
২৩০৮ ভোটের গ্রাম কাটাখালী। ৭৫১ পরিবারের বসবাস। অধিকাংশই কৃষক, দিনমজুর, শ্রমিক। গ্রামে একটি মাত্র স্কুল। কাটাখালী উমর আলী উচ্চ বিদ্যালয়। একটু দূরেই কাটাখালী বাজার। শতবছরের পুরনো এই বাজারে আশপাশের ৫ গ্রাম সোনাখালী, পাজলারচর, চৌপাগারিয়া, মৈশাটিকির লোকজন নিয়মিত জড়ো হন। কেনাকাটা, ফসল বিক্রি ও বাজার সদাই করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কাটাখালী বাজারে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। প্রবল যুদ্ধে ৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়। এজন্যই বাজারটি বেশি সুপরিচিত। প্রতিদিন বিকালে কাটাখালী বাজারে চায়ের আড্ডা বসে। শতশত মানুষের আনাগোনা। যেন ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের মিলনস্থল কাটাখালী বাজার। ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলা সদর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরের এই বাজার। সরু রাস্তায় যাতায়াতের একমাত্র বাহন অটোরিকশা।
বৃহস্পতিবার বিকাল- এ বাজার তখন লোকে লোকারণ্য। বাজারে ঢুকেই রাজনীতির চিরাচরিত আড্ডাখানা চায়ের দোকানগুলোতে ভিড়। আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিয়ে গ্রামীণ জনপদের ভোটারদের ভাবনা কি? বাজারের পূর্বপাশে আলম উদ্দিনের চায়ের দোকান। সেখানে গল্পে মজেছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব ১০ থেকে ১২ জন ব্যক্তি। তাদের আলোচনার বিষয় নির্বাচন, রাজনীতি। স্কুল শিক্ষক মোসলেহ উদ্দিন বলেন, আমার ধারণা এই সরকার নির্বাচন ঠিক সময়ে দিবে না। তারা শুধু নির্বাচনের আশা দেখাচ্ছে। আসলে তাদের মনে আরও বেশিদিন ক্ষমতা ধরে রাখার ইচ্ছা। আর দেশের এই অরাজক পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তারা এখনো নির্বাচনের কোনো পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি।
হায়দার আলী নামের আরেক ব্যক্তি তখন বলে ওঠেন, গত ১০ মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলো মিটিং করছে। ঐকমত্যের মিটিং। কিন্তু ফলাফল জিরো। তারা নিজেরাই এখনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি। তাহলে নির্বাচন হবে কীভাবে? বিএনপি চায় দ্রুত নির্বাচন। আর জামায়াত ও ছাত্রদের দল চায় পিআর। আমি টিভিতে প্রতিদিন পিআর পদ্ধতির গল্প শুনি। মোবাইলেও দেখি। কিন্তু এটা আসলে কি এখনো বুঝতে পারলাম না। বাজারে রাজনীতি যারা বোঝে তাদের কাছেও পিআর কি জানতে চাইছি। কেউ কইতে পারে না। আর জামায়াত ইসলাম এইটা নিয়েই পড়ে আছে। আমরা পিআর টিআর বুঝি না। চাই দ্রুত ভোট হোক। নির্বাচিত সরকার আসলে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। জামায়াতের কাজ কর্ম দেখে মনে হয়না, তারা নির্বাচন চায়। তারা নির্বাচনে যেতে ভয় পাচ্ছে। কারণ তাদের ভোট নাই। বিএনপি’র কিছু লোক চান্দাবাজি করে দলকে ডুবিয়েছে। তাদেরও একটি অংশ ভোট করতে ভয় পাচ্ছে। দেখা যাক কি হয়।
সন্ধ্যায় ধানীখোলা ইউনিয়ন থেকে ফিরে ত্রিশাল ইউনিয়নের রাগামারা বাজারে একটি চায়ের দোকানের চিত্রও একই। সেখানে আলাপকালে আজাদ মুন্সী নামের এক ব্যক্তি বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে, এটা একটা নাটক। সরকার কখনো ঠিক সময়ে নির্বাচন দিবে না। আমাদের এলাকায় বিএনপি-আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো দলের মানুষ নাই। তাহলে বিএনপিকে টেক্কা দিবে কে? মাঝেমধ্যে জামায়াতের কিছু লোক আসে, এটা ওটা দিবে বলে চলে যায়। আমরাও চাই নির্বাচন তাড়াতাড়ি হোক। দেশ স্বাভাবিক হোক। প্রথমে ভেবেছিলাম ছাত্রদের নতুন দল ভালো করবে। ফেসবুকে দেখি তারাও একই। তাদের মধ্যে ঐক্য নেই।
উপজেলার হিন্দু অধ্যুষিত কাঁঠাল ইউনিয়নের বানিয়াধলা গ্রামের মাদ্রাসা শিক্ষক মাওলানা মো. মানিক আলম সরদার বলেন, এই অবস্থায় নির্বাচন দিলে বিএনপিকে কোনো ভাবেই আটকে রাখা যাবে না। বিএনপি’র সঙ্গে টিকতে হলে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দলই মাঠে থাকতে পারবে না। ঢাকা আর গ্রাম এক না। আমাদের গ্রামে বিএনপি ছাড়া অন্য কোনো দল ৫০ ভোটও পাবে না। গ্রামের লোকজন এনসিপি, জামায়াত, হাতপাখা কাউকেই চিনে না। তাহলে ভোট দিবে কেমনে। আর জামায়াত কিছু ভোট পেতে পারে তাও প্রতি কেন্দ্রে ১০০ থেকে ১৫০ ভোটের বেশি না। যাইহোক নির্বাচনটা দ্রুত হয়ে যাওয়া উচিত। ১৫ বছর পরে ভোট দিতে চাই। পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিতে চাই।
ত্রিশাল সদর ইউনিয়নের কোনাবাড়ী এলাকায় কথা হয় রাকিব আহমেদ নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো ঠিক হয়নি। প্রকাশ্যে মানুষের ঘরবাড়ি লুট হলেও ফোন করে পুলিশ আনা যায় না। আগে গ্রামে ও ইউনিয়নে প্রতিদিন পুলিশ ঘোরাঘুরি করতো। যার ক্ষমতা আছে, সে চাইলে দখল, মারধর, লুটপাট করে যাচ্ছে। ঠেকানোর মতো কেউ নেই। এমন অবস্থা আগে কখনো হয়নি। এই অন্তর্বর্তী সরকার ১ বছরেও মানুষের জীবন ও জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। এই প্রশাসন নির্বাচনে ভোটারদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না। আগে মানুষ পুলিশকে ভয় পেতো আর এখন পুলিশ মানুষকে ভয় পায়। এই অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে হবে?
উপজেলা সদরে নজরুল অডিটোরিয়ামের সামনে আবু ইউসুফ রানা নামের এক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, দেশের যা অবস্থা। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। আওয়ামী লীগ করি পরিচয় দেয়ার সুযোগ নেই। আমাদের আমলেও এতো খারাপ অবস্থা হয়নি। দ্রুত নির্বাচন হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তবে আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন একদমই জমবে না। একতরফা নির্বাচন হবে।
হরিরামপুর ইউনিয়নের গোলাভিটা গ্রামের রাস্তার ধারে মুদি দোকানি ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ভাই আমার নির্বাচন নিয়ে ভাবার সময় নাই। পেটের ধান্দায় থাকি। নির্বাচন হলেও আমার লাভ নেই। না হলেও ক্ষতি নেই। জিনিসপাতির দাম বাড়তেই থাকে। কিন্তু ইনকাম বাড়ে না। নির্বাচিত সরকার এলে মানুষ আগে কিছু ভর্তুকি পেতো, সেটা আবার চালু হতো। দ্রুত নির্বাচন দরকার।
নিরাপত্তা ও দ্রব্যমূল্য নিয়ে উদ্বেগ: ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা, বৈলর, কাঁঠাল, কানিহারী, ত্রিশাল, আমিরাবাড়ী, হরিরামপুর ইউনিয়নে ঘুরে অর্ধশতাধিক মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে চুরি ডাকাতি, জমি দখল, মাজার ভাংচুর, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ভাঙচুরের চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে। এতে ভুক্তভোগীরা কেউই সময়মতো পুলিশের সহায়তা পাননি। কেউ কেউ পুলিশে ফোন করার পরেও সাড়া পাননি। গত ৯ই সেপ্টেম্বর ত্রিশাল গোপালপুরে ‘ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে’ দেওয়ানবাগ পীরের দরবারে হামলা ও ভাঙচুরের চেষ্টা করা হয়। এ সময় হামলাকারী ও দরবারের লোকজনের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ইটপাটকেল নিক্ষেপে বেশ কয়েকজন আহত হয়। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে ময়মনসিংহের বিভিন্ন জায়গায় দরবেশ, আউলিয়া, পীরদের মাজার ভাঙচুর, ওরশে বাধা। তুচ্ছ ঘটনায় মব সৃষ্টি করা। গ্রামে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের হামলা, মামলার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সময়মতো পুলিশ ডেকেও না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন অনেকেই। ত্রিশাল জিরো পয়েন্ট ফুট ওভারব্রিজের উল্টোপাশে দেখা হয় রাগামারার কৃষক রমজান আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, জিনিসপাতির দাম দিনদিন বাড়ছেই। কিন্তু আমরা সবজির সঠিক দাম পাই না। সবজি চাষ করে সংসার চালাতে পারছি না। বড় ছেলে ঢাকায় চাকরি করতো। সেও গ্রামে ফিরে আসছে। অল্প বেতনে ঢাকায় থাকা খাওয়ার খরচ যোগাতে পারে না।
ত্রিশাল কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের বাসিন্দা আজগর আলী নামের এক ব্যক্তি বলেন, আগে রাতে মেইন রোডে অটো চালানো যেতো। এখন ছিনতাইকারী, চোর, ডাকাত বেড়েছে। রাতে রোডে বের হওয়া যায় না। আগে মেইন রোডে পুলিশি টহল, চেকপোস্ট থাকতো এখন নেই। ভয়ে রাতে রাস্তায় বের হই না। মানুষের সামনে ছিনতাইকারী কুপিয়ে হত্যা করলেও বিচার পাওয়া যায় না। পুলিশ ঠিকমতো কাজ করে না। নির্বাচনের আগে জীবনের নিরাপত্তা চাই।