Image description
ভোটাধিকার থাকলেও নির্বাচনে ‘অযোগ্য’ সরকারি চাকরিজীবী

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না সরকারি চাকরি থেকে অবসরগ্রহণকারী ব্যক্তিরা। নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পরও তাদের অপেক্ষা করতে হবে আরো তিন বছর। এ ক্ষেত্রে পর্বতের মতো বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ-২০০৮ একটি ধারা। ওয়ান-ইলেভেন-পরবর্তী সরকার একটি বিশেষ উদ্দেশে অধ্যাদেশটি জারি করলেও আ.লীগ সরকার সেটি সংসদে বাতিল করেনি। এতে খর্ব হচ্ছে নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। বিষয়টি উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের অনুগত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ রিটটি খারিজ করে দেন।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ভোটাধিকার প্রয়োগ এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ দেশের সংবিধান স্বীকৃত নাগরিক অধিকার। সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদ, ৩৯ অনুচ্ছেদ ১১৮ অনুচ্ছেদে নাগরিকের এই অধিকারের প্রসঙ্গত বিধৃত রয়েছে।

আন্তর্জাতিক কনভেনশন এবং ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের প্রথম অংশে নাগরিকের রাজনীতি করার অধিকার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশ সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে এ অধিকার নাগরিকরা উপভোগ করে আসছিলেন। ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ (নির্বাচন) অধ্যাদেশ বাতিল করে ১৯৭২ সালের ২৬ ডিসেম্বর গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ করা হয়। ওই অধ্যাদেশ অনুযায়ী, দেশের মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার উপভোগ করে আসছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে ওয়ান-ইলেভেন-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার গণপ্রতিধিত্ব আদেশ (সংশোধন) অধ্যাদেশ করে। পরবর্তীতে আ.লীগ সরকার ২০০৯ সালে এটি সংসদে আইনে পরিণত করে। অধ্যাদেশের যৌক্তিকতায় দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে আরো আধুনিক ও সুসংহত করার পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে নাগরিকদের একটি অংশের সাংবিধানিক অধিকারকে (নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা) রহিত করা হয়। বলা হয়, সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের তিন বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জাতীয় কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। এর ফলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সামরিক-বেসামরিক সব শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী অবসরের পরপরই প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতা হারান।

অর্থাৎ, একজন সরকারি চাকরিজীবী নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন, নির্বাচন কমিশনের হয়ে অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। অথচ তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। যা সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন বলে মনে করছেন কোনো কোনো আইন বিশ্লেষক। তাদের দৃষ্টিতে সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’র কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ অথচ নির্বাচনে সরকারি চাকরিজীবীদের ‘অযোগ্যতা’র বিষয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)-১৯৭২ এর ১২ (১) (চ) ধারায় বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের বা প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগের কোনো চাকরি থেকে পদত্যাগ করেছেন বা অবসরে গেছেন এবং এ পদত্যাগ বা অবসর যাওয়ার পর তিন বছর অতিবাহিত না হয়ে থাকে। এই বিধানকে সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দাবি করে পৃথক চারটি রিট হয়। রিটের শুনানি শেষে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের ১২ (১) (চ) ধারা কেন সংবিধানপরিপন্থী এবং অবৈধ ঘোষণা করা হবে নাÑ এই মর্মে পৃথক রুল রুল জারি করেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শামীম কামাল, মো. আব্দুল মান্নান, আতাউর রহমান প্রধান ও রতন চন্দ্র প-িত রিটগুলোর বাদী। আইন, বিচার ও সংসদ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়েল সচিব, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, জনপ্রশাসন সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়।

রিটগুলোর সব রুলের চূড়ান্ত শুনানি হয় একসঙ্গে। শুনানি শেষে বিচারপতি নাইমা হায়দার এবং বিচারপতি কাজী জিনাত হকের তৎকালীন ডিভিশন বেঞ্চ ২০২৩ সালের ৪ ডিসেম্বর সব রিট খারিজ করে দেন। রিট পিটিশনারদের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর, অ্যাডভোকেট প্রবীর নিয়োগী ও মোহাম্মদ সাঈদ আহমেদ রাজা। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ। সরকারপক্ষে শুনানি করেন তৎকালিন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাসগুপ্ত। পরে ওই খারিজাদেশের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেন বাদীপক্ষ। আগামি ৩১ আগস্ট বিষয়টি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন মামলাটির আইনজীবী ব্যারিস্টার রূহুল কুদ্দুস কাজল।

আরপিও অধ্যাদেশ-২০০৮ (সংশোধন)র ১২(১) (চ) ধারা সংবিধানের সমতাবিষয়ক অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি-না জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে অধ্যাদেশটি সংশোধ করা হয়েছিল। এমন একটি প্রবণতা তৈরি হয়েছিল যে, সরকারি পদস্থ কর্মকর্তারা অবসরগ্রহণের পরপরই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে শুরু করেন। এতে করে নির্বাচন পরিচালনায় নিয়োজিত প্রশাসনে ওই প্রার্থীর সরাসরি প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন। তারা প্রশাসনকে নিজের সুবিধামতো করে ব্যবহার শুরু করেন। এমন দেখা যেত যে, নির্বাচন এলেই সরকারি পদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে এমপি পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে পড়তেন। প্রশাসনের আনুকূল্য নিয়ে তিনি হয়তো এমপিও নির্বাচিত হতেন। এতে অন্য প্রার্থীদের জন্য সমান সুযোগ লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন। এ প্রেক্ষাপটে আরপিও সংশোধন করে এ ধারা সংযুক্ত করা হয়। ধারাটি চ্যালেঞ্জও হয়েছিল। কিন্তু হাইকোর্ট রিট খারিজ করে দিয়েছেন। ফলে আরপিও ১২(১) (চ) ধারা এখনো বহাল রয়েছে।

তিনি বলেন, সরকারি চাকরিজীবী তো একটি পেশায় রয়েছেন। তিনি তার পেশায় হয়তো দক্ষ। অন্যদিকে রাজনীতিবিদ তার জায়গায় দক্ষ। সরকারি চাকরিজীবীকে কেন রাজনীতিতে আসতে হবে?
এদিকে সাবেক ছাত্রনেতা প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী মর্তুজা অধ্যাদেশের এই ধারাটির ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিন বলছেন, এই ধারাটি কি সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও সমান সুযোগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? নাকি এটি রাজনৈতিকভাবে তৈরি এক ধরনের বাঁধা। যাতে মেধাবী, দক্ষ এবং অভিজ্ঞ নাগরিকদের রাজনীতিতে প্রবেশ করাটাকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছেÑ রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার সমান এবং তিনি যেকোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন। কিন্তু আরপিও ও ২০০৮ সালের সংশোধনী নাগরিকের সেই অধিকারকে খর্ব করেছে। সরকারি চাকরি থেকে কোনো ব্যক্তি যখন অবসর নেন কিংবা অব্যাহতি নেন তখন কেন তাকে আরো তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করার জন্য?

একজন বাংলাদেশি নাগরিক তার চাকরিজীবনে দেশের জন্য কাজ করেন, অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সেই অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের প্রয়োগ যদি অবিলম্বে রাজনীতির অঙ্গনে প্রয়োগ করা যায়, তবে দেশ ও দেশের মানুষ দ্রুত লাভবান হবে। অথচ ২০০৮ সালে ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের সময় আরপিওতে সংযোজিত এই বিধান দেশ ও দেশের মানুষকে বঞ্চিত করেছে।

একটি নিবন্ধে সাবেক এই ছাত্রনেতা বলেন, বাংলাদেশের পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোতে আমরা ভিন্ন চিত্র দেখেছি। নব্বইয়ের দশক ও ২০০০ সালের পরবর্তী সময়ে বহু সরকারি কর্মকর্তা অবসরের পর সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তারা তাদের সেক্টরভিত্তিক অভিজ্ঞতা রাজনীতিতে ব্যবহার করেছেন, যা ছিল জনকল্যাণমূলক ও ফলপ্রসূ।

একজন বাংলাদেশি নাগরিক তার চাকরিজীবনে দেশের জন্য কাজ করেন, অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সেই অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের প্রয়োগ যদি অবিলম্বে রাজনীতির অঙ্গনে প্রয়োগ করা যায়, তাহলে দেশ ও দেশের মানুষ দ্রুত লাভবান হবে। অথচ ২০০৮ সালে ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের সময় আরপিওতে সংযোজিত এই বিধান দেশ ও দেশের মানুষকে বঞ্চিত করেছে।

এদিকে এ বিতর্কের মধ্যেই গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ-১৯৭২ (সংশোধন) অধ্যাদেশ আবারো সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে অধ্যাদেশটির খসড়া-২০২৫ চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন। খসড়ায় নির্বাচন বাতিলের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা চূড়ান্ত হলে নির্বাচনে কোনো আসনের ভোট নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ওই আসনের পুরো ভোট বাতিল করতে পারবে নির্বাচন কমিশন।