
নিইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীদের হেনস্তার ঘটনায় জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তারাই দায়ী। বিশেষ করে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের আজ্ঞাবাহী কূটনীতিকরাই এই ঘটনায জন্য দায়ী বলে দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা প্রটোকলের জন্য যেসব কূটনীতিক দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন তাদের অবহেলার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে প্রমান মিলতে শুরু করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে পূর্ব প্রস্তুতির কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে মিশনের কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনার চিত্রই স্পষ্ট হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এটা পূর্ব পরিকল্পিত।
বিশেষ করে নিউইয়র্কে বসবাসরত সাংবাদিকরা মনে করছেন, এই ঘটনা ফ্যাসিস্ট সরকারের দোষরাই নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে আাঁতাত করে পূর্ব পরিকল্পিত নীল নকশাই বাস্তবায়ন করেছেন। তাদের মতে, সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপর এমন ঘটনা অতীতেও ঘটেছে। প্রধান উপদেষ্টার এবারের সফরের সময়ও এমন ঘটনা ঘটতে পারে বলে আগে থেকেই অতিরিক্ত সতর্ক থাকার ভান করে কার্যত স্পর্শকাতর পোস্ট গুলোতে ফ্যাসিস্টদের নিয়োগ করা কেন হলো সে দায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এড়াতে পারেন না। প্রশ্ন উঠেছে তবে কি তিনি কিছুই জানতেন না? নাকি ইচ্ছে করেই ফ্যাস্টিস্টদের দায়িত্ব দিয়েছেন? অন্যদিকে, নিউ ইয়র্কে হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ সাধারণ প্রবাসীরাও। তারা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। এমন ঘটনা এড়াতে সরকার যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়নি বলেও মনে করছেন তারা। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেনের ওপর ডিম নিক্ষেপের ঘটনায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি সালাহউদ্দিন নোমান চৌধুরীসহ কয়েকজন কর্মকর্তা সরাসরি জড়িত। একই সাথে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের আজ্ঞাবাহী এবং বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত খুঁজে খুঁজে স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টার প্রটোকলের দায়িত্ব দেয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে।
জাতিসংঘ মিশনে ফ্যাসিস্ট আমলে নিয়োগ পাওয়া এবং তাদের যেসব সমর্থক কর্মকর্তারা রয়েছেন, তাদের মধ্যে সালাউদ্দিন নোমান চৌধুরী, শোয়েব আব্দুল্লাহ এবং মো. নূরুল ইসলামের নাম ঘুরে ফিরে আসছে। এরা সবাই ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের মদদপুষ্ট কর্মকর্তা।
রাষ্ট্রের ভিভিআইপি সফর আয়োজনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পদ চিফ অফ প্রটোকল। প্রধান উপদেষ্টার এবারের সফরে নিউইয়র্কে চীফ অব প্রটোকলের দায়িত্বে রয়েছেন মো.নুরুল ইসলাম। কোনো হাই প্রোফাইলের কর্মকর্তা তো দূরের কথা মন্ত্রী পর্যায়ের প্রোফাইলের কারও দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতাও এই কর্মকর্তার নেই। ২০১৪ সালের শুরুতে তাকে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর পরিচালক করা হয়, সেটাও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকের কোটায়। সেই কাজে বার বার তিনি ব্যর্থ হন এবং হরেকরকম ভুল করে বসেন। তারপর সেখান থেকে সরিয়ে এই নুরুল ইসলামকে বানানো হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের পরিচালক (আমেরিকা)।
পরবর্তীতে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি পরিচালক- ৯ হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়। যার কাজ ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঘনিষ্ঠ ও গোপনীয় যোগাযোগ মেইনটেইন করা। দুই বছরের অধিককাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-৯ হিসাবে বিশ্বস্ততার সাথে দায়িত্ব পালনের পুরষ্কার হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ কোটায় পূর্বাচলে পান সরকারী প্লট । শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-৯ হিসাবে কাজ করার পুরস্কার এবং তৎকালীন আওয়ামী পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক এর প্রতি আনুগত্যের সুবাদে প্রাইজ পোস্টিং হিসেবে ২০১৬ সালে ওয়াশিংটন দূতাবাসে কাউন্সিলর (রাজনৈতিক) পদে পোস্টিং পান তিনি এবং সেখানে থাকাকালীন মিনিস্টার পদেও পদোন্নতি লাভ করেন। ওয়াশিংটন দূতাবাসে দীর্ঘ চার বছরেরও অধিককাল পোস্টিং এ থাকাকালীন তিনি তৎকালীন সরকারের অত্যন্ত আস্থাভাজন কর্মকর্তা হিসাবে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে এবং বিভিন্ন থিংট্যাংক এর সাথে আওয়ামী সরকারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
