
বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর নতুন চাপ তৈরি করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি এবার প্রথমবারের মতো বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ওপর সরাসরি সীমা নির্ধারণ করেছে। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ৮.৪৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিতে পারবে। এর বাইরে ঋণ নেওয়ার সুযোগ আর থাকবে না।
এ সীমা আবার ভাগ করে নির্ধারণ করা হয়েছে— প্রথম তিন মাসে ঋণ নেওয়া যাবে ১.৯১ বিলিয়ন ডলার এবং প্রথমার্ধে সর্বোচ্চ ৩.৩৪ বিলিয়ন। অর্থাৎ ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে আইএমএফ ঋণ ব্যবস্থাপনা খুঁটিয়ে দেখবে, যেন বৈদেশিক ঋণের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা তৈরি না হয়।
কেন এ শর্ত?
আইএমএফ ২০২৩ সালে বাংলাদেশকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের একটি প্রোগ্রাম অনুমোদন করেছিল। তখন বৈদেশিক ঋণের কোনও সীমা ছিল না। তবে চলতি বছরের জুনে যখন ওই প্রোগ্রামের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একসঙ্গে ছাড়ের সিদ্ধান্ত নেয় সংস্থাটি, তখন মূল ঋণের অঙ্ক বাড়িয়ে ৫.৫ বিলিয়ন ডলার করা হয়। সেখানেই নতুন শর্ত হিসেবে আসে বিদেশি ঋণের সীমা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, এ সিদ্ধান্তের ভিত্তি হলো— আইএমএফের সর্বশেষ ডেট সাসটেইনেবিলিটি অ্যানালাইসিস (ডিএসএ)। সেখানে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ঋণ পরিস্থিতি আর ‘কম ঝুঁকি’র পর্যায়ে নেই। বরং ২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪ দুই অর্থবছর ধারাবাহিকভাবে দেশটিকে রাখা হয়েছে ‘মধ্যম ঝুঁকি’র কাতারে।
কারণও স্পষ্ট, ঋণ পরিশোধের চাপ দ্রুত বেড়ে গেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঋণ ও রফতানির অনুপাত দাঁড়িয়েছে ১৬২.৭ শতাংশে, যেখানে প্রাক্কলন ছিল ১১৬-১১৮ শতাংশ। শুধু তাই নয়, ঋণ-রাজস্বের অনুপাতেও অস্বাভাবিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী। এর মানে, বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধযোগ্য ঋণের চাপ সরকার ও অর্থনীতির সক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ কত?
দেশের ইতিহাসে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ সর্বোচ্চ রেকর্ড স্পর্শ করেছে। শুধু গত জুন মাসেই আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বাংলাদেশ ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ গ্রহণ করেছে। এর ফলে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১২ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার, বা ১১ হাজার ২১৫ কোটি ডলারে।
প্রতি ডলারের মূল্য ১২২ টাকা করে হিসাব করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৩ লাখ ৬৮ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা— যা ভবিষ্যৎ ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়াচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
অর্থনীতিবিদদের মতে, আইএমএফের এ পদক্ষেপ একটি বড় সতর্ক সংকেত। বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারে বাড়তি সতর্কতার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এসব ঋণের শর্তাবলি যেমন উচ্চ সুদহার ও স্বল্প গ্রেস পিরিয়ড, তাতে ঝুঁকির সম্ভাবনা বাড়ছে। ফলে প্রকল্প বাছাই ও বাস্তবায়নে কঠোর মূল্যায়ন এবং সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারে আরও সতর্ক হতে হবে। কারণ, এর মধ্যে ঝুঁকি রয়েছে। তাই প্রকল্পগুলো সতর্কভাবে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি এসব ঋণের ব্যবহার সুশাসনের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।”
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণের অর্থ ব্যয় করে যদি রাজস্ব আদায়, বা উৎপাদন নিশ্চিত করা না যায়— তবে পরিশোধের সময় এ ঋণ দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ ফেলবে। তাই প্রতিটি ঋণ সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগাতে হবে, যাতে তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “আইএমএফ আগে বাংলাদেশের ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে বেশ আশাবাদী সুরে কথা বলতো। তারা বলতো, ঋণ-জিডিপি অনুপাত কম, তাই ঝুঁকি নেই। কিন্তু এখন চিত্র পাল্টাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা ঘাটতি আর রিজার্ভ সংকট— ঋণ পরিশোধকে কঠিন করে তুলেছে।”
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সরকারের আর্থিক শৃঙ্খলা দুর্বল হয়ে পড়ায় আইএমএফ এই কড়াকড়ি আরোপ করেছে। তিনি বলেন, “ঋণ-জিডিপি অনুপাতের পাশাপাশি রাজস্ব ও রফতানি আয়ের হিসাব এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ, ঋণ নিতে হলে ডলারেই পরিশোধ করতে হবে। আর ডলার সংকটের সময়ে অতিরিক্ত ঋণ নেওয়া পুরো অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।”
ঋণের বোঝা কীভাবে বাড়লো?
বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণ বাড়ার ধারা নতুন নয়। সরকারি তথ্য বলছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ২০.৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৮.৮ বিলিয়ন ডলারে। আর ২০২৫ সালের জুনের শেষে ঋণের পরিমাণ পৌঁছেছে ৮০.১৯ বিলিয়নে।
এ প্রবৃদ্ধির বড় অংশ এসেছে মেগা প্রকল্প ও করোনাজনিত ব্যয়ের কারণে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে সরকারি ও গ্যারান্টিযুক্ত ঋণ বেড়েছে তিনগুণের বেশি— যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অবশ্য পরিস্থিতিকে অতটা উদ্বেগজনক মনে করছেন না। তাদের যুক্তি, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে নতুন ঋণ নেওয়ার প্রবণতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ নতুন ঋণ নিয়েছে ৮.৩২ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ কম। আর চলতি অর্থবছরের জুলাই ও আগস্ট মিলিয়ে সই হয়েছে মাত্র ২৩৪ মিলিয়ন ডলারের ঋণ— যা আইএমএফ নির্ধারিত সীমার তুলনায় অতি নগণ্য।
কঠিন শর্তের ঋণ
তবে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে “নন-কনসেশনাল” বা অনমনীয় শর্তের ঋণ। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ইআরডি’র এসসিএনসিএল কমিটির বৈঠকে একসঙ্গে অনুমোদন পেয়েছে ১.৪৭ বিলিয়ন ডলারের ৭টি ঋণ প্রস্তাব।
এর মধ্যে আছে— ১. এডিবির অর্থায়নে ৩ প্রকল্পে ৬৪৯ মিলিয়ন ডলার (চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেলপথ রূপান্তর, খুলনা ওয়াটার সাপ্লাই, নেসকো ডিস্ট্রিবিউশন মডার্নাইজেশন)। ২. ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ২৪১.৩ মিলিয়ন ডলার (ময়মনসিংহে জলবায়ু সহনশীল সেতু নির্মাণ)। ৩. এআইআইবি থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা। ৪. ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংক (ইআইবি) থেকে দুটি পানি প্রকল্পে ১৬০ মিলিয়ন ইউরো।
এসব ঋণের শর্ত হলো, বাজারভিত্তিক সুদহার এসওএফআর (সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট)-এর ওপর লেন্ডিং স্প্রেড ও ম্যাচুরিটি প্রিমিয়াম যোগ হবে। ফলে এসব ঋণে গ্রান্ট উপাদান দাঁড়াচ্ছে ২৫ শতাংশেরও কম। অর্থাৎ এগুলো অনেকটাই বাজারঋণের সমান, যেখানে ভর্তুকি বা অনুদান নেই বললেই চলে।
সামনে কী অপেক্ষা করছে?
বাংলাদেশের রিজার্ভ কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও এখনও স্বস্তিদায়ক নয়। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লেও বিনিয়োগ খাত স্থবির। এ অবস্থায় বৈদেশিক ঋণ দিয়ে বাজেট বা প্রকল্পের খরচ চালানো সাময়িক স্বস্তি দিলেও ভবিষ্যতে পরিশোধের সময় বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বর্তমানে বাংলাদেশের কাছে যে ডলার আছে, তা আপৎকালীন সময়ের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কেনার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা ঠিক আছে বলে জানিয়েছেন তিনি। গত ২৩ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি ও অর্থনৈতিক-বিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ কথা বলেন।
এদিকে আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, এখন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে ২৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী রিজার্ভ আছে ৩১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার।
গত ১ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। আর চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট প্রবাসী আয় ৭ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১৮ দশমিক ২ শতাংশ বেশি।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে বড় কাজ হলো ঋণনির্ভরতা কমানো। রাজস্ব আহরণ বাড়ানো, রফতানির বৈচিত্র্য নিশ্চিত করা এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ টানার মাধ্যমে অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করানো ছাড়া বিকল্প নেই।
উল্লেখ্য, আইএমএফের শর্ত তাই কেবল একটি সীমা নয়, বরং বাংলাদেশের জন্য বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার বার্তা। গত দেড় দশকের ঋণ-নির্ভর উন্নয়ন এখন নতুন চাপ তৈরি করছে। সামনের দিনে সরকার যদি নিজস্ব আয় বাড়াতে না পারে, তবে বিদেশি ঋণ হয়তো আর ভরসার জায়গা হবে না— বরং হয়ে উঠবে অর্থনীতির জন্য নতুন সংকটের উৎস।