
কমিশনের অনুমোদন ছাড়াই এবার ‘অর্থ আত্মসাৎ’ ও ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’-এর অভিযোগে মামলা করলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক উপ-সহকারী পরিচালক। মামলা দায়ের করা হয়েছে ‘চলমান নির্মাণ কার্যক্রম’কে ‘পরিসমাপ্ত’ দেখিয়ে। আর আসামি করা হয়েছে ওই মুহূর্তে টেবিলে যাকে যাকে পাওয়া গেছে, সবার বিরুদ্ধে। কিন্তু যাদের স্বাক্ষরে কথিত এ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে, অনুসন্ধান প্রতিবেদনেই তাদের দেয়া হয়েছে দায়মুক্তি। দুদকের কুড়িগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে ঘটেছে নজিরবিহীন এ ঘটনা। জানা গেছে, প্রকৃত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বাঁচাতেই তড়িঘড়ি করে দায়ের করা হয় এ মামলা। কমিশনের ‘স্যাংশন’-এর পরিবর্তে ‘সজেকা’র উপ-পরিচালক নিজেই দিয়েছেন মামলার রুজুর অনুমোদন।
রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২৫ মে দুদকের কুড়িগ্রাম সজেকার উপ-সহকারী পরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বাদি হয়ে একটি মামলা (স্মারক নং-০০.০১.৪৯০০.৭৭৫.৯৯.০০১.২৫-৬৩৫) দায়ের করেছেন। এতে দ-বিধির ৪২০/৪০৯/১০৯ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের ৫(২) ধারা প্রয়োগ করা হয়। আসামি করা হয়েছে এলজিইডি, লালমনির হাটের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মঞ্জুর কাদের ইসলাম, এলজিইডি লালমনির হাট সদর সাবেক উপজেলা প্রকৌশলী মো. হারুন অর রশিদ, উপজেলা প্রকৌশলী মো. এন্তাজুর রহমান, সাবেক সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল মান্নাফ, সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মো. শফিউল ইসলাম রিফাত, উপ-সহকারী প্রকৌশলী প্রেমানন্দ রায়, হিসাব রক্ষক মনোরঞ্জন রায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স কে এম বদরুল আহসানের মালিক কে এম বদরুল আহসান এবং মেসার্স সুরমা এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. আয়ুব আলীকে।
এজাহারে আসামিদের বিরুদ্ধে ১৩ লাখ ৯৫ হাজার ৩৯৯.০৭ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলাটি রুজুর আগে এজাহার দায়েরের অনুমোদন (স্যাংশন) জ্ঞাপন করেন দুর্নীতি দমন কমিশন, সমন্বিত জেলা কার্যালয়, কুড়িগ্রামের উপ-পরিচালক আবু হেনা আশিকুর রহমান। মামলা রুজুর অনুমোদন জ্ঞাপনপত্রে দুটি স্মারক নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। ক. দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রধান কার্যালয়, ঢাকার স্মারক নং-০০.০১.০০০০.১০৯.৩৬.০১.২৫-১৫৯ তাং-২১ মে ২৫; খ. দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রধান কার্যালয়, ঢাকার এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের নথি নং-ইএন.কুড়িগ্রাম/১০৫, তাং-৯ ফেব্রুয়ারি ২৫। অভিযোগ রয়েছে, দোষী ব্যক্তিদের দায়মুক্তি দেয়ার লক্ষ্যে মামলাটি দায়ের করা হয়। সেটি কেমন করে? মামলায় উল্লিখিত ১৪ তম ও ১৫তম চলতি বিলে পরিমাপ বহিতে উল্লিখিত পরিমাণ অপেক্ষা মাঠপর্যায়ে গৃহীত পরিমাপ প্রতিবেদনে সেতুর অ্যাপ্রোচ সড়কের সিসি ব্লকের পরিমাণ ও কার্পেটিং কাজের ক্ষেত্রফল কম থাকায় এজাহারে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। অথচ ব্রিজ নির্মাণকাজে তদারকির দায়িত্বে থাকা ১৪তম এবং ১৫তম বিল প্রস্তুতকারী উপ-সহকারী প্রকৌশলীদেরকে অনুসন্ধান প্রতিবেদনেই কৌশলে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। চার্টার অব ডিউটিজ অনুযায়ী সম্পাদিত কাজের পরিমাপে গরমিল থাকলে সেটির দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট উপ-সহকারী প্রকৌশলীর ওপর বর্তায়। পক্ষান্তরে সম্পূর্ণ অকারিগরিক কর্মচারী নির্বাহী প্রকৌশলী দফতরের হিসাব রক্ষককেও মামলাটিতে এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে।
