
ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। মুখে দামি প্রসাধনীর মেকআপ। পরনে স্লিভলেস ওয়েস্টার্ন পোশাক। পায়ে হাইহিল জুতা। হাতের আঙ্গুলে জ্বলছে সিগারেট। আরেক হাতে মদের গ্লাস। স্টেজে বাজছে ইংরেজি-হিন্দি গান। বিটের তালে তালে কাঁপছে পার্টি রুমের চার দেয়াল। তার সঙ্গে তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, মধ্যবয়সী নারী-পুরুষদের উন্মাতাল ডিজে। কখনো তারা একে ওপরকে জড়িয়ে ধরছেন। কখনো হাতে হাত রেখে নাচছেন। পেশাদার ডিজেদের একের পর এক গান পরিবেশন আর তাদের সঙ্গে নেচে-গেয়ে বিরামহীন উন্মাতাল রাত কাটিয়ে দিচ্ছেন অতিথিরা। যদিও স্বাভাবিকভাবে কারও পক্ষে এভাবে রাতভর ডিজে করে কাটিয়ে দেয়া অসম্ভব। তাই বিরামহীনভাবে রাতভর ডিজে পার্টির জন্য তারা ব্যবহার করেন হ্যাপি ড্রাগ বা পার্টি ড্রাগ বা এমডিএমএ বা এক্সট্যাসি। দেশে বহুদিন ধরে এই ড্রাগটি ব্যবহার হলেও এ নিয়ে ইয়াবার মতো এতো আলোচনা নাই। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এটি ধরা পড়ছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে। ধরা পড়ছেন এটির কারবারে যারা জড়িত। বেরিয়ে আসছে নানা তথ্য।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, এক্সট্যাসি বা এমডিএমএ মূলত পার্টি ড্রাগ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি একটি কৃত্রিম সাইকোঅ্যাকটিভ ড্রাগ ট্যাবলেট বা ক্যাপসুলে পাওয়া যায়। এটি একইসঙ্গে উত্তেজক ও ভ্রমসৃজনকারী প্রভাব সৃষ্টি করে দ্রুত সেরোটোনিন, ডোপামিন ও নর-অ্যাড্রেনালিন মুক্ত করে ব্যবহারকারীকে ইউফোরিয়া, আত্মবিশ্বাস ও সামাজিক ঘনিষ্ঠতার অনুভূতি দেয়। এ ছাড়া আলোসংগীত সংযোগকে তীব্রভাবে অনুভব করায় পার্টি-ডান্স ক্লাবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত এই পার্টি ড্রাগের কারণে রাতভর পার্টিতে বিভিন্ন বয়সী মানুষেরা ডিজে করতে পারেন। ড্রাগ নেয়ার কারণে তারা পার্টিতে খুব আনন্দে সময় কাটায়। তবে অল্প সময় আনন্দ করতে গিয়ে তারা ধীরে ধীরে পার্টি ড্রাগের কুফলে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পার্টি ড্রাগ সাময়িক আনন্দ দিলেও এটি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রতি পিস পার্টি বা হ্যাপি ড্রাগ বিক্রি হয় ৭ থেকে ১০ হাজার টাকায়। ব্যয়বহুল এই ড্রাগটি মূলত তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী ও মধ্যবয়সীরা ব্যবহার করেন। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে চাকরিজীবী, চিকিৎসক, উচ্চপদস্থ সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, বিদেশফেরত শিক্ষার্থী, অভিনেতা-অভিনেত্রী, শিল্পী, মডেল, পেশাদার ডিজে, ব্যবসায়ীরা। তবে ড্রাগটি ব্যয়বহুল হওয়াতে কেবলমাত্র এলিট শ্রেণি ও অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ও ডিজে পার্টির প্রতি যাদের আগ্রহ আছে এবং নিয়মিত যারা পার্টিতে যাওয়া-আসা করে তারাই এটি ব্যবহার করেন। ঢাকার গুলশান, বনানী, উত্তরা, বারিধারা এলাকায় যেসব ডিজে পার্টির আয়োজন করা হয় সেখানেই মূলত পার্টি ড্রাগ ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকার কয়েকটি রিসোর্ট হোটেল মোটেলে ডিজে পার্টির আয়োজন করা হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আরও দুয়েকটি দেশ থেকে পার্টি ড্রাগ আনা হয়। পার্টি ড্রাগ মূলত ‘খ’ শ্রেণির মাদক। সম্প্রতি যে চালানটি আনা হয়েছে সেটি যুক্তরাজ্য থেকে পাঠিয়েছে অরণ্য নামের এক ব্যক্তি। তার মাধ্যমেই এটি আনা হতো। ডিএনসি ঢাকা মেট্রো উত্তর সম্প্রতি যে চালান জব্দ করেছে সেটিতে ৩১৭ পিস পার্টি ড্রাগ ছিল। যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারাই মূলত এটি ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতো। বিদেশ থেকে এনে তারা উচ্চমূল্য দেশে বিক্রি করতো। এটির চাহিদাও ব্যাপক। দেশে আনার ক্ষেত্রে তারা কুরিয়ার সার্ভিস ও বিমানপথকে বেছে নিতো।
ডিএনসি’র কর্মকর্তারা বলেন, আমাদের কাছে তথ্য ছিল গ্রেপ্তার মো. জুবায়ের (২৮) স্বনামধন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া শিক্ষার্থী, প্রযুক্তি দক্ষ, শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির আরোও বেশ কয়েকজনের একটি চক্র পার্টি ড্রাগ, কুশ, গাঁজা, কিটামিনসহ অন্যান্য আধুনিক মাদক পার্সেলযোগে উন্নত দেশ থেকে আমদানি করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন মহানগরে বিভিন্ন ডিজে পার্টিতে এবং অভিজাত সোসাইটিতে সরবরাহ করছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে পুরাতন ডাক ভবনের বৈদেশিক ডাক শাখা থেকে যুক্তরাজ্য থেকে আগত এয়ার পার্সেল তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিতে একটি কাগজের কার্টনের ভেতর বিভিন্ন বিদেশি ব্রান্ডের চকলেটের নিচে লুকানো অবস্থায় একটি পেপারে মোড়ানো স্বচ্ছ পলি প্যাকেটে রক্ষিত লালচে বর্ণের পার্টি ড্রাগ ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। জব্দ করা কাগজপত্র পর্যালোচনা ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় পার্সেলটির রিসিভার মাদক চক্রের অন্যতম হোতা মো. জুবায়েরের অবস্থান শনাক্ত করে ঢাকা উদ্যান এলাকা থেকে আটক করা হয়। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে জানায়, পার্সেলটি যুক্তরাজ্য থেকে তার পূর্বপরিচিত অরণ্য ডাকযোগে অরণ্যের বন্ধু অপূর্ব রায়ের নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করে পাঠিয়েছে। রিসিভ করে তার আরেক বন্ধু জি এম প্রথিত সামস্-এর নিকট পৌঁছে দেয়ার জন্য অনুরোধ করে। এর বিনিময়ে তাকে ৫০ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়। কাজটি করার জন্য অরণ্যর কথায় প্রথিত সামস তাকে বিকাশের মাধ্যমে তিনবারে ১৫-১৬ হাজার টাকা অগ্রিম দেয়। পরে জুবায়েরের তথ্যমতে প্রথিত সামস (২৫) এর অবস্থান শনাক্ত করে তাকে সেগুনবাগিচা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার কাছ থেকে যুক্তরাজ্য থেকে আমদানিকৃত পার্টি ড্রাগ, গাঁজা ও কিটামিন নামক মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়। জুবায়ের এবং জি এম প্রথিত সামসকে গ্রেপ্তারের পর আসিফ মাহবুব চৌধুরীর বাসা ঘেরাও করে তাকে হাতেনাতে এমডিএমএ, গাঁজা, কুশ ও নগদ টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। পরে অপূর্ব রায়কে (২৫) গাঁজাসহ গ্রেপ্তার অপূর্বের দেয়া তথ্য মতে সৈয়দ শাইয়ান আহমেদকে (২৪) গাঁজা ও পার্টি ড্রাগ ও চালানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণাদি জব্দ করে গ্রেপ্তার করা হয়।
ডিএনসি কর্মকর্তারা বলেছেন, যে চক্রটিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মধ্যে প্রথিত সামস একজন পেশাদার ডিজে। অভিজাত ঘরের সন্তান সামস দীর্ঘদিন ধরে ডিজে পার্টির সঙ্গে জড়িত।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, পার্টি ড্রাগ সেবন করলে হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। অতিরিক্ত উত্তাপে ডিহাইড্রেশন বা ইলেক্ট্রোলাইট ভ্রান্তি হতে পারে যা প্রাণঘাতী লিভার ও কিডনির সমস্যা, পেশির টান, খিঁচুনি ও দৃষ্টি ঝাপসা দেখা যেতে পারে। অতিরিক্ত ডোজে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে অঙ্গপ্রতঙ্গ বিকল বা হৃদরোগ স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। অতিরিক্ত ব্যবহারে জীবনহানির শঙ্কা থেকে যায়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকামেট্রো উত্তরের উপপরিচালক মো. মেহেদী হাসান মানবজমিনকে বলেন, এনক্রিপ্টেড অ্যাপ ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে তারা এই ব্যবসা করতো। ঢাকায় এলিটদের জন্য যেসব পার্টি আয়োজন করা হতো সেখানে তারা সরবরাহ করতো। আমরা এ সংক্রান্ত অনেক তথ্যপ্রমাণ পেয়েছি। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তাদের মোবাইলে থাকা অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছি। আরও অনেকের সংশ্লিষ্টতা আমরা পেয়েছি। তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে।