
ড. মোস্তাফীজুর রহমান খান
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি বাংলাদেশের গণমানুষের ব্যাংক। এ ব্যাংকের শেকড় মাটির অনেক গভীরে প্রোথিত। ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তার কিঞ্চিতও যদি অন্য কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে নেয়া হতো তাহলে হয়তো সেই ব্যাংকের অস্তিত্বই থাকতো না। ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারী থেকে বৃহৎ সঞ্চয়কারী, ক্ষুদ্র বিনিয়োগ থেকে বৃহৎ বিনিয়োগ গ্রহীতার আশ্রয়স্থল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠায় ইসলামী ব্যাংকের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। এ ব্যাংকটি বাংলাদেশে কল্যাণমুখী, ভারসাম্যপূর্ণ ও ইসলামী ধারার ব্যাংকব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় পথিকৃৎ হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। সবদিক বিবেচনায় এ ব্যাংকের সাফল্য আকাশচুম্বী। এসব নানাবিধ সফলতার কারণে পৃথিবীর সেরা ১০০০ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শক্ত অবস্থান করে নিতে পেরেছিল। তবে এ আকাশচুম্বী সফলতাই ইসলামী ব্যাংকের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও ইসলাম বিদ্বেষীরা উঠেপড়ে লাগে এ ব্যাংকটি ধ্বংস করার জন্য। প্রথমে তারা এ ব্যাংকটির বিরুদ্ধে মিথ্যা জঙ্গি লেনদেনের তকমা দিয়ে ব্যাংকের ভিত দুর্বল করার চেষ্টা করে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার সুরে সুর মিলিয়ে কিছু চিহ্নিত ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে ব্যাংকটি ধ্বংস করার জন্য। কিন্তু দেশের জনগণ তাদের এ মিথ্যা বয়ান গ্রহণ করেনি। ফ্যাসিস্ট হাসিনা জঙ্গি নেরেটিভে ব্যর্থ হয়ে ‘শাহবাগী’দের ব্যবহার করে ব্যাংক ধ্বংস করার জন্য। প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় সারা দেশব্যাপী মিছিল-মিটিং শুরু করে ব্যাংকের বিরুদ্ধে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব বিভাগ, জেলা ও উপজেলা শহরে চলে নিরবচ্ছিন্ন মিছিল ও মাইকিং। শাহবাগীরা ভাংচুর শুরু করে ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা ও এটিএম বুথ। প্রশাসন ছিল নির্বিকার। সরকারের সিডিউলভুক্ত একটি ব্যাংক, সবচেয়ে বেশি করদাতা একটি ব্যাংকে প্রশাসনের নাকের ডগায় ‘শাহবাগী’রা ভাংচুর চালায় কিন্তু প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, বিষয়টি ছিল ভাবিয়ে তোলার মতো। ব্যাংকের তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ, শেয়ার হোল্ডার, ডিপোজিটর ও কর্মকর্তারা নিরবে চোখের পানি ফেলতো কিন্তু ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার প্রশাসনের কাছে সবাই ছিল জিম্মি। ‘শাহবাগী’দের এ ঘৃণ্য অপতৎপরতায় ইসলামী ব্যাংক সাময়িকভাবে বেকায়দায় পড়ে যায়। ব্যাংক থেকে ডিপোজিট তোলার হিড়িক পড়ে যায়। ব্যাংকটি অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ার ভয়ে ঘটনাক্রমে অন্যান্য ব্যাংকের কয়েকটি শাখা ও এটিএম বুথও ভাংচুর করে দুষ্কৃতিকারীরা। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের টনক নড়ে। ওই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এই মর্মে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে যে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হামলা করলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এর নিরাপত্তা বিধান করবে। অতীব দুঃখের বিষয় যখন শুধু ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি ভাঙ্গা হচ্ছিল তখন কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এমন পরিপত্র জারি করেনি। বরং জনতা যখন অন্যান্য ব্যাংকও আক্রান্ত হলো তখন ওই পরিপত্র জারি করেছিল। যাহোক এ যাত্রায়ও ব্যাংক রেহাই পায় এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও ‘শাহবাগী’দের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে ডিপোজিটরদের ভুল ভাঙে। যেভাবে ডিপোজিটররা লাইন ধরে টাকা তুলে নিয়েছিল ঠিক সেভাবে লাইন ধরে টাকা জমা দেয়। ইসলামী ব্যাংক আবার প্রাণ-চাঞ্চল্য ফিরে পায়। কিন্তু এ সুখ বেশি দিন ইসলামী ব্যাংকের স্থায়ী হয়নি। ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবার আরো ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা নিয়ে সামনে অগ্রসর হয়।
ফ্যাসিস্ট হাসিনা ইসলামী ব্যাংককে কৌশলে সমূলে ধ্বংসের তৃতীয় পদক্ষেপ শুরু করে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা চট্টগ্রামের শিল্পপতি মাফিয়া চক্রের হোতা এস আলম গ্রুপের হাতে তুলে দেয়। ব্যাংকটি দখল করার জন্য ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থাকে। ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা আনোয়ার, পরিচালনা পর্ষদ সদস্যবৃন্দ ও তৎকালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর আব্দুল মান্নানকে অবরুদ্ধ করে জোরপূর্বক পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নেয় এবং লুটেরা ও ডাকাত এস আলমের হাতে তুলে দেয়া হয়। দখলের পর থেকে শুরু হয় অবিরাম লুটপাট। এই লুটপাটের সহযোগী হয় এস আলমের অনুগত উচ্ছিষ্টভোগী দালাল পরিচালনা পর্ষদ ও তাদের সহযোগীরা।
page-top-ad
ব্যাংক ডাকাতির জন্য এমন কিছু কৌশল আবিষ্কার করে যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। ডাকাত, ডাকাতি করতেও কিছু নীতি মেনে চলে, এখানে তাও মেনে চলা হয়নি। পরিচালনা পর্ষদ সব অপকর্মের অনুমোদন দেয় অর্থাৎ কোনো রকম সিকিউরিটি ছাড়া বিভিন্ন নামসর্বস্ব কোম্পানির নামে ঋণ অনুমোদন করে। ব্যাংকের তৎকালীন এমডি মো: মাহবুবুল আলম ও মুহাম্মদ মনিরুল মওলা লুটপাটের জন্য ব্যাংকের ভোল্ট খুলে দেয়। আকিজ, মিফতাহ, সাব্বির, কায়সার, রেজাউল, খালেদ মুহাম্মদ রায়হান, মমতাজ উদ্দিন, মোস্তাকসহ একদল দালাল অফিসার ভল্ট থেকে বস্তা বোঝাই টাকা কাঁধে করে এস আলমের অফিসে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করে। চলে বিরামহীন লুটপাট। লুটপাটের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে তা দূর করতেও বাংলাদেশ ব্যাংক সহায়তা করে। এ লুটপাটে তারাও ভাগ বসায়। ফ্যাসিস্ট হাসিনা, পুত্র জয় ও বোন রেহানা পেয়ে যায় আলাদিনের চেরাগ। ইসলামী ব্যাংক প্রাইভেট সেক্টরে সবচেয়ে বড় ব্যাংক হওয়ার কারণে বড় ধরনের লুটপাটে কোনো বেগ পেতে হয়নি। কোন দেশে কত ডলার, কখন, কোন ব্যাংকে পাচার করতে হবে তা শুধু নির্দেশের অপেক্ষা, পাচারে কালক্ষেপণ হতো না। লুটপাটের ভাগ হাসিনা পরিবারকে দেয়ার বিনিময়ে লুটেরা এস আলম হাসিনা সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা পেত। এমনকি হাইকোর্ট থেকে রুলনিশি জারি করা হলো এ মর্মে যে, এস আলমের অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত করা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারি দুটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এমনভাবে সহযোগিতা করতো মনে হতো এসব প্রতিষ্ঠান এস আলমের নির্দেশনায়ই চলে। এভাবে লুটপাট করার কারণে বিশ্ব দরবারে ১০০০টি সেরা ব্যাংকের ভেতর জায়গা করে নেয়া বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ব্যাংকটিকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি থেকে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা লুট করে নিয়ে যায় এবং ৮ হাজার অপদার্থ অযোগ্য লোকবল তার নিজ উপজেলা পটিয়া থেকে নিয়োগ দেয়।
