Image description

বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) এবং এর অধীনস্থ কয়েকটি প্রকল্পে ব্যাপক আর্থিক হরিলুট হয়েছে। প্রকল্পগুলোর পরিচালকরা রাষ্ট্রের টাকা নয়ছয় করে নিজদের পকেট ভারী করেছেন। প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে অনিয়ম ও বিধি-বিধানের তোয়াক্কা না করে সরকারের ১৯২ কোটি টাকার উপরে তছরুপ করেছে বলে সরকারি অডিটে উঠে এসেছে। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) এবং এর অধীনস্থ প্রকল্পসমূহের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের অডিট সম্পন্ন করে নিরীক্ষা দল কর্তৃক  ১২৩টি অডিট আপত্তি উত্থাপন করে। যার বিপরীতে টাকার পরিমাণ ১৯২ কোটি ৫১ লাখ ৮৫ হাজার ৮৩৪ টাকা। তার মধ্যে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম হিসেবে চিহ্নিত করে ৭৯টি আপত্তি (অনুচ্ছেদ)কে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর চলতি বছরের ১৯শে ফেব্রুয়ারি কৃষি ও পরিবেশ অডিট অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত অডিট প্রতিবেদন প্রেরণ করা হয়।  ৭৯টি আপত্তির আর্থিক জড়িত টাকার পরিমাণ ১৩৬ কোটি ৬৫ লাখ ৯৯ হাজার ৯৬৬ টাকা। অবশিষ্ট ৪৪টি আপত্তি সাধারণ আপত্তি হিসেবে গণ্য করে ডিজি, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে সরাসরি জবাব চাওয়া হয়। ১২৩টি আপত্তির মধ্যে ২১টি আপত্তি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ এবং  সরকারের আর্থিক ক্ষতি বিবেচনা করে চলতি বছরের ২৮শে মে কৃষি ও পরিবেশ অডিট অধিদপ্তরের পরিচালক নূর-ই-ফেরদৌস স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রণ (সিএজি) কার্যালয়ে পাঠানো হয়। অডিট রিপোর্টের কপিটি মানবজমিন’র কাছে রয়েছে।

অনিয়মের ধরনে দেখা য়ায়, প্রকৃত বাজারমূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে কৃষি যন্ত্র ক্রয়, যোগসাজশের মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করে ক্রয়কার্য সম্পাদন, আউটসোর্সিংয়ে অনিয়ম, ল্যাবের জন্য ক্রয়কৃত যন্ত্র সরেজমিন পরিদর্শনে পাওয়া যায়নি, দরপত্রে দাখিলকৃত কান্ট্রি অব অরিজিন এর স্বপক্ষে ডকুমেন্টস সরবরাহ না করা সত্ত্বেও ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করার মতো বহু অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোর পরিচালকরা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরীক্ষাকালে বেশ কিছু আর্থিক অনিয়ম ও বিধি-বিধানের ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হয়েছে। মূলত প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতা ও আর্থিক বিধি-বিধান পরিপালন না করার কারণে এই অডিট অনুচ্ছেদসমূহ উত্থাপিত হয়েছে। অডিট অনুচ্ছেদগুলোর মধ্য হতে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম (এসএফআই) সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমূহ এই রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এই রিপোর্টে ২১টি অডিট অনুচ্ছেদ রয়েছে এবং এতে জড়িত টাকার পরিমাণ ৫১ কোটি ৯৪ লাখ ৫ হাজার ৫৩৭ টাকা। এই রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত উল্লেখযোগ্য অনিয়মগুলো হচ্ছে-

অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র লঙ্ঘন করে উচ্চতর গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করে বেতন ও ভাতা পরিশোধ। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আদেশের শর্ত লঙ্ঘন করে ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমাধারী না হওয়া সত্ত্বেও উন্নীত গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করে বেতন ও ভাতা পরিশোধ। ডিপিপি এবং দরপত্রে উল্লিখিত স্পেসিফিকেশন বহির্ভূতভাবে এলএলপি এবং ঈড়ভভবব চঁষঢ়রহম গধপযরহব ক্রয়। আরডিপিপি এবং প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা অনুযায়ী ভর্তুকিযোগ্য কৃষি যন্ত্র না হওয়া সত্ত্বেও ৭০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্ধারিত হার অপেক্ষা কম হারে উৎসে আয়কর ও ভ্যাট কর্তন করায়/কর্তন না করায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি। চুক্তিপত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে ঈড়ঁহঃৎু ঙভ ঙৎরমরহ বহির্ভূত যন্ত্রপাতি ক্রয় করে সরবরাহকারীকে বিল পরিশোধ। মেজারমেন্ট ব্যতীত পলিনেট হাউজ নির্মাণের বিল প্রদান। সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে বিভিন্ন খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ খাত বহির্ভূত পণ্য/সেবা ক্রয়। প্রকৃত বাজার মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে কৃষি যন্ত্র ক্রয়। প্রকৃত বাজার মূল্য অপেক্ষা অতিরিক্ত মূল্যে প্রাক্কলন প্রস্তুত করে যোগসাজশের মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করে ক্রয়কার্য সম্পাদন। 

ল্যাব যন্ত্রপাতি ইনস্টল না করে প্যাকেটবন্দি অবস্থায় ফেলে রাখায় সরকারের অপচয়। বাস্তবায়ন নির্দেশিকার শর্ত ভঙ্গ করে ফলোআপ বীজ কৃষকের নিকট হতে ক্রয় না করে ভিন্ন উৎস হতে ক্রয়। আউটসোর্সিং নীতিমালা-২০১৮ এর নির্দেশনা অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন বাতিরেকে সরবরাহকারীকে পরিশোধ। ল্যাবের জন্য ক্রয়কৃত যন্ত্র সরজমিন পরিদর্শনে পাওয়া যায়নি। মাটি ভরাটের পরিমাণ থেকে উত্তোলিত মাটির পরিমাণ বাদ না দিয়ে বিল পরিশোধ। প্রদর্শনী বাস্তবায়ন ও মাঠ দিবস নির্দেশিকা অনুসরণ না করে প্রদর্শনী খামার বাস্তবায়ন। দরপত্রে দাখিলকৃত কান্ট্রি অব অরিজিন এর স্বপক্ষে ডকুমেন্টস সরবরাহ না করা সত্ত্বেও ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ। সয়েল টেস্ট রিপোর্ট প্রদানের আগেই প্রাক্কলন প্রস্তুতপূর্বক অনুমোদন এবং যথাযথভাবে মালামাল পরীক্ষা না করে পূর্ত কাজের বিল পরিশোধ। প্রদর্শনীর জন্য প্রকল্প দপ্তর হতে জৈব সার ক্রয়পূর্বক অনিয়মিতভাবে পরিশোধ। প্রকল্প মাঠ নির্দেশিকা ও ডিপিপি’র শর্তানুযায়ী যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে মাঠ দিবস অনুষ্ঠান পালন। আরডিপিপি’র নির্দেশনা অমান্য করে কৃষক গ্রুপে কম পরিমাণ এলএলপি ফিতা পাইপ বিতরণ করায় অনিয়মিত ব্যয়।

প্রতিবেদনে দেখা যায়,  কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আওতাধীন তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প এবং আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলের কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প কর্তৃক ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে প্রকৃত বাজারমূল্য অপেক্ষা অতিরিক্ত মূল্যে প্রাক্কলন প্রস্তুত করে যোগসাজশের মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করে  ক্রয়কার্য সম্পন্ন করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৫ কোটি ১৯ লাখ ৮১ হাজার ৩১৮ টাকা। প্রকল্প পরিচালক, আধুনিক প্রযুক্তি সমপ্রসারণের মাধ্যমে রাজশাহী বিভাগের কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প (ডিএই), রাজশাহী কর্তৃক ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে প্রকৃত বাজারমূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে কৃষি যন্ত্র ক্রয় করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি ১ কোটি ২৫ লাখ ৫৩ হাজার ৮০০ টাকা। 

ক্লাইমেট-স্মার্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে খুলনা অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন প্রকল্পে এবং কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প  কর্তৃক ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ডিপিপি এবং দরপত্রে উল্লিখিত স্পেসিফিকেশন বহির্ভূতভাবে এলএলপি এবং ঈড়ভভবব চঁষঢ়রহম গধপযরহব ক্রয় করায় ৬ কোটি  ১৪ লাখ ৯৭ হাজার টাকা অনিয়মিত ব্যয় হয়েছে। রাজশাহী বিভাগে  একই অর্থবছরে  আরডিপিপি এবং  কার্যক্রম নির্দেশিকা অনুযায়ী ভর্তুকিযোগ্য কৃষি যন্ত্র না  হওয়া সত্ত্বেও ৭০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যে যন্ত্রপাতি বিতরণ করায়  ৩ কোটি ১৫ লাখ ৯৯ হাজার  ৩৬৭ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে স্থাপিত উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর প্রকল্প কর্তৃক ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ঢাকার কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজের বিভিন্ন ল্যাবের জন্য ক্রয়কৃত যন্ত্রপাতিসমূহের মধ্যে ১ কোটি ৪৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের যন্ত্র সরজমিন পরিদর্শনে পাওয়া যায়নি। কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের আওতাধীন ‘কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে স্থাপিত উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর প্রকল্প’ কর্তৃক ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সয়েল টেস্ট রিপোর্ট প্রদানের পূর্বেই প্রাক্কলন প্রস্তুতপূর্বক অনুমোদন এবং যথাযথভাবে মালামাল পরীক্ষা না করে পূর্ত কাজের বিল পরিশোধে ২ কোটি ৭৩ লাখ ৭ হাজার ১৪৮ টাকা অনিয়মিতভাবে ব্যয় করা হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থবিভাগ, ব্যয় ব্যবস্থাপনা-৩ শাখা এর আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবাগ্রহণ নীতিমালা, ২০১৮ এর ক্রমিক নং ৩ (২) মোতাবেক অর্থমন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ব্যতিরেকে সেবা সরবরাহকারীরকে বিল প্রদান করায় ৬২ লাখ ৬৫ হাজার ৪৪৬ টাকা অনিয়মিতভাবে ব্যয় করা হয়েছে।
একজন কর্মকর্তা জানান, যে সমস্ত আপত্তি সিএজি কার্যালয়ে প্রেরণ করা হয় ওই সকল আপত্তি মহাপরিচালকগণের নিষ্পত্তি করার এখতিয়ার রাখেন না। কিন্তু কৃষি ও পরিবেশ অডিট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কেএম সিরাজুল মুনির ওই সমস্ত আপত্তি নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নিচ্ছেন।

উল্লেখ্য যে, এই কেএম সিরাজুল মুনির সম্প্রতি কৃষি ও পরিবেশ অডিট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এর আগে ২/৩ মাস তিনি এই অফিসের অতিরিক্ত দায়িত্বে (২৫শে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ থেকে ১৯শে আগস্ট ২০২৫) মহাপরিচালক ছিলেন। ডিএই’র সেসব প্রকল্পে বেশি অনিয়ম বা অডিট আপত্তি আছে সেসব প্রকল্পের পিডিরা প্রতিদিনই তার দপ্তরে হাজিরা দিচ্ছেন। 
কেএম সিরাজুল মুনির বিসিএস-১৮ ব্যাচের অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ক্যাডারের একজন সদস্য। তিনি বিগত সরকারের আমলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি বৃহৎ প্রকল্পে প্রেষণে পরামর্শক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। 

২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আপত্তি তিনি নিষ্পত্তি করেছেন। নিষ্পত্তির জন্য যে সমস্ত বিধিবিধান বা প্রমাণ থাকা প্রয়োজন কোনো কিছুই নেই। অধঃস্তন কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বাধ্য করে তিনি ফাইল উপস্থাপন করিয়ে নিষ্পত্তি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। 

বিভিন্ন প্রকল্পের অডিট নিষ্পত্তি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কৃষি ও পরিবেশ অডিট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কেএম সিরাজুল মুনির মানবজমিনকে বলেন, আইনের বাইরে কাজ করার ক্ষমতা তার নেই। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, কেউ ভুল করে থাকলে দেখবো না?