
পানির রং কালচে, পানিতে নেই অক্সিজেন। দূষণের মাত্রাও খুব বেশি যে, নদীটির পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেই দুর্গন্ধ এসে নাকে ঠেকে। আবার ভরাট আর দখলেও প্রায় প্রবাহশূন্য। ফলে শুধু বর্ষা ও শরৎ ছাড়া বাকি চার ঋতুতেই বেড়ে যায় তাপমাত্রাÑ এ অবস্থা ঢাকার প্রাণখ্যাত বুড়িগঙ্গা নদীটির। যে নদী ঘিরেই প্রায় চারশ’ বছর আগে গোড়াপত্তন হয়েছিল রাজধানী ঢাকার। কিন্তু সময়ের স্রোতে বুড়িগঙ্গা হারিয়েছে গতিপথ, প্রবাহ। দখল-দূষণে তিলে তিলে মেরে ফেলা হচ্ছে এই নদীকে। খোদ নদী রক্ষা কমিশনই বলছে, বুড়িগঙ্গায় এখন জীববৈচিত্র্য ও প্রাণবৈচিত্র্যের যে অবস্থা, তাতে এটিকে কোনোভাবেই নদী বলা যাবে না। এটি একেবারে মৃতপ্রায়। দখল আর দূষণ রোধ করতে না পারলে বুড়িগঙ্গা বিলুপ্ত হবে শিগগরিই। এমন শঙ্কা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বুড়িগঙ্গা নদীর বর্তমান অবস্থার জন্য বর্জ্য নিষ্কাশনের অপারগতা ও অবহেলাই মূলত দায়ী।
বুড়িগঙ্গা নদী দখল ও বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য (শিল্প বর্জ্য, ড্রেনেজ বর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্য) ফেলার কারণে নদীর পানি এতটাই দূষিত হয়েছে যে, এতে কোনো অক্সিজেন অবশিষ্ট নেই এবং জলজ প্রাণী বসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অবৈধ দখলদাররা নদীর উভয় পাড় দখল করে রেখেছে, ফলে এর স্বাভাবিক প্রবাহও নষ্ট হয়ে গেছে। পরিবেশবাদীরা এবং নদী রক্ষায় নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থা বুড়িগঙ্গা নদীকে বাঁচানোর জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানালেও নদীর প্রাণ ফেরাতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। বরং উল্টো সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তা তাদের ছত্রছায়ায় নদী দখল ও দূষণ চলছে। যখন যে সরকার আসে তখন তাদের দলীয় লোকদের দ্বারা দূষণ ও দখল চলে। আর তাদের দোসর হয়ে কাজ করে সরকারের সংশ্লিষ্ট কিছু অসাধু কর্মকর্তা।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর জনগণ প্রত্যাশা করেছিল, এবার হয়তো বুড়িগঙ্গা প্রাণ ফিরে পাবে। বিশেষ করে পরিবেশবাদী আন্দোলনের আলোচিত কর্মী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর সাধারণ মানুষের মনে ব্যাপক আশা জেগেছিল। কিন্তু সে আশার গুড়েবালি। সৈয়দা রিজওয়ানা দায়িত্ব গ্রহণের পর সুন্দর সুন্দর বক্তব্য দিলেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই। দায়িত্ব নেয়ার পরই বলেছিলেন, এবার বুড়িগঙ্গা দখলমুক্ত করা হবে। সে লক্ষ্যে প্রথমে কিছু পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়। কিন্তু গঠাৎ করেই কোনো এক অদৃশ্য ইশারায় তা একেবারে থেমে যায়। তবে এ নিয়ে ইতোমধ্যে নানা তথ্য প্রকশিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে মিডিয়াতে প্রকাশ হচ্ছে, উপদেষ্টার স্বামী এবি সিদ্দিকীর কারণেই বুড়িগঙ্গার দখল উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ হয়ে গেছে। কেননা, এবি সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের সময়ের বিদু্যুৎ প্রতিমন্ত্রী লুটেরা নসরুল হামিদ বিপুর সব অবৈধ সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন। তাই বিপুর অবৈধভাবে দখল করা নদীর জায়গা রক্ষা করতেই উচ্ছেদ অভিযান থেমে গেছে। মূলত এভাবেই চলছে দূষণ কার্যক্রমও। আসলে দেখার কেউ নেই।
ঢাকা ও এর আশেপাশে অবস্থিত বিভিন্ন শিল্প-কারখানায়, বিশেষত প্লাস্টিক কারখানা ও টেক্সটাইল কারখানা থেকে সরাসরি নদীতে প্রচুর পরিমাণে বর্জ্য ও রাসায়নিক নির্গত হয়, যা বুড়িগঙ্গার পানিকে বিষাক্ত করে তুলেছে। ঢাকা শহরের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা থেকে অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ে, যা পানির গুণগত মান নষ্ট করছে। বুড়িগঙ্গার দূষণ ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। ম্যাগাসিটি রাজধানী ঢাকার দেড় কোটি মানুষের মলমূত্রসহ বিভিন্ন কলকারখানা, গৃহস্থালির ১০ হাজার ঘনমিটারের বেশি বর্জ্য প্রতিদিন বুড়িগঙ্গায় নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। এছাড়া, নদী পাড়ের মানুষ এবং বিভিন্ন দোকানদার এখানে বর্জ্য ফেলে। এলাকার প্রভাবশালী গোষ্ঠী বুড়িগঙ্গা নদীর উভয় তীর দখল করে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো তৈরি করেছে, যার ফলে নদী সরু হয়ে গেছে এবং এর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নদীটিতে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলাও একটি বড় সমস্যা, যা পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে।
ব্যাপক দূষণের ফলে বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এর ফলে, মাছসহ কোনো জলজ প্রাণী এতে বাঁচতে পারছে না। নদীটি একটি খোলা ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে তীব্র দুর্গন্ধ পাওয়া যায় এবং এতে আবর্জনার স্তূপ জমে থাকে। দখলদারদের কারণে নদীর নাব্য (প্রবাহযোগ্যতা) সংকটে পড়েছে। এর ফলে, বর্ষা ও শরৎ ছাড়া অন্য ঋতুতে নদীর পানি প্রায় প্রবাহশূন্য হয়ে যায়। এটি একটি বদ্ধ ডোবার মতো হয়ে যায়।
বুড়িগঙ্গা নদীকে বাঁচাতে সরকার টাস্কফোর্স গঠন, নদী উদ্ধার অভিযান এবং কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। অনেক উদ্যোগ নিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচও করা হয়েছে; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বুড়িগঙ্গা দিন দিন প্রাণহীন হয়ে পড়ছে। পরিবেশবাদীরা সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনা করেছেন এবং অবিলম্বে নদীটিকে দখল ও দূষণমুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন।
বিশ্বব্যাংকের তালিকায় ‘মৃত নদী’ হিসেবে উঠে এসেছে বুড়িগঙ্গার নাম। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনও বলছে মৃতপ্রায়। মুমূর্ষু বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে সম্প্রতি নদী রক্ষা কমিশন নদীর পানির নমুনা সংগ্রহ ও দূষণের উৎস চিহ্নিত করেছে। পানির রং এখানে কুচকুচে কালো। তাতে আবার উৎকট গন্ধ। নিঃশ্বাস নেয়াই দায়। মাছ আর জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়েছে আরো আগে। ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা তাই এখন নদীর কঙ্কাল।
স্থানীয়রা বলছেন, ইদানীং এত পরিমাণ ময়লা হয়েছে যে, নদীতে পারাপার হতেও কষ্ট হয়। নদী প্রচ- গন্ধ। দুর্গন্ধ সহ্য করার মতো না। একসময়ের স্রোতস্বিনী নদীটিকে একরকম গিলে খাচ্ছে কেবল দখলদারদের অবৈধ স্থাপনা। সেই সঙ্গে সব জায়গায় আশপাশের কারখানার লাখো-কোটি টন বিষাক্ত বর্জ্য ফেলার চিত্র। উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী দখল ও দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে সাজা নিশ্চিত করলেই বাঁচানো যাবে বুড়িগঙ্গা। এমনটিই দাবি পরিবেশকর্মীদের।
বুড়িগঙ্গার বসিলা প্রান্ত থেকে শ্যামপুরের পাগলা পর্যন্ত দূষণের উৎস, মাত্রা, ধরন পরিমাপ করতে পানির নমুনা সংগ্রহ করেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সদস্যরা। টিডিএস মিটার, পিএইচ মাপার যন্ত্র, ইসি দিয়ে পানির স্যালানিটিসহ নানা পরীক্ষা করা হয়। তারা বলছেন, পানির গুণগতমান পরীক্ষা করার জন্য যেসব বিষয় লক্ষ রাখতে হয়, তার সব কিছুই পরীক্ষা করছি। কমিশন বলছে, বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন শূন্যের কোঠায়। বুড়িগঙ্গায় এখন জীববৈচিত্র্য ও প্রাণবৈচিত্র্যের যে অবস্থা, তাতে এটিকে কোনোভাবেই নদী বলা যাবে না। এটি একেবারে মৃতপ্রায়। দখল আর দূষণ রোধ করতে না পারলে বুড়িগঙ্গা বিলুপ্ত হবে শিগগরিই। এমন শঙ্কা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের।
নদীরক্ষা-বিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন বলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নদী দখল ও দূষণ চলছে। বুড়িগঙ্গার ১৬ কিলোমিটার সরকারি নথি থেকে মুছে দেয়ার মধ্য দিয়ে দখলকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। এই শুকনো অংশে সীমান্ত পিলার দেয়া হয়নি। পিলার দেয়া হয়েছে কেবল বুড়িগঙ্গার প্রবাহমান অংশে। প্রবাহমান অংশে এক হাজারের মতো পিলার পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ৭০০ পিলার অক্ষত অবস্থায় নেই। বুড়িগঙ্গায় ভরাট-দখলের ১৬ কিলোমিটার অংশ এখন তিন রকম অবস্থায় আছে। প্রথমত, সেখানে অনেক আবাসন প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা তৈরিসহ নানা ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আরেকটি অংশ ভরাট হয়ে ফসলি জমি হয়েছে। তৃতীয়ত, একটি অংশকে মানুষ খাল হিসেবে চেনে। সেখানে বর্ষায় পানি থাকে, কখনো শুকনো থাকে। তাই একে পুরোপুরি উদ্ধার করতে হলে সরকারের অন্তরিক উদ্যোগ ব্যতীত সম্ভব নয়।