
আমরা যখন দাউ দাউ করা আগুন নির্বাপনে ব্যস্ত থাকি, তখন নিজের কথা মাথায় থাকে না। মানুষের জীবন বাঁচানো আর সম্পদ রক্ষা করাই থাকে একমাত্র টার্গেট। কিন্তু সেই ঝুঁকি আমাদের জন্য মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সম্প্রতি টঙ্গির একটি কেমিক্যাল কারখানায় আগুন ও তিনজন ফায়ার ফাইটারের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর এমনই মন্তব্য করেন ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স এর একজন কর্মকর্তা।
তিনি জানান, শুধুমাত্র অভিযানিক কার্যক্রম চালাতে গিয়ে ১৯৬৬ সালে সংস্থাটির শুরু থেকে ৫১ জন কর্মীর মৃত্যু ঘটেছে। নিহত এসব কর্মীর মধ্যে নার্সিং অ্যাটেনডেন্ট থেকে শুরু করে সিনিয়র স্টেশন অফিসার পর্যন্ত রয়েছেন। সংস্থাটির হিসেবে, গত ১০ বছরেই মৃত্যু হয়েছে ২৬ জনের। এ সময়ে কমবেশি আহত হয়েছেন আরো ৩৮৬ জন।
তবে সব থেকে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে ২০২২ সালের ৪ জুন রাতে। সেদিনকারের ঘটনায় ১৩ জন কর্মী অকালে প্রাণ হারান। ফায়ার সার্ভিসের ৬০ বছরের ইতিহাসে শুরু থেকে একদিনে একসাথে এতোকর্মী হারানোর বেদনার ঘটনা সেটাই প্রথম। ফায়ার সার্ভিস সৃষ্টির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হৃদয়বিদারক ঘটনা চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে সীতাকুন্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামে। সেদিন বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ডিপোতে ‘হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড’ নামের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক ছিল। বিস্ফোরণের আগুন নেভাতে গিয়ে আগুনের তাপ ও দম বন্ধ হয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৩ কর্মী নিহত হন। এদের মধ্যে তিনজনকে উদ্ধার করাও যায়নি। সেদিন ১৩ জন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীসহ ৫১ জন নিহত এবং দুই শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। যাদের অনেকে পঙ্গু হয়ে গেছেন। আশেপাশের জেলার ২৫টি ফায়ার সার্ভিস ইউনিট সেইসাথে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর চেষ্টায় ৮৬ ঘণ্টায় ডিপোর আগুন নেভে। এ ঘটনার পর আজও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাননি আহতদের কয়েকজন। আবার বিচার নিয়েও হতাশ হতাহতের স্বজনরা।
তবে ২২ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের টঙ্গীতে কেমিক্যাল কারখানায় আগুন নেভাতে গিয়ে দগ্ধ হন চার জন ফায়ার কর্মী। কয়েক দিনের ব্যবধানে এদের তিনজনই পর পর মারা যান। এসব বীরদের মধ্যে দু’জনের শরীরের শতভাগই পুড়ে যায়। একজনের পুড়ে গেছে শরীরের ৪৫ শতাংশ। এ ঘটনায় শোকাহত পুরো ফায়ার সার্ভিস। শোকাহত দেশের মানুষও। তাদের মৃত্যু নিয়ে ক্ষোভ ও প্রকাশ করেছেন অনেকে। আগুন নেভাতে গিয়ে কেন ফায়ার কর্মীদের মৃত্যু হচ্ছে এ নিয়েও চলছে বিশ্লেষন।
জানা গেছে, অনেক কারখানায় কেমিক্যাল মজুদ থাকলেও আগুন লাগার পর মালিক পক্ষ নিজেদের রক্ষা করতে মূল বিষয়টি আড়াল করেন। এই সত্য লুকানোর জন্যই ফায়ার কর্মীদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে কোন ধরনের আগুন লেগেছে তা সনাক্ত করতে গিয়েই অনেক ফায়ার কর্মী কিছু বুঝে ওঠার আগেই দগ্ধ হন। এছাড়া, ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর উত্তেজিত জনতা দ্রুত আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের ওপর চড়াও হয়। এজন্য বাধ্য হয়ে আগুনের স্থানে ঝুঁকি নিয়ে প্রবেশ করলে সেখানে বিস্ফোরণ ঘটলে ফায়ার ফাইটারদের মৃত্যু হয়।
গাজীপুরের টঙ্গীর ঘটনায় ফায়ার ফাইটারদের পিপি নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক কর্মী। তারা বলেন, ‘কর্মীদের ব্যবহৃত একটি পিপি ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ ডিগ্রি তাপমাত্রা সহ্য করার ক্ষমতা থাকার কথা। কিন্তু গাজীপুরের অগ্নিকা-ে সেই পিপি শত ভাগ পুড়ে গেছে। এর অর্থ পিপিতে ভেজাল আছে। সঠিক মানের পিপি কেনা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, টিনশেডের গুদামটি একটি পোশাক কারখানার। ঘটনার দিন বিস্ফোরণের পর ভেতরে থাকা লোকজন দৌড়ে বের হয়ে আসেন। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন সেখানে যাওয়ার পর জানানো হয় ভেতরে পোশাক কারখানার অফিস। ফলে ফায়ার কর্মীরা সেই ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেন। এর মধ্যে রাসায়নিকের একটি ড্রামে বিস্ফোরণ ঘটে। ওই কারখানার মধ্যে যে রাসায়নিকের ড্রাম আছে সে তথ্য ফায়ার কর্মীদের কাছে গোপন করা হয়। ফলে ফায়ার কর্মীদের সেই ধরনের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। আর এতেই ফায়ার সার্ভিসের চারজন দগ্ধ হন। এর মধ্যে পর পর তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। কেমিক্যাল কারখানায় লাগা আগুনে দগ্ধ ফায়ার ফাইটার নুরুল হুদা (৩৮) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বুধবার ঢাকার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে মারা যান। এর আগের দিন মঙ্গলবার মারা যান দগ্ধ কর্মী শামীম আহমেদ (৪০)। সব শেষে গতকাল শনিবার সকালে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন প্রতিষ্ঠানটির ওয়্যারহাউস ইন্সপেক্টর (অফিসার) খন্দকার জান্নাতুল নাঈম (৩৭)। আগুন নেভাতে গিয়ে দগ্ধ হন জান্নাতুল নাঈম। তাঁর শরীরের ৪২ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। নাঈম ২৪ আগস্ট ১৯৮৮ সালে শেরপুর জেলার নকলা উপজেলার গড়দুয়ারা ইউনিয়নের খন্দকারবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। মোল্লার টেক উদয়ন বিদ্যালয় থেকে ২০০৪ সালে এসএসসি ও ফুলপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। পরবর্তীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট তিনি বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সে যোগদান করেন। চাকরিজীবনে স্টেশন অফিসার হিসেবে মানিকগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ ফায়ার স্টেশনে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে ওয়্যারহাউস ইন্সপেক্টর হিসেবে চট্টগ্রাম ও সর্বশেষ টঙ্গী ফায়ার স্টেশনে কর্মরত ছিলেন। তিনি এক সন্তানের জনক। তাঁর বাবা খন্দকার মোজাম্মেল হক ও মাতা দেলোয়ারা বেগম।
সংস্থাটির সাবেক ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ইঞ্জিনিয়ার আলী আহম্মেদ খান বলেন, রাসায়নিক অগ্নিকা-ে কাজ করার জন্য আমাদের আরো উন্নতমানের সরঞ্জাম দরকার। অনেক সময় পোশাক ও অক্সিজেন সিলিন্ডারের মান যথেষ্ট না হওয়ায় দগ্ধ বা বিষক্রিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।