৫ আগস্ট ২০২৪ বিপ্লবের পর ব্যাংকটি ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও মাফিয়া চক্র এস আলমের রাহুমুক্ত হয়। কিন্তু ব্যাংকের যে সর্বনাশ করে গেছে তা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লেগে যাবে। যুগান্তকারী অনেক পদক্ষেপ নিতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য জুলাই বিপ্লবের পর ১৪ মাস অতিবাহিত হলেও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ তাইরে-নাইরে করে সময় কাটিয়েছে। ব্যাংকটি উদ্ধারের জন্য প্রথমে উবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদকে চেয়ারম্যান করে বোর্ড গঠন করে কিন্তু সে এস আলমের ইশারায় চলতো বলে তার সার্বিক কার্যক্রমে মনে হয়েছে। ফলে তার এক বছর সময়ে ব্যাংকের স্বার্থে কিছুই করেনি; বরং দুর্নীতির মাধ্যমে আখের গুছিয়েছে। এরপর প্রফেসর জোবায়দুর রহমানকে চেয়ারম্যান করা হয়েছে প্রায় দুই মাস হয়ে গেল। কিন্তু এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ব্যাংকের প্রতি অকুণ্ঠ ভালোবাসার কারণে দেশের জনগণ বেশুমার ডিপোজিট দিচ্ছে। তাদের দায়িত্ব তারা পালন করলেও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বিশেষ কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান হচ্ছে না। অথচ এমন কিছু পদক্ষেপ আছে যা এখনই নেয়া দরকার। এমন কিছু উপায়-উপকরণ আছে যা এখনই কাজে না লাগালে অথবা বাস্তবায়ন না করলে ব্যাংকটিকে পুনরায় শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করানো কিংবা হারানো এর গৌরব পুনরুদ্ধারও সম্ভব হবে না। সেগুলো হচ্ছে-
ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও এস আলম মাফিয়া চক্র পালিয়ে যাওয়ার বয়স ১ বছর ২ মাস হলেও ইসলামী ব্যাংকের ৮২ শতাংশ শেয়ার এস আলম মাফিয়া চক্রের হাতেই রয়ে গেছে। অতি দ্রুত এই শেয়ারগুলো বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে ব্যাংকের দায় শোধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে ১ লাখ কোটি থেকে অন্তত ৬ হাজার কোটি টাকা (আনুমানিক) পরিশোধ হবে। যদি এস আলমের শেয়ার বিক্রির ব্যবস্থা না নেয়া হয় তাহলে ব্যাংকের আলটিমেট মালিকানা এস আলমের হাতেই থেকে যায়, যা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ব্যাংকের জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। কারণ একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের একজন নেতার আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে সে এখনো ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তার গাড়ি ব্যবহার থেকে শুরু করে বিভিন্ন আর্থিক সুযোগ-সুবিধা সে ভোগ করে আসছে যা জাতীয় দৈনিক ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশবাসী জানতে পেরেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির পরিচালনা পর্ষদ কী কারণে এস আলমের শেয়ার বিক্রি করছে না তা এ দেশের সাধারণ জনগণের কাছে বোধগম্য নয়। এস আলম কোন আইনের মাধ্যমে ব্যাংকের ১ লাখ কোটি টাকা লুটপাট করেছে? কোন আইনের মাধ্যমে ডিজিএফআই তৎকালীন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের জোরপূর্বক স্বাক্ষর নিয়ে এস আলমের হাতে তুলে দিয়েছিল? এস আলম, তার স্ত্রী-পুত্র-পরিজন, যাদেরকে বিভিন্ন কোম্পানির পক্ষ থেকে ব্যাংকের পরিচালককরা হয়েছিল তাদের এবং লুট করার জন্য নামসর্বস্ব কোম্পানিতে যাদেরকে মালিক বানানো হয়েছিল তাদেরকে আদালতের মাধ্যমে আজীবনের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আযোগ্য ও অবাঞ্চিত ঘোষণা করতে হবে।
