
সাদাপাথর লুটের সময় লুট হয়েছে জাফলংয়ের শূন্যরেখার পাথর। হাজার হাজার শ্রমিক নৌকা নিয়ে ওই এলাকায় গিয়ে পাথর লুট করে। মাত্র চার দিনে লুটে নেয়া হয়েছে ৫০ কোটি টাকার পাথর। আর এই পাথর লুট থেকে চাঁদা আদায় করা হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। ঘটনার জন্য জাফলংয়ের ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের দায়ী করা হলেও তারা বলছেন; লুটের ঘটনার নেতৃত্বে ছিল পুলিশ প্রশাসন। জাফলং থেকে বদলি হওয়া গোয়াইনঘাট পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর এসআই ওবায়দুল্লাহ ও উৎসব কর্মকার ছিলেন লুটের নেপথ্যে। তবে আশার কথা হলো; সাদাপাথরের মতো জাফলংয়ের পাথর শূন্য করার আগেই উপজেলা প্রশাসন সক্রিয় হওয়ায় আপাতত রক্ষা পেয়েছে দেশের অন্যতম এ পর্যটন এলাকা। জাফলং শূন্য পয়েন্ট। সব পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ ওই এলাকা। কিন্তু পাথরখেকোদের কাছে অন্য কারণে জায়গাটি পছন্দের। সারি সারি পাথরের স্তূপ থাকায় ওখানে চোখ তাদের।
সুযোগ পেলেই লুট শুরু করেন। এবার প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল ৫ই আগস্টের পর থেকে কয়েকদিন। হাজার হাজার শ্রমিক দিয়ে ওই এলাকার পাথর লুট করা হয়। এবার আগস্টের প্রথম সপ্তাহ। কয়েকদিন টানা বৃষ্টিপাত হয়। এ সময় ঢলও নামে উজান থেকে। আর এই সুযোগে সাদাপাথরের মতো জাফলংয়ের পাথরও লুটপাট করা হয়। প্রথম দু’দিন রাতের আঁধারে। এরপর দিনেও চলে পাথর লুট। প্রতিদিন অন্তত ৩শ’ ট্রাক্টর ও ট্রাক ও কয়েকশ’ নৌকা নিয়ে ওই এলাকায় পাথর লুটপাট চালানো হয়। এভাবে চলে টানা চারদিন। বিষয়টি নজরে আসে উপজেলা প্রশাসনের। চালানো হয় অভিযান। বন্ধ হয় লুটপাট। লুটপাটের পর সিলেট ও গোয়াইনঘাটের উপজেলা প্রশাসনের তরফ থেকে একাধিক স্থানে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয় জাফলং থেকে লুট হওয়া পাথর। স্থানীয় বল্লাঘাট, মামার দোকান এলাকার ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিক নৌকা দিয়ে ওই পাথর লুট করে। লুট করা প্রতি নৌকা থেকে শেল্টারদাতারা ৩ হাজার টাকা ও বিজিবি’র নামে ১২০০ টাকা আদায় করা হয়। আর এই টাকার ভাগ যায় বর্তমানে জাফলংয়ের দু’পাড়ের নেