
গাজীপুরের বহুল আলোচিত নাম জাহাঙ্গীর আলম। ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও মেয়র হয়েছিলেন। তবে দলের বিরুদ্ধে বিতর্কিত মন্তব্য করে বহিষ্কারও হয়েছিলেন। অপসারণ করা হয়েছিল মেয়র পদ থেকেও। পদ হারালেও জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। তার ইশারায় অনেক কিছুর নিয়ন্ত্রণ হতো গাজীপুরে। জেলার জুট ব্যবসা, শহরের চাঁদাবাজি, কারখানা দখল, সড়ক পুনর্বাসন প্রকল্প থেকে কামিয়েছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। খরচও করতেন দু’হাতে দলের নেতাকর্মীদের পেছনে। এর ফলও পান হাতেনাতে। উপ-নির্বাচনে নিজের প্রার্থিতা বাতিল হলেও দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বৃদ্ধ মা’কে দাঁড় করিয়ে মেয়র নির্বাচিত করেন। মা মেয়র হলেও সিটি করপোরেশনের অলিখিত মেয়র ছিলেন তিনি। মেয়রের উপদেষ্টা হিসেবে তিনিও ব্যবহার করতেন সরকারি গাড়ি। কিন্তু ৫ই আগস্ট পট পরিবর্তনের পর দেশ ছাড়লেও জমা দেননি সিটি করপোরেশনের দেড় কোটি মূল্যের সরকারি গাড়িটি (গাজীপুর-গ-১১-০১০০)। সিটি করপোরেশনের প্রশাসন বিভাগে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, সিটি করপোরেশনের টঙ্গীর অফিসে ছাত্র-জনতার দেয়া আগুনে ৩০-৪০টি গাড়ি পুড়ে গেছে, সে সময় হয়তো সেই গাড়িটি ছিল। তবে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। কারণ তখন গাড়িটি জাহাঙ্গীরের বাসায় ছিল। এ ঘটনার পরও সরকারি ওই গাড়ি ব্যবহার করেছেন জাহাঙ্গীর। এদিকে জাহাঙ্গীরের অনুসারীরা জানিয়েছেন, ৫ই আগস্ট জাহাঙ্গীরের বাড়িতে ছাত্র-জনতার দেয়া আগুনে গাড়িটি পুড়ে গেছে। কিন্তু এর সত্যতাও মিলেনি। কারণ পুড়ে গেলেও গাড়ির নাম্বার প্লেট থাকতো। এর কিছুই মিলেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তা আল আমিন পারভেজ মানবজমিনকে বলেন, আমি একেবারে নতুন জয়েন করেছি। এ বিষয়ে আমার জানা নেই। এ বিষয়ে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে তার ওয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে ফোন করলে তিনি কেটে দেন।
পলাতক থেকেও সরব জাহাঙ্গীর: গত বছরের ১৯শে জুলাই রাজধানীর উত্তরায় ছাত্র-জনতার হামলার শিকার হন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর। এ সময় তার পিএস জুয়েল নিহত হলেও গুরুতর আহত হন তিনি। পরবর্তীতে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরলেও ৫ই আগস্ট পট পরিবর্তনের পর ফের গোপনে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। গাজীপুরের বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে দায়ের হয় একাধিক হত্যা মামলা। দলীয় নেতাকর্মীদের সূত্রে জানা গেছে, জাহাঙ্গীর কলকাতা শহরে আছেন। সেখান থেকে নিয়মিত ভিডিও বার্তা দিচ্ছেন। বিভিন্ন অ্যাপসে গ্রুপ খুলে গাজীপুরের দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে করছেন ভার্চ্যুয়াল মিটিং। দিচ্ছেন নানা দিকনির্দেশনা। তার সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে ফেসবুকে দিচ্ছেন শেয়ার। ঝটিকা মিছিল করে তার ফেসবুক ওয়ালে ট্যাগ করছেন নেতাকর্মীরা। দলের কোনো নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হলে দিচ্ছেন বিবৃতি।
সিটি করপোরেশনের টাকায় জাহাঙ্গীরের আবাসন প্রকল্পের রাস্তা: জাহাঙ্গীর আলমের গ্রামের বাড়ি গাজীপুর শহরের কানাইয়া এলাকায়। সেখানে আবাসন প্রকল্প গড়ার জন্য প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা জুড়ে জমি কিনেন জাহাঙ্গীর। সেই আবাসন প্রকল্পের রাস্তার জন্য সিটি করপোরেশন প্রকল্প বানিয়ে ১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেন। সেই রাস্তার কাজও শুরু করেন তিনি। কিন্তু ৫ই আগস্ট পট পরিবর্তনের পর সব কিছু ওলটপালট হয়ে যায়। অন্তর্বর্তী সরকার গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ থেকে তার মা’কে অপসারণ করার আগের দিন এই প্রকল্পটি বাতিল দেখানো হয়। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই প্রকল্পটিতে সিটি করপোরেশনের টাকা খরচ করা হয়নি।
এদিকে জাহাঙ্গীর আলম মেয়র থাকাকালে গাজীপুর শহরে ৭টি রাস্তার জমি অধিগ্রহণসহ নির্মাণকাজের জন্য ২৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু জাহাঙ্গীর সেসব রাস্তার কাজ বাস্তবায়ন করেননি। তিনি মানুষের বাড়িঘর ভেঙে ক্ষতিপূরণ না দিয়ে অন্যদিকে রাস্তা করেন। অনেককে নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দেন। সে সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩৫০০ মানুষ।
এনটিকেসিতে উত্থান এনটিকেসিতে পতন: ১৯৯৬ সালে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে সাততলা বিশাল ভবনে যাত্রা শুরু হয় কোরিয়ান মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান নিউ টাউন নিটওয়্যার কোম্পানির (এনটিকেসি)। শুরু থেকেই জাহাঙ্গীর আলম এই প্রতিষ্ঠানের ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন। সেই থেকে জাহাঙ্গীরের উত্থান শুরু। পরে অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যায় প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক সংকটে পড়ে। শ্রমিকদের বেতন, বিদ্যুৎ বিল ও গ্যাস বিল বকেয়া পড়ে। বকেয়া আদায়ে শ্রমিকরা আন্দোলনে নামেন। বিল বকেয়া থাকায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এ সময় সহযোগিতার হাত বাড়ান জাহাঙ্গীর। তখন তিনি গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বিভিন্ন সময়ে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করতেন। ২০১৮ সালে তিনি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণ নেন। ২০২১ সালে চার মাসের বেতন বকেয়া হলে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। জাহাঙ্গীর শ্রমিকদের তার বাসায় ডেকে নেন। প্রতিষ্ঠানটি ২০২২ সালের এপ্রিলে বন্ধ হয়ে যায়। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জাহাঙ্গীরের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছিল এই এনটিকেসি’র খেলাপি ঋণের কারণে। তিনি ওই ঋণের জামিনদার ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির ঋণের কারণে আর মেয়র হতে পারেননি তিনি।
অর্থের জোগান যাচ্ছে গাজীপুর থেকে: সমপ্রতি শিল্প পুলিশের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, শিল্পনগরী টঙ্গীর কারখানার ২৬৭ মালিক আওয়ামীপন্থি, আর বিএনপিপন্থি মাত্র পাঁচজন। রাজনীতি করেন না এমন কারখানামালিকের সংখ্যা ১১৫ জন। গাছা, বাসন, কোনাবাড়ী, কাশিমপুরসহ অন্যান্য এলাকার চিত্রও প্রায় একই।
গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা ও তার দলীয় নেতাকর্মীরা পালিয়ে গেলেও আওয়ামীপন্থি ২৬৭ শিল্পকারখানার অর্থ জোগান এখনো বন্ধ হয়নি। কারখানাগুলো বর্তমানে নিয়ন্ত্রণ করছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলের আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা। শিল্প পুলিশের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পতিত আওয়ামী লীগের কারখানায় নেতাকর্মীরা এখনো ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। স্থানীয় এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রভাবশালী বিএনপি নেতাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে জাহাঙ্গীরের অনুসারীরা এখনো জুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন। এর ভাগ যাচ্ছে কলকাতায় জাহাঙ্গীরের কাছে।
৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার দুর্নীতির মামলা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে: গাজীপুর সিটি করপোরেশনে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি, ভুয়া ভাউচার তৈরি, একই কাজ একাধিক প্রকল্পে দেখানো, জমি অধিগ্রহণসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। এরপর ২০২১ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। আর ২০২২ সালে তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই দুই তদন্তের কোনোটি আলোর মুখ দেখেনি। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে গোপনে ধারণ করা জাহাঙ্গীর আলমের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেই ভিডিওতে আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতাদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন তিনি। এরপর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ২০২১ সালের ১৯শে নভেম্বর আওয়ামী লীগ থেকে জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কার করা হয়। তখন তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়।
২০২২ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জাহাঙ্গীরের ৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার কথা জানায়। এসব অভিযোগের বিষয়ে দুদক একাধিক অনুসন্ধান দল গঠন করে। প্রথম অনুসন্ধানী দলে ছিলেন দুদকের উপ-পরিচালক আলী আকবর ও সদস্য দুদকের সহকারী পরিচালক আশিকুর রহমান আশিক। গাজীপুরে গিয়ে আশিকুর রহমান আশিক তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বরখাস্ত হওয়া মেয়র জাহাঙ্গীর আলম তার প্রায় তিন বছরের বেশি সময়কালে ৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকার অনিয়ম করেছেন বলে অভিযোগ পেয়েছে দুদক। এরপর জাহাঙ্গীর আলমকে দলে ফিরিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ। এরপর সব তদন্ত, সবকিছু থেমে যায়। গত ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ফের তদন্ত শুরু হয়। তদন্ত শেষে গত ৩০শে আগস্ট জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার দুর্নীতি মামলা করে দুদক।