বর্তমানে ব্যাংকের পরিচালনগত ব্যয় অনেক বেশি। ব্যাংকে প্রায় ৩৫ শতাংশ লোকবল অতিরিক্ত আছে। যাদের কোনো উল্লেখযোগ্য আউটপুট নেই। এদের অধিকাংশ অযোগ্য ও অথর্ব। কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই এদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই নিয়োগকৃতদের মধ্যে ৮ হাজার জন একই উপজেলার বাসিন্দা। এদেরকে ছাটাই না করলে এই বিশাল লোকবল নিয়ে ব্যাংকের পথচলা অসম্ভব। তাই অতিসত্বর এদেরকে ছাঁটাই করতে হবে। এদেরকে ছাঁটাই করলে ব্যাংক প্রতি মাসে বিশাল অংকের খরচের হাত থেকে রেহাই পাবে। তাছাড়া এদের আচার-আচরণ এবং ইসলামী ব্যাংকে চর্চিত করপোরেট কালচারে এরা এখনো নিজেদের অভ্যস্ত করে তুলতে পারেনি। ফলে এদের কারণে ব্যাংকের সুনামও ক্ষন্ন হচ্ছে।
ইসলামী ব্যাংকের গর্বের প্রতীক ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের পার্শ্ববর্তী ৫২ কাঠা জমি, যার হোল্ডিং নম্বর ১৯৬, মতিঝিল, ঢাকা-১০০০। এই জায়গা বিক্রির জন্য জাতীয় দৈনিকে নিলাম বিজ্ঞপ্তি দিলে সর্বোচ্চ ৫৮০ কোটি টাকার দরপত্র দাখিল হয় কিন্তু জমিটি ১১০ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেয়। মতিঝিলের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে লাগোয়া জায়গাটি বিক্রি করে দেয় নামমাত্র মূল্যে এবং নিয়ম ভঙ্গ করে। জানা গেছে- এই মাফিয়া চক্র অবৈধ, অন্যায়, দুর্নীতি ও লুটপাট করার উদ্দেশ্যে এই জায়গাটি বিক্রি করে দিয়েছে। অতিসত্বর এই জায়গা বিক্রির দলিল বাতিল করে ইসলামী ব্যাংকের হাতে ফেরত দিতে হবে। উল্লেখ্য, এ সংক্রান্ত সকল নথি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ডিভিশনে রক্ষিত আছে।
এস আলমের ঋণের বিপরীতে প্রদত্ত সিকিউরিটি, ব্যাংকের ক্রয়কৃত শেয়ার এবং ইতোমধ্যে এস আলমের যেসব সম্পদ আদালতের মাধ্যমে এ্যাটাচমেন্ট করা হয়েছে তা খুবই অপ্রতুল। উপরিউক্ত সবকিছু মিলে এক তৃতীয়াংশ দায়ও শোধ হবে না। ইসলামী ব্যাংক ভবিষ্যতে যাতে তার প্রদত্ত ঋণ আদায় করতে পারে এ জন্য ‘বাঁশখালী পাওয়ার প্লান্ট’ আদালতের মাধ্যমে এ্যাটাচমেন্ট করতে হবে। যদিও জনতা ব্যাংকের কিছু ঋণ সেখানে দেয়া আছে কিন্তু উক্ত পাওয়ার প্লান্টের মেশিনারিজ ক্রয়ের জন্য ইসলামী ব্যাংকের কোটি কোটি ডলার হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করে সেই ডলার দিয়ে ক্রয় করা হয়েছে। আইনি জটিলতা থাকলে তা আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে দ্রুত এ ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫ আগস্ট ২০২৪ বিপ্লবের পর লুটেরা এস আলম গং ইসলামী ব্যাংকের দালাল অফিসারদের মাধ্যমে বিভিন্ন শাখায় পরিচালিত বিভিন্ন চলতি হিসাবের টাকা অতি দ্রুত তুলে নিয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় Top Ten Trading House-এর নামে পরিচালিত, চলতি হিসাব নং ৪৩৪৫, খাতুনগঞ্জ শাখা-এর ৫৪৪ কোটি টাকা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। এই ঘটনাটি ইসলামী ব্যাংকের অফিসারদের দৃষ্টিগোচর হলে তারা তা বাধা দেয়। তৎকালীন এমডি মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা টাকা দেয়ার জন্য প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে কিন্তু আন্দোলনকারীদের প্রচণ্ড বাধার মুখে তা নিতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে এই টাকা দিয়ে এস আলমের দায় শোধ করা হলেও অদৃশ্য কারণে এই টাকা রিভার্স করে পুনরায় উক্ত হিসাবে দেয়া হয়েছে। অতিদ্রুত এই টাকা দিয়ে এস আলমের দায় শোধ করার ব্যবস্থা করা হোক। এই টাকার উৎস কী তা হিসাবধারীর কাছে জিজ্ঞাসা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলা করে রিমান্ডে নিলেই সব তথ্য বের হয়ে যাবে। একটি সূত্র থেকে জানা গেছে- এস আলমের দালাল আকিজ উদ্দিন এই হিসাব অন্যের মাধ্যমে পরিচালনা করতো। ১৪ মাস গত হলেও বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে যা অত্যন্ত পরিতাপের! আগামী ১ মাসের মধ্যে বিষয়টি সুরাহা করে উক্ত টাকা দিয়ে এস আলমের দায় শোধ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