এছাড়া এজাহারভুক্ত সাত আসামি লালমনিরহাট জেলায় যোগদানের বহু আগেই কুড়িগ্রাম সদর উপজেলাধীন মোগলহাট ইউনিয়নের রতœাই নদীর ওপর নির্মিত ব্রিজের কাজ অসমাপ্ত রেখে বিধিবহির্ভূতভাবে সংশ্লিষ্ট কাজের বিপরীতে জমাকৃত ৫২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা ‘পারফরম্যান্স সিকিউরিটি এবং কর্তনকৃত জামানতের ১০ লাখ ৭২ হাজার টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। অথচ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত পূর্ববর্তী নির্বাহী প্রকৌশলী, উপজেলা প্রকৌশলী, উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে এজাহারেই দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়-দুর্নীতিবাজদের দায়মুক্তি প্রদানে দুদকের কুড়িগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট প্রধান ‘বিশারদদের মতামত’ গ্রহণের নামে তাৎক্ষণিকভাবে স্থাপনা পরিমাপ গ্রহণ করেন। নিয়ম হচ্ছেÑ বিশারদদের মতামত গ্রহণের ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানানো হয়। বিশারদ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধান প্রকৌশলীকে চিঠি লিখে টিম গঠন করে দেয়ার অনুরোধ করতে হয়। ১৩ লাখ ৯৫ হাজার টাকা আত্মসাতের মামলা রুজুর ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও চেপে যাওয়া হয়েছে।
এজাহারের তথ্য ও রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২৩ সালের ৯ এপ্রিল সেতুর নির্মাণকাজ ‘সমাপ্ত’ দেখানো হয়েছে দাবি করা হয়। বাস্তবে এখন পর্যন্ত সেতু নির্মাণকাজের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়নি। এজাহারে উল্লিখিত ১৪তম এবং ১৫তম বিল দুটি ছিল ‘চলতি বিল’। কাজের চূড়ান্ত কোনো বিল পরিশোধ করা হয়নি। চুক্তির জিসিসি ক্লজ ৬৫.৬ এবং পাবলিক প্রসিকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮ এর বিধি ৩৯ (১৭) অনুযায়ী চলতি বিলে কোনো আইটেমের বিল অতিরিক্ত পরিশোধ করা হলেও পরবর্তী বিলে সেটি কমানো কিংবা অন্যান্য আইটেমে সেটি সমন্বয়ের সুযোগ রয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, প্রকৃত দুর্নীতিবাজদের যেনতেন প্রকারে দায়মুক্তি প্রদানের লক্ষ্যেই কুড়িগ্রামের ‘এনফোর্সমেন্ট ইউনিট’ দুদকের প্রধান কার্যালয়ে অবস্থিত রংপুর বিভাগীয় ডেস্কে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। সেই অনুযায়ী উপ-পরিচালক আবু হেনা আশিকুর রহমান নিজেই মামলাটির ‘স্যাংশন’ দিয়ে রুজুর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
এদিকে দুদকের একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশে আপত্তি জানিয়ে বলেন, এনফোর্সমেন্ট ইউনিট মামলা দায়েরের স্যাংশন দিতেই পারে না। দুদক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে প্রশাসনের আওতায় থাকেন তারা সেটির আদেশ-নির্দেশের আওতার বাইরে যেতে পারেন না। দুদকের মূল সাংগঠনিক কাঠামোতে ‘এনফোর্সমেন্ট ইউনিট’-এর কোনো অস্তিত্ব নেই। পরবর্তীতে কমিশন সেটি বিধির আলোকে সংযুক্ত করে নিয়েছে। এনফোর্সমেন্ট ইউনিট এখন মহাপরিচালকের (অ্যাডমিন) আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের কাজ হচ্ছেÑ কোথাও দুর্নীতি সংগঠিত হওয়ার সংবাদ পেলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া। কিন্তু উল্লিখিত এ ঘটনার ক্ষেত্রে মনে হচ্ছেÑ এ ইউনিট প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় সীমিত না থেকে অনুসন্ধান এবং তদন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। দুদক কর্মকর্তারা বলেন, এনফোর্সমেন্ট ইউনিট মামলা দায়েরের স্যাংশন দিতে পারে মর্মে কোনো অফিস আদেশ আমাদের কাছে নেই।
কমিশনের স্যাংশন ছাড়া মামলা দায়ের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুদক মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বলেন, বর্তমানে দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট পরিচালিত হচ্ছে মহাপরিচালকের (অ্যাডমিন) তত্ত্বাবধানে। এনফোর্সমেন্টের কোনো কর্মকর্তা মামলা রুজু কিংবা চার্জশিটের স্যাংশন (অনুমোদন) দিতে পারেন না। কোনো সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক তো কোনো ধরনের স্যাংশন দিতেই পারেন না। মামলা রুজু কিংবা চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন দেবে হেড কোয়াটার তথা কমিশন। অন্যথায় আদালত সেটি গ্রহণই করবে না। কমিশনের মঞ্জুরি (স্যাংশন) ছাড়া এফআইআর কিংবা চার্জশিট দাখিল করা যায় না।