পরবর্তীতে সেখান থেকে ২০২০ সালে বাংলাদেশ দুতাবাস বেইজিং এ তাকে বদলী করা হলেও সেখানে না গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তদবীরে বাংলাদেশ হাই কমিশন দিল্লীতে ডেপুটি হাইকমিশনার হিসাবে পোস্টিং বাগিয়ে নেন। দিল্লীতে ডেপুটি হাইকমিশনার হিসাবে দীর্ঘ পাঁচ বছর ছিলেন এবং আওয়ামী সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের অন্যতম মুল কারিগর হিসাবে কাজ করেন। উল্লখ্য , আওয়ামী পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হককে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ বানানোর অন্যতম কারিগর ছিলেন এই নুরুল ইসলাম। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী সরকার চাইলেই কোনো কর্মকর্তাকে রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিয়োগ দিতে পারে না। তার আগে সংশ্লিষ্ট দেশের নমিনেশন নিতে হয়। নুরুল ইসলামের বিষয়ে সে সময় ভারত সরকার জেনে শুনে পরীক্ষিা করেই তাকে নিয়োে সম্মতি প্রদান করে। এ থেকে স্পষ্ট যে, তিনি ভারত সরকারের এজেন্ড বাস্তায়নে আস্থাভাজন ছিলেন। এক সময় ইসলামাবাদ মিশনে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিনের কাজ করার সুবাদে এই নুরুল ইসলাম ছিলেন জসিম উদ্দিনেরও একান্ত অনুগত।
নুরুল ইসলাম ২০২৫ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি দিল্লি থেকে ঢাকায় ফিরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ মহাপরিচালক (উত্তর আমেরিকা) পদে যোগ দেন। এই একই পদে থেকেও জাতিসংঘ মিশন সফরের মাত্র এক মাস আগে শহিদুল হক ও জসিমউদ্দিন গং এর লবিতে চিফ অফ প্রটোকল এর পদটি তিনি পেয়ে যান। বর্তমানে একই সাথে চিফ অফ প্রটোকল এবং মহাপরিচালক (উত্তর আমেরিকা) এই দুই পদেই আসীন আছেন তিনি। একইরকম আরও অনেক কর্মকর্তা এখনও নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডিসিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দূতাবাসে বহাল তবিয়তে কর্তব্যরত আছেন, যাদের অনেকেই নিউইয়র্কে ড. ইউনুসের বর্তমান ফরের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন। অভিযোগ রয়েছে, নিউইয়র্কে ড. ইউনূসের সফর সূচীর তথ্য আগে ভাগেই তিনি আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে পাচার করেন।
ড. ইউনূসের সফরের প্রোটোকলের দায়িত্বে ছিলেন আরেক কূটনতিকি শোয়েব আব্দুল্লাহ। ৫ আগস্টের পর শোয়েব আব্দুল্লাহকে নেপালে বদলি করা হয়। সেখানে তিনি কনস্যুার এবং ডেপুটি চিফ অব মিশন হিসেবে কাজ করছেন। জাতিসংঘের এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে তাকে নেপাল থেকে সালাউদ্দিন নোমান এখানে নিয়ে আসেন প্রোটোকলের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য। এই শোয়েব আব্দুল্লাহ রোটন-রিপন পরিষদের ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ছিলেন। তিনিই প্রোটোকলের দায়িত্ব থেকে সবাইকে বিভ্রান্ত করেন এবং ঠা-া মাথায় পরিকল্পনা করেন; কিভাবে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতাদের হেনস্তা করা যায়। শোয়েব আব্দুল্লাহর সঙ্গে ছিলেন হাসান আল জামান রাফি নামে আরেকজন। তার দায়িত্ব ছিল লাগেজ হ্যান্ডেলিং এবং ভেহিকেল কোঅর্ডিনেট করা। তিনিও বিএনপি-জামায়াত ও এনসিপিকে বিভ্রান্ত করেছেন। স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, জাতীয় ৫ নেতাকে বিমানবন্দরে রেখে সরকারি প্রটোকল নিয়ে আগেই বের হয়ে যান প্রধান উপদেষ্টা। তার প্রস্থানের প্রায় ১ ঘণ্টা পর বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন এবং এনসিপি’র সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা কোনো প্রটোকল ছাড়াই বিমানবন্দর থেকে বের হন। তখনই ঘটে পরিকল্পিত অপ্রীতিকর ঘটনা। শুরু হয় ডিম নিক্ষেপ ও গালিগালাজ। নিষিদ্ধ হওয়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা তাদের ঘিরে ইউনূসবিরোধী স্লোগান দেন, তুমুল গালাগাল করেন। ডিম নিক্ষেপ করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেনের গায়ে। এ ঘটনায় জ্যাকসন হাইটসের নবান্ন পার্টি হলের সামনে থেকে মিজানুর রহমান নামে যুবলীগের এক কর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করে।
এসব ঘটনার আড়ালে প্রকৃত মদদদাতা হিসেবে এই সব কর্মকর্তারা সক্রিয় ছিলেন বলে ঘটনার পর পরই জানিয়েছিলেন স্থানীয় সাংবাদিকরা। একজন সাংবাদিক বলেন, প্রধান উপদেষ্টা সফর সঙ্গীদের নিয়ে কখন অবতরণ করবেন সে বিষয়ে আমরাও বিভ্রান্তিতে ছিলাম। অথচ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মরা সব কিছুই জানতো। আমরা বাধ্য হয়ে তাদেরকেই ফলো করতে করতে জেএফকে বিমান বন্দরে পৌঁছি। পরে জেনেছি ওরা আগে থেকেই সব জানতো। আরেক সাংবাদিক বলেন, এরকম একটা ঘটনার নেপথ্যে নিউইয়র্ক মিশনের কর্মকর্তারা জড়িত থাকতে পারে। কারণ হাসিনার বিদায়ের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে মূলত আওয়ামী ফ্যাসিস্টদেরকেই পদায়ন করেছে। এর দায় অবশ্যই পররাষ্ট্র উপদেষ্টার। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, তবে কী তিনি ইচ্ছে করেই এসব করেছেন নাকি এসব বিষয়ে কিছুই জানতেন না? দুটো প্রশ্নের উত্তরে যেটাই সঠিক হোক না কেন তিনি এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।