যাদের নিকট থেকে জোরপূর্বক ও অবৈধভাবে ব্যাংক দখল করা হয়েছিল তাদেরকে ওই সময়ের বাজার মূল্যে সমপরিমাণ শেয়ার ফেরত দিতে হবে। এক্ষেত্রে আইনের দোহাই দেয়া যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ওই সময়ে অবৈধ পরিচালনা পর্ষদকে বৈধতা দিয়েছিল এখন সেই অবৈধকে তা অবৈধ ঘোষণা করলে তখন যারা বৈধ ছিল তারা তাদের অধিকার ফিরে পাবে। এর জন্য আলাদা কোনো আইনের প্রয়োজন নেই। মুন সিনেমা হলের দৃষ্টান্ত জাতির সামনে এখনো দেদীপ্যমান।
লুটেরা এস আলমকে যারা লুটপাটে স্বপ্রণোদিত হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহযোগিতা করেছে এবং প্রমোশনসহ অবৈধ সুযোগ সুবিধা নিয়েছে তাদেরকে চাকরিচ্যুত করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
এস আলম কর্তৃক যে সমস্ত সিকিউরিটি দেয়া আছে এবং আদালতের মাধ্যমে ইতোমধ্যে যা কিছু এ্যাটাচমেন্ট করা হয়েছে তা অতি দ্রুত নিলাম বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। যদি বিক্রি না হয় তাহলে অর্থঋণ আদালতে দ্রুত মামলা করতে হবে। এরপরও বিক্রি সম্ভব না হলে ব্যাংকের নামে তা রেজিস্ট্রি করে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা পরিহার করার জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করে স্পেশাল ট্রাইবুনালের ব্যবস্থা করতে হবে।
এস আলম লুটেরা গ্রুপকে ব্যাংকের প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা বাই মুরাবাহা (প্লেজ) পদ্ধতিতে বিনিয়োগ দেয়া হয়েছে যার ১ টাকার পণ্যও ব্যাংকের কাছে নেই। এই বিনিয়োগের অধিকাংশ তৎকালীন এমডি মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা তথাকথিত বোর্ডকে পাশ কাটিয়ে একতরফভাবে দিয়েছেন। অথচ ব্যাংকের বিদ্যমান নীতি অনুযায়ী তিনি সর্বোচ্চ মাত্র ১ কোটি টাকা ফান্ডেড এবং ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত নন ফান্ডেড বিনিয়োগ দিতে পারেন। লুটপাটের সহযোগিতা করে অবৈধ সুবিধা নেয়ার জন্য তিনি এই অপকর্ম করেছেন। তৎকালীন এমডি মুহাম্মদ মুনিরুল মওলাসহ যারা এই অপকর্মের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এর মধ্যে এখনো অনেকে চাকরিতে বহাল আছে তাদেরকে অতি দ্রুত চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে। উল্লেখ্য, এ সংক্রান্ত সকল ডকুমেন্ট ব্যাংকের করপোরেট ইনভেস্টমেন্ট ডিভিশন-১ এ বিদ্যমান রয়েছে।
মানি লন্ডারিং-এর মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা যেসব দেশে পাচার হয়েছে সেসব দেশ থেকে টাকা উদ্ধার করে তা দ্বারা এস আলমের ঋণ শোধের ব্যবস্থা করতে হবে।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি থেকে এই লুটপাটের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকও কম দায়ী নয়। নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজলে তা সবার কাছে স্পষ্ট হবে। লুটের জন্য তারা অবৈধ বোর্ডকে কেন বৈধতা দিয়েছিল? লুটপাটকে সহজ করার জন্য প্রতিনিয়ত ব্যাংকের বিভিন্ন নিয়ম পরিবর্তন তারা কেন করেছিল? ব্যাংকের পক্ষ থেকে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক বিভিন্ন স্টেটমেন্ট সরবরাহ করা হতো যাতে এই লুটের তথ্যগুলো ছিল, তখন কেন তারা এর লাগাম টেনে ধরেনি? বাংলাদেশ ব্যাংক রেগুলেটরি ব্যাংক হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকের শাখাগুলো অডিট করে থাকে। লুটেরাদের কোন চিত্র ওই সময়কালে কেন তাদের রিপোর্টে আসেনি? ফ্যাসিস্টের আমলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির জেনারেল একাউন্ট হাজার হাজার কোটি টাকা নেগেটিভ ব্যালেন্স রেখে ক্লিয়ারিং চেক পাস করেছে কেন? যদি তারা নিয়ম মেনে সব করে থাকে তাহলে গভর্নর পালালো কেন? যদি বাংলাদেশ ব্যাংক এ সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে না পারে তাহলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির এই পরিস্থিতির জন্য তারা দায় এড়াতে পারে না। আর যদি দায় এড়াতে না পারে তাহলে ৫ আগস্ট ২০২৪ এর পর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির সিআরআর ঘাটতির জন্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা জরিমানা আরোপ করা হলো কেন? এই ঘাটতি তো ৫ আগস্ট ২০২৪ এর পরের অবস্থার কারণে হয়নি; বরং ৫ আগস্ট ২০২৪ এর পূর্বের অপকর্মের ফসল। প্রকৃতপক্ষে এই জরিমানা ইসলামী ব্যাংকের জন্য ছিল মরার ওপর খাড়ার ঘা। যেহেতু ইসলামী ব্যাংকের এই পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকও সমভাবে দায়ী সুতরাং ব্যাংকের বিরুদ্ধে যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা অনৈতিক, অযৌক্তিক ও অন্যায়। তাই জরিমানার এই টাকা ইসলামী ব্যাংকে ফেরত দেয়া হোক।
যেহেতু ইসলামী ব্যাংকের এই পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকও সমানভাবে দায়ী তাই এই ব্যাংক তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য ১৫ বছরের একটি বেইল আউট সুযোগ দিতে হবে। অর্থাৎ বিগত ২০১৭ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত লুটেরা এস আলম ও তার সহযোগীদের নামে বেনামে যত কুঋণ দেয়া হয়েছে তার বিপরীতে কোনো প্রভিশন রাখতে হবে না। কমপক্ষে ৩০ হাজার কোটি টাকা আগামী ৫ বছরের জন্য কষ্ট ফ্রি ডিপোজিট দিতে হবে। ২০ হাজার কোটি টাকা দীর্ঘ মেয়াদী (১০ বছরের জন্য) লো কষ্ট ফান্ড দিতে হবে। ১০ হাজার কোটি টাকা (১৫ বছরের জন্য) বিশেষ সুদ মুক্ত তহবিল সরবরাহ করতে হবে। তাছাড়া উপরিউক্ত প্রায় সবগুলো বিষয় বাস্তবায়ন বা কার্যকর করার জন্য রেগুলেটরি ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা লাগবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সহযোগিতাগুলো করে ব্যাংকটিকে পূর্বের অবস্থায় ফিরে দিয়ে দায়মুক্ত হবে এটাই জাতির প্রত্যাশা।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি এদেশের গণমানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। এ দেশের গণমানুষের হৃদয়ের স্পন্দন। এদেশের মাটি ও মানুষের ব্যাংক। এদেশে কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারার প্রবর্তক। এই ব্যাংকটি তার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করুক এটি সবার হৃদয়ের কথা। যারা এই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আছেন তাদেরকে এ বিষয়গুলো মাথায় নিয়েই দায়িত্ব পালন করা উচিত। অন্যথায় এ জাতি তাদের ক্ষমা করবে না। উপরিউক্ত বিষয়গুলোর প্রত্যেকটি যেহেতু ব্যাংকের অস্তিত্ব রক্ষা ও ঘুরে দাঁড়ানোর সাথে জড়িত তাই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এগুলো বাস্তবায়ন বা কার্যকর করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও শিল্পায়নের জন্য ইসলামী ব্যাংকের অবদান অনেক বেশি। দেশের উন্নয়নের জন্যই এ ব্যাংকের প্রয়োজন। জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে বাস্তবায়নের জন্যই এ ব্যাংকের টিকে থাকা অপরিহার্য। উপরিউক্ত বিষয়গুলোর ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করুক- এটাই এ জাতির সর্বস্তরের জনগণের কামনা।
লেখক : সাবেক সিনিয়র প্রিন্সিপ্যাল অফিসার, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি