
দেশটাকে লুটেপুটে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা গত বছরের ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালান। তখন দেশের অর্থনীতি ছিল অনেকটাই বিপর্যস্ত। ব্যয় মেটাতে সরকার ঋণ করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু গত এক বছরেও রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ে কিছুটা অগ্রগতি ছাড়া বিপর্যয় সামাল দিতে পারেনি। এই সময়ে নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়েনি, বরং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের কারণে কমেছে। গত এক বছরে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে ৩৫৩টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এতে বেকার হয়েছেন এসব কারখানায় কর্মরত এক লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ জন শ্রমিক। এদিকে নতুন করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠছে না। এমনকি আগের ছোট-ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিক্রি নেই, নতুন পণ্য নেই। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছে না। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, আরো কিছু বন্ধের পথে। কাজ না থাকায় শ্রমিকরা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। কিছু শ্রমিক জীবিকার তাগিদে আগের চেয়ে কম বেতনে চাকরি পেলেও হাজার হাজার শ্রমিক এখনো বেকার। অনেকেই চাকরি না পেয়ে চা দোকানে কাজ করছেন। কেউ টিকিট কাউন্টারে, কেউবা অটোরিকশা চালাচ্ছেন, বাজারে সবজি বিক্রি করছেন কেউ কেউ। তবে অনেকেই আবার ডাকাতি, অপহরণ ও ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়েছেন। লাশবাহী অ্যাম্বুল্যান্স থামিয়ে ডাকাতির মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনাও ঘটছে। যৌথ বাহিনী, পুলিশ ও র্যাবের সাঁড়াশি অভিযানেও থামানো যাচ্ছে না এসব অপরাধ কর্মকা-। এদিকে চার শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দুই হাজারের বেশি ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এতে অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার সবশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা রয়েছে। এর আগে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৬৬ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা জব্দ করেছিল সংস্থাটি। বিএফআইইউ’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩১ হাজার কোটি টাকা জব্দ বা অলস পড়ে আছে। যে কারণে আর্থিকখাতে অর্থের প্রবাহ কমে গেছে। বিপদ এড়াতে আবার অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। সব মিলিয়ে ত্রাহি অবস্থার মধ্যে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছে দেশের আর্থিক খাত।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গত সপ্তাহে প্রকাশিত সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে উঠে এসেছে- দেশে এখনও স্নাতক ডিগ্রিধারীদের প্রতি তিনজনের একজন বেকার। এতে বলা হয়, দেশে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে, বেড়েছে বেকারের সংখ্যা। এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে এক লাখ ৬০ হাজার। তাদের বেশিরভাগই আবার উচ্চশিক্ষিত। যোগ্যতা অনুসারে চাকরি পাচ্ছে না মানুষ। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণদের ক্ষেত্রে বেকারত্বের চিত্র ভয়াবহ। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী যুব বেকারদের মধ্যে প্রায় ২৯ শতাংশ স্নাতক। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শ্রমবাজারে নিরক্ষর শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৩০ লাখে। এই নিরক্ষর কর্মশক্তি দেশের অর্থনীতির উৎপাদনশীলতায় তৈরি করছে বড় সীমাবদ্ধতা। বিশেষ করে শিল্প ও সেবা খাতে দক্ষতা ঘাটতির কারণে অনেকে কাজ পেলেও যোগ্য পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। কর্মসংস্থানের কাঠামোতেও বড় বৈষম্য ধরা পড়েছে। দেশে কাজে নিয়োজিতদের ৮৪ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে। গ্রামে এ হার ৮৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ, শহরে ৭৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অর্থাৎ বিপুল শ্রমশক্তি এখনো সুরক্ষাহীন, সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত।
যদিও দেশের মানুষ আশাবাদী ছিল রাষ্ট্রীয় মদদে স্বৈরাচার হাসিনার পাচারকৃত অর্থ ও লুট করা টাকা ফেরত আনবে বর্তমান সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এ নিয়ে নানামুখী তৎপরতায় আশাবাদী ছিল মানুষ। এদিকে হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের অনিয়ম-দুর্নীতি দূর হবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে এবং দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানা হবে। কিন্তু বাস্তবে গত এক বছরে সে ধরণের কোন উদ্যোগ বা অর্জন চোখে পড়েনি। কিছু প্রতিষ্ঠানে পরিচালক এবং পরিদর্শক নিয়োগ দিয়েই শেষ। বরং বেক্সিমকোসহ অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। আরো কিছু বন্ধের পথে। আবার পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে সমস্যার মুখে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাভাবিক বা সচল করতে কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। তাই প্রতিদিনই বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। বিদেশি বিনিয়োগ না বাড়ায় বেকার জনগোষ্ঠীর নতুন চাকরির সুযোগ সংকুচিত হয়ে গেছে। এদিকে চাকরি প্রত্যাশী অনেকেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন। এতে কিছুটা হলে কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়ে। কিন্তু মানুষের আস্থা ফেরাতে ভালো কোন প্রতিষ্ঠানকে বাজারে ফেরাতে পারেনি। ভালো প্রতিষ্ঠানকে সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রেও কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। বরং কিছু অমূলক সিদ্ধান্ত নিয়ে বাজারে অস্থিরতা ছড়ানো হচ্ছে। আর তাই বিনিয়োগের পরিবেশ ফেরাতে না পারায় বেকারত্ব বাড়ছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, ছাত্র-জনতা যে লক্ষ্য নিয়ে অভ্যুত্থান করেছিল তার ধারেকাছেও এখনো যেতে পারেনি বর্তমান সরকার। আগের মতোই সংকটের মুখে দেশের অর্থনীতি। ফলে অর্থনীতিতে যে চ্যালেঞ্জটি বড় হয়ে উঠছে সেটা হচ্ছে কর্মসংস্থান।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ বলছে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন। এই সময়ে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য আরো কঠিন হবে। বিশেষ করে তারল্য সংকট, মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে বাস্তব কোন পদক্ষেপও নেই। তাদের মতে, অর্থনীতি চাঙ্গায় এই সময়ে সরকারের উচিত জব্দ অর্থ থেকে পাচার ও অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে যারা এই টাকা কামিয়েছেন তাদেরটা কোষাগারে নিয়ে নেওয়া। পাশাপাশি যে সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই বা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নয় এমন ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়া। এটা করতে না পারলে আর্থিক খাতে অর্থের প্রবাহ বাড়বে না বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর শরমিন্দ নীলোর্মি মনে করেন যেসব ‘তোষণ বিনিয়োগ’ হুমকির মুখে পড়েছে, সরকারকেই সেগুলো চালিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে কর্মসংস্থানের চিত্র আরো খারাপ হবে। তিনি বলেন, সরকার ঘনিষ্ঠ সবাই তো আর টাকা বিদেশে নেয়নি। অনেকেই দেশেও বিনিয়োগ করেছেন। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে এসব বিনিয়োগের ব্যাপারে জনমনে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। কিন্তু যেহেতু বিনিয়োগ হয়েছে এগুলো সরকারি ব্যবস্থাপনায় অন্তত বেশ কিছুদিন চালিয়ে নেয়া প্রয়োজন, বিশেষত যেগুলো ভালো প্রতিষ্ঠান। যেন কর্মসংস্থানের জন্য ভুল বার্তা না যায়। অর্থাৎ আমার নতুন কর্মসংস্থান তো তৈরি করতে হবেই, পুরনো কর্মসংস্থানও যেন ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে সেটা মাথায় রাখতে হবে। এর পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগও দরকার হবে। কারণ বিনিয়োগ হলে কাজ সৃষ্টি হয়, মানুষ কাজ পায় বলে উল্লেখ করেন শরমিন্দ নীলোর্মি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম বলেন, ব্যাংকঋণ সুদে কড়াকড়ি, শ্রমিক অসন্তোষ, কাঁচামাল আমদানিতে এলসি সমস্যা, শিল্পে অব্যাহত গ্যাসসংকট, দফায় দফায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না পাওয়া, অব্যাহতভাবে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে দেশে শিল্প-কারখানা বন্ধ হচ্ছে। উৎপাদন খরচ মিটিয়ে অনেকেই প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না বলে কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, আমরা নিয়ম মেনে ব্যবসা করেছি, ট্যাক্স দিয়েছি। অথচ অনেকদিন থেকে ব্যাংক হিসাব জব্দ, লেনদেন বন্ধ। যে কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধের পথে। অবশ্য জব্দ হিসাব ও অর্থের ক্ষেত্রে ক্ষমতাচ্যুত ভারতে পলায়নকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাদের দোসর এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান বিতর্কিত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সাইফুল আলম, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, বসুন্ধরা গ্রুপের আহমেদ আকবর সোবহানের ব্যাংক হিসাব রয়েছে। তাই এ ধরনের দোষীদের ব্যাংক হিসাবকে জব্দ বা সরকারি কোষাগারে নিয়ে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের জব্দ হিসাব খুলে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী।
যদিও সর্বশেষ তথ্য মতে, বেক্সিমকো গ্রুপের বন্ধ কারখানা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব কারখানা চালু করতে আপাতত ২৪৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে জাপানের রিভাইভাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। আর এ প্রক্রিয়ায় রিভাইভালের সঙ্গে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইকোমিলি নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান। বেক্সিমকোর বন্ধ কারখানা চালুতে এই দুই প্রতিষ্ঠানের যৌথ বিনিয়োগের সিদ্ধান্তে সায় দিয়েছে সরকার। এখন অপেক্ষা ত্রিপক্ষীয় চুক্তির। পক্ষগুলো হলো রিভাইভাল, জনতা ব্যাংক ও বেক্সিমকো। অপরদিকে আরেকটি বড় গ্রুপের ‘নাসা গ্রুপ’ আট হাজার ৬৭৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ মাত্র এক শতাংশ এককালীন জমা বা ডাউন পেমেন্টে পুনঃতফসিল করার সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার, যাতে প্রতিষ্ঠানটির কারখানাগুলো পুনরায় চালু করা যায়। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির জন্য বেক্সিমকো ও নাসা’র মত অন্যান্য কারখানাও খুলে দেওয়ার জন্যও সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
সাভার থেকে দৈনিক ইনকিলাবের স্টাফ রিপোর্টার সেলিম আহমেদ জানিয়েছেন, বেক্সিমকো ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পার্কের স্টিল বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলার পোশাক কারখানায় অপারেটর হিসেবে চাকুরি করতেন মো. জুয়েল রানা। চাকরি চলে যাওয়ার পর অনেক কারখানায় ঘুরেও চাকরি পাননি তিনি। পরে বাধ্য হয়ে পরিবারের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে পরিবহনের টিকিট কাউন্টারে কর্মচারীর চাকরি নিয়েছেন। শুধু জুয়েল রানা নয়, কাজ হারানো এমন হাজার হাজার শ্রমিক অন্যত্র চাকুরি না পেয়ে পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন।
জুয়েল রানা বলেন, চাকরি চলে যাওয়ার পর অনেক কারখানায় নতুন চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু যখনই কোনো কারখানা কর্তৃপক্ষ জানতে পারে আগে বেক্সিমকো কাজ করতাম তখনই না করে দেয়। তাই আর চাকরি জোটেনি। কিন্তু পরিবারের ছয় সদস্যের পেটতো চালাতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে চক্রবর্তী এলাকায় একটি পরিবহন কাউন্টারে কাজ নিয়েছি। কিন্তু যে টাকা রোজগার হয় তা দিয়ে পরিবারের ছয় সদস্যের মুখে খাবার তুলে দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। তিনি দ্রুত কারখানা খুলে দিয়ে শ্রমিকদের পুনর্বহালের দাবী জানিয়েছেন।
২০২৪ সালের ৫ আগষ্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক বন্ধ হয়ে যায়। চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ৪৩ হাজার শ্রমিক। অনেক শ্রমিক আগের চেয়ে কম বেতনে চাকরি পেলেও, হাজার হাজার শ্রমিক এখনো বেকার। অনেকেই চাকরি না পেয়ে চা দোকানে কাজ করছেন। কেউ টিকিট কাউন্টারে, কেউবা অটোরিকশা চালাচ্ছেন, বাজারে সবজি বিক্রি করছেন। অনেকে আবার ছিনতাই, চুরিসহ নানান অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পরছেন।
