাদের অপকর্ম থেকে ফিরে আসেনি। তারা অবরোধের নামে তা-ব চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের নিষিদ্ধ না করা পর্যন্ত এই অপকর্ম থামবে না এবং পাহাড়ে শান্তি ফিরবে না। তারা আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে আরো নাশকতামূলক অপকর্মে জড়াতে পারে।

এদিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ইউপিডিএফ পরিকল্পিতভাবে পাহাড়ে সংঘাতময় পরিস্থিতি জিইয়ে রাখছে। যে কোন অজুহাতেই তারা মাঠে নামছে। তারা নিজেদের মধ্যেও সংঘাত-সহিংসতায় জড়িয়ে খুনোখুনিতে মেতে উঠছে। গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চালক মামুন হত্যাকে কেন্দ্র করে ইউপিডিএফ মূল এবং অঙ্গসংগঠনসমূহ দীঘিনালা ও রাঙামাটিতে সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। উক্ত ঘটনায় ১১ জন সেনাসদস্য আহত হয়। গত ২৪ জুন রাঙ্গামাটি জোনের আওতাধীন কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের কড়ইছড়ি এলাকায় ইউপিডিএফ (মূল) দলের সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর টহল দলকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। ওই ঘটনায় সৈনিক মো. তারিকুজ্জামান খান বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলে গুলিবিদ্ধ হন। পরবর্তীতে টহল দলের সদস্যরা ঘটনাস্থলে তল্লাশি চালিয়ে তিনজন সন্ত্রাসীকে আটক এবং একটি এসএমজি, একটি ম্যাগাজিন, ৪৭ রাউন্ড এ্যামোনিশনসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি উদ্ধার করে।

সন্ত্রাসের ধারাবাহিকতায় গত ১৫ বছরে ইউপিডিএফ মূলের সশস্ত্র সদস্যদের আন্তঃদলীয় কোন্দলে ২৮ নিহত, ৬০ জন আহত হয়েছেন। আঞ্চলিক দলের সাথে গুলি বিনিময়ের ঘটনায় ১২৪ জন নিহত, ৪২ জন আহত হয় এবং বিভিন্ন সময় ৩৩২ জনকে অপহরণ এছাড়াও নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে ২৭ বার গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। উল্লেখ্য দলটি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতি বছর আনুমানিক ৩০৫ কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে থাকে।

ইউপিডিএফ এবং তার অঙ্গসংগঠনসমূহের সশস্ত্র কর্মকা- অঞ্চলটির স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক অবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। চাঁদাবাজি, অপহরণ, গুলি বিনিময়, হামলা এবং সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক কার্যক্রম তাদের নিয়মিত কর্মকা- হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বিগত দেড় বছরে বিভিন্ন সংঘর্ষ ও অরাজকতার ঘটনা প্রমাণ করে তারা পার্বত্য অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার উদ্দেশ্যে সুপরিকল্পিত কর্মকা- চালাচ্ছে।

অপরদিকে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অপকর্মের সাথে কিছু এনজিওর কর্মকা- পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলছে। অভিযোগ রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক (যাদের অধিকাংশই পশ্চিমা) এনজিও, দাতব্য সংস্থা ও খ্রিস্টান মিশনারীদের কার্যক্রম আশঙ্কাজনক রূপ নিয়েছে। তারা উন্নয়নের বদলে সেখানকার বাসিন্দা বিশেষ করে উপজাতীয়দের খ্রিস্টান ধর্মে দিক্ষিত করছে। স্থানীয়দের অভিযোগ তাদের মূল লক্ষ্য সেখানে একটি খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাফার স্টেইট গঠন করা। পার্বত্য চট্টগ্রামে কয়েকশ এনজিও ও খ্রিস্টান মিশনারী সংগঠন সক্রিয় রয়েছে, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে খ্রিস্টানকরণের পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। বিভিন্ন ইসলামি সংগঠনের নেতারা এসব এনজিওর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করারও দাবি তুলেছেন। তারা একই সাথে জাতীয় অখন্ডতা রক্ষায় পার্বত্য জেলা থেকে চুক্তির পর তুলে নেয়া সেনা ক্যাম্প দ্রুত পুনঃস্থাপনেরও দাবি জানিয়েছেন।