Image description

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন এক বৃদ্ধ। শ্বাসকষ্টে কাতর ওই বৃদ্ধের শরীর ভাঙা-ভাঙা। তবু তার হাত শক্ত করে আটকানো ঠান্ডা লোহার হাতকড়ায়। এমন একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই।

অসুস্থ ওই বন্দির নাম নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন (৭৫)। তিনি সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও নরসিংদী-৪ আসনের সাবেক এমপি। সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টা ১০ মিনিটের দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন তিনি।

প্রশ্ন উঠেছে একজন অসুস্থ, প্রায় অচেতন কিংবা মৃত্যুপথযাত্রী বন্দির হাতে হাতকড়া থাকার প্রয়োজন নিয়ে। এটা কি নিরাপত্তা, নাকি অমানবিকতার নগ্ন প্রদর্শন? এই দৃশ্য মানবাধিকারের সীমা লঙ্ঘনের পাশাপাশি রাষ্ট্রের নীতি-নৈতিকতার প্রতিফলন নিয়ে নতুন করে তৈরি করেছে বিতর্ক।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এটি শুধু একজন বন্দির নয়, পুরো মানবাধিকারের প্রতি অবমাননা। অসুস্থ বা মৃত্যুপথযাত্রী বন্দিকে হাতকড়া পরানো রাষ্ট্রের নীতিনৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। যে দেশে আইনশৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে অসহায় মানুষকে শেষ মুহূর্তেও শিকলে বেঁধে রাখা হয়, সেখানে মানবাধিকারের চর্চা কতটা বাস্তব, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, নূরুল মজিদ মাহমুদ ‘আনকন্ট্রোলড বাওয়েল অ্যান্ড ব্লাডার’ রোগে ভুগছিলেন। গত ২৭ সেপ্টেম্বর তাকে অসুস্থ অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ৬০২ নম্বর ওয়ার্ডের ৩৫-ক নম্বর বেডে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে রবিবার বিকালে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয় এবং সোমবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

নূরুল মজিদের হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে থাকা, হাতে হাতকড়া পরা একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর শুরু হয় ব্যাপক সমালোচনা। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, গভীর অসুস্থ, মৃত্যুপথযাত্রী একজন বৃদ্ধকে হাতকড়া পরিয়ে রাখার প্রয়োজন কী? মানবাধিকার কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত বিষয়টিকে অমানবিক ও অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন। তাদের মতে, এ ধরনের দৃশ্য শুধু নূরুল মজিদের পরিবারের জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্যও বেদনাদায়ক এবং রাষ্ট্রের মানবাধিকার চর্চা নিয়ে গভীর প্রশ্ন তৈরি করে।

যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিটি পুরোনো বলে দাবি করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। কারা অধিদফতরের এআইজি (উন্নয়ন) জান্নাত-উল-ফরহাদ এ বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন সিসিইউতে ভর্তি ছিলেন এবং সেখানে হ্যান্ডকাফ থাকার কোনও সুযোগই ছিল না। পুরোনো ছবি ব্যবহার করে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।’

এদিকে হাসপাতাল সূত্র বলছে, এই ছবিটি গত ২৭ সেপ্টেম্বরের। এদিন সন্ধ্যা ৬টা ৫৪ মিনিটের দিকে সাবেক মন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনকে ৬০২ নম্বর ওয়ার্ডের মেডিসিন ইউনিটের ১২-এর ৩৫/ক নম্বর বেডে ভর্তি করা হয়। এই ছবিটি সেখান থেকেই তোলা। সেখানে তিনি এক রাত ছিলেন। পরদিন (২৮ সেপ্টেম্বর) সকালে ১০৪ নম্বর (নর্থ) কেবিনে সিসিইউতে হস্তান্তর করা হয়। সেখানেই সকাল ৮টা ১০ মিনিটের দিকে তিনি মারা যান।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিতে দেখা যায়, নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের পেছনে ৩২ নম্বর বেডে কালো টি-শার্ট পরা এক রোগীকে। তার নাম নাম মিজান। তিনি দীর্ঘদিন এই হাসপাতালের একই বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় মিজানের স্বজনরা জানিয়েছেন, রবিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) তাদের সামনের বেডে চিকিৎসাধীন ছিলেন নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। পরদিন তাকে সেখান থেকে কেবিনে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর আর কী হয়েছে তা তাদের জানা নেই।

জানা যায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশান থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর থেকে তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। এক বছর ধরে কারাগারে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন সাবেক এই মন্ত্রী। চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষে মৃত্যু হয় তার। বর্তমানে ময়নাতদন্তের জন্য তার মরদেহ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের মৃত্যু মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের উদাহরণ হয়ে থাকবে। একজন মৃত্যুপথযাত্রী ও পরবর্তীতে মৃত মানুষের হাতে হাতকড়া পরিয়ে রাখা সম্পূর্ণ অমানবিক। এর আগেও এমন চিত্র বহুবার দেখা গেছে, যা মানবাধিকার পরিপন্থি। প্রায় ৮০ বছরের এক বৃদ্ধ, অসুস্থ মানুষকে নিরাপত্তার অজুহাতে হাতকড়া পরিয়ে রাখা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘দুর্ভাগ্য হচ্ছে দেশে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একাকার হয়ে গেছে। ১০ বছর আগেও যেমন ছিল, এখনও সেই একই অবস্থা বিরাজ করছে। এত মানুষের প্রাণহানি ও ত্যাগের পরও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি।’

এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির কোনও আশার আলো তিনি দেখতে পাচ্ছেন না বলেও হতাশা প্রকাশ করেন এই মানবাধিকার কর্মী।

কারা অধিদফতরের এআইজি (উন্নয়ন) জান্নাত-উল-ফরহাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন কারাগারে থাকাকালীন অসুস্থতার কারণে বহুবার হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিটি অনেক পুরোনো। গত রবিবার থেকে নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন সিসিইউতে ভর্তি ছিলেন এবং সেখানে হ্যান্ডকাফ থাকার কোনও সুযোগই ছিল না। পুরোনো ছবি ব্যবহার করে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।’

কারাবন্দিদের হ্যান্ডকাফ পরানোর বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘কারাবিধি অনুযায়ী হাসপাতালের মতো জায়গায় চিকিৎসা নেওয়ার সময় নিরাপত্তার স্বার্থে বন্দিদের হাতে হ্যান্ডকাফ রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে হ্যান্ডকাফের একটি অংশ বন্দির এক হাত বা পায়ে থাকে, আরেকটি অংশ বেড কিংবা রশির সঙ্গে আটকানো হয়।’

তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, আইনের নামে যে প্রথা অসুস্থ, মৃত্যুপথযাত্রী কিংবা মৃত মানুষকেও অমানবিক আচরণের শিকার করে, তা অবিলম্বে পরিবর্তন করতে হবে। রাষ্ট্রের উচিত বন্দিদের মানবিক মর্যাদা রক্ষা করা।