বাংলাদেশ গামের্ন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইন বিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ভিতরে টেক্সটাইলসহ ১৫টি পোশাক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় প্রায় ৪৩ হাজার শ্রমিক কাজ করে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ৪৩ হাজার শ্রমিকের পরিবারের প্রায় দুই লাখ সদস্য বিপাকে পরেছে। পরিবারের কারো লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অনেকে গ্রামে চলে গেছে। শ্রমিকরা অন্য কারখানায় কাজ না পেয়ে দিনমজুরী করে জিবীকা নির্বাহ করছে। আবার অনেকেই পরিবারের মুখে খাবার জোগাতে চুরি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পরেছেন। একটা সময় দেখা যাবে গাজিপুরের কাশিমপুর ও সারাবোসহ আশপাশ এলাকা অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। তাই দ্রুত বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক সচল করে পুরাতন শ্রমিকদেরকেই চাকুরিতে পুনর্বহালের দাবী জানান এই শ্রমিক নেতা।
সরেজমিনে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আগের সেই মানুষের আনাগোনা নেই। যেখানে শ্রমিকদের ভিড়ে সড়কে হাঁটা কঠিন ছিল, সেখানে এখন শুধুই নীরবতা। শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করে এলাকায় অসংখ্য বাড়িঘর তৈরি করেছিলেন স্থানীয় লোকজন। এখন অনেক বাড়িঘরই খালি পড়ে আছে। চা দোকানগুলোতেও নেই সেই চায়ের কাপের ঝড়। এখন শুধুই শুনশান নিরবতা। সবাই অপেক্ষার প্রহর গুনছেন কবে চালু হবে কারখানা, আবার সেই চিরচেনা রুপে ফিরবে এই এলাকা।
স্থানীয় অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বেক্সিমকো ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পার্ক যখন চালু ছিল তখন শ্রমিকরা স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখেই ছিলেন। অনেকের ছেলে মেয়েকে ভালো মানের স্কুলে পড়াতেন এখন চাকরি চলে যাওয়ার পর তারা অনেক কষ্ট করছেন। অনেকে চেষ্টা করেও অন্যত্র কাজ পাচ্ছেন না। তাই বহু শ্রমিক পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেছেন। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, কারখানা বন্ধের পর এলাকায় চুরি, ছিনতাই বেড়ে গেছে। আগে সারারাতই মানুষ চলাফেরা করতো। এখন ছিনতাই হওয়ার ভয়ে রাত ১০টার পর কেউ বাড়ির বাহিরে বের হয় না।
কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর ও গাজিপুর শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর শুধু বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কই নয়, ছোট-বড় মিলিয়ে অসংখ্য কলকারখানা বন্ধ করে দিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।
চক্রবর্তী বাসস্ট্যান্ডের হোটেল ব্যবসায়ী বাবুল মিয়া বলেন, বেক্সিমকো ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পার্ক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে ব্যবসায় লোকশান গুনতে হচ্ছে। হোটেলে তেমন কোন কাস্টমার নাই। সারাদিনই বসে বসে কাটাতে হয়। তিনি বলেন, যে হোটেলে আগে সিরিয়াল ধরে খাবার খেতে হতো, আজ সেই হোটেল নিরব। তিনি বলেন, কারখানা চালু হলে আমাদের ভাগ্যের চাকা আবার ঘুরবে।
বেক্সিমকো ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পার্কে আয়রন ম্যান হিসেবে কাজ করতেন ইউসুফ। কারখানা বন্ধ হওয়ার পর এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন তিনি। দৈনিক ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা হাজিরায় চক্রবর্তী বাসস্ট্যান্ডে একটি চা-পানের দোকানে কাজ করেন। কিন্তু এই টাকা দিয়ে পরিবারের পাঁচ সদস্যকে নিয়ে চলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। তাই সে দ্রুত কারখানা খুলে দেয়ার দাবী জানিয়েছেন।
মো. পারভেজ বেক্সিমকো ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পার্কে অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। হঠাৎ কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পরেন তার পরিবার। পাঁচ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী পারভেজ দিশেহারা হয়ে পড়েন। কোন উপায় না পেয়ে দিনমজুরের (রাজ মিস্ত্রী) কাজ বেছে নেন। তবে সেখানেও ঘটে বিপত্তি। একদিন কাজ পেলে তিন দিন বসে থাকতে হচ্ছে। তাই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মানবেতর দিন যাপন করছেন তিনি।
মিলন মিয়া নামে এক পথচারী জানান, নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের চক্রবর্তী এলাকা দিয়ে রাত-বিরাতে কত যাতায়াত করেছি কোন সমস্যা হয়নি। অথচ ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের পর বেড়েছে ছিনতাই। তার ধারনা বিভিন্ন মিলকারখানা বন্ধ হওয়ায় শ্রমিকরা কাজকর্ম না পেয়ে ছিনতাইয়ের সাথে জড়িয়ে পরছেন। তবে চুরি, ছিনতাই বৃদ্ধিসহ আইন-শৃঙ্খলার অবনতির বিষয়ে কাশিমপুর থানা পুলিশের কোন কর্মকর্তা কথা বলতে রাজী হয়নি।