Image description

বাংলাদেশের রপ্তানি তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। রপ্তানিতে এ খাতের অবদান প্রায় ৮৫ শতাংশ। এ খাতটি বিকাশের পেছনে রয়েছে সরকারের দেওয়া নানা সুযোগ-সুবিধা। এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তৈরি পোশাক খাতের মতো আরো আট খাতকে একই ধরনের সুবিধা দেওয়ার বিষয় বিবেচনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। খাতগুলো হলো—চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হালকা প্রকৌশল, প্লাস্টিক পণ্য, আইসিটি, অ্যাগ্রো প্রসেসিং খাত, মৎস্য ও হিমায়িত খাদ্য ও ফার্মাসিউটিক্যালস।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণে প্রস্তুতি পর্যালোচনাবিষয়ক সভার কার্যবিবরণী সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। গত ৩০ জুলাই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের সভাকক্ষে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। গত ১১ আগস্ট কার্যবিবরণীতে সই করেন প্রধান উপদেষ্টা। এর আগে চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল ও ১১ মে এলডিসি থেকে উত্তরণে পর্যালোচনা কমিটির আরো দুটি বৈঠক হয়। বৈঠকগুলোতে তৈরি পোশাক খাতের মতো অন্যান্য রপ্তানি খাতে সহযোগিতা ও প্রণোদনা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। তারই আলোকে আট খাতে সুবিধা দেওয়া যেতে পারে বলে বৈঠকে মত প্রকাশ করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০ বা ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা রয়েছে প্রধান উপদেষ্টার। প্রধান উপদেষ্টার সম্মতি পাওয়া গেলে ওই সফরসূচির আগে এলডিসি থেকে উত্তরণে পর্যালোচনা কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। তা না হলে প্রধান উপদেষ্টা দেশে ফেরার পর বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের আগে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক প্রস্ততিমূলক সভা অনুষ্ঠিত হয়।

প্রস্তুতিমূলক সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে জানান, রপ্তানিতে তৈরি পোশাক খাত যে ধরনের সুবিধা ভোগ করছে, তার সঙ্গে অন্য খাতগুলো কী ধরনের সুবিধা পাচ্ছে, এ বিষয়ে একটি তুলনামূলক ছক তৈরি করা হচ্ছে। এনবিআরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এটি তৈরি করবে। পর্যালোচনা কমিটির আগামী বৈঠকে এটি উপস্থাপন করা হবে। বৈঠকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে।

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানি তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। একক পণ্য নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতগুলোকে তৈরি পোশাক খাতের মতো সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সব খাতকে একই সুবিধা দেওয়া হতে পারে কিংবা খাতভিত্তিক সম্ভাবনার বিষয়টি বিবেচনা করে সুবিধার ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্যও হতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, রপ্তানিমুখী অন্যান্য খাতগুলোকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি আরো আগেই বিবেচনা করা উচিত ছিল। তাহলে পোশাক খাতের একক নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে সক্ষম হতো বাংলাদেশ। এছাড়া দেশের অন্যান্য খাতেও বিনিয়োগ বাড়ত, সৃষ্টি হতো কর্মসংস্থান। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয়ও বাড়ত। তবে দেরিতে হলেও এ উদ্যোগটি আগামী দিনে সুফল বয়ে আনবে। তৈরি পোশাক খাত থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় করলেও এ শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল- সুতা, কাপড় বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এতে বাংলাদেশের নিট আয়ের পরিমাণ খুব বেশি নয়। তবে অন্য যেসব খাত রয়েছে, এগুলোর কাঁচামালের বড় অংশই দেশে উৎপাদিত হয়। ফলে এসব খাতকে সুবিধা দেওয়া হলে নিট আয়ের দিকে বাংলাদেশ অনেক বেশি লাভবান হবে।

আগামী বছরের ২৬ নভেম্বর স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ করার কথা রয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অস্ত্রছাড়া সব ধরনের পণ্য রপ্তানিতে ইউরোপের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করছে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটলে শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে না। তবে উত্তরণ হওয়ার পর আরো তিন বছরের জন্য এ সুবিধা বহাল থাকবে।

শুল্কমুক্ত সুবিধা হারালে রপ্তানিতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এলডিসি থেকে উত্তরণের সময় আরো তিন থেকে পাঁচ বছর পিছিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এলডিসি থেকে উত্তরণের সময় পিছিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ আর নেই। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্থাৎ আগামী বছরের নভেম্বর মাসেই বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটবে। আর উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সে প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই রপ্তানি খাতগুলোকে সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি শামিম আহমেদ আমার দেশকে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে সব ধরনের রপ্তানিকারকদের জন্য একই সুবিধা দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু এটা এখনো সমভাবে কার্যকর হচ্ছে না। এখন যদি সব রপ্তানিকারকরা একই সুবিধা পান, তাহলে এটি রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অবশ্য প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানিতে তৈরি পোশাক খাতের মতো বন্ডেড ওয়্যারহাউস, ব্যাক টু ব্যাক এলসি, নগদ প্রণোদনা ও করপোরেট করের ক্ষেত্রে সুবিধা ভোগ করছে। তবে তৈরি পোশাক খাতের কোম্পানিগুলো তাদের কারখানার খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক সুবিধা পেলেও প্লাস্টিক খাত এ সুবিধা পাচ্ছে না।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারিকুল ইসলাম জাহের আমার দেশকে বলেন, রপ্তানিতে আমরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। নগদ প্রণোদনা ছাড়া আমরা আর কোনো সুবিধা পাচ্ছি না।

মাছের উৎপাদন কমছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, আমরা মাছ আমদানির অনুমতি চেয়েছি, কিন্তু দেওয়া হচ্ছে না। মাছের অভাবে একের পর এক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তৈরি পোশাক খাতের মতো এ খাতকেও সুবিধা দেওয়া হলে রপ্তানি তিন বিলিয়ন থেকে ২০ ডলারে উন্নীত হবে।

জানা গেছে, রপ্তানিতে বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধার অপব্যবহারের কারণে বিকল্প ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। এ ব্যবস্থায় বন্ড লাইসেন্স ছাড়াই শুধু ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি করতে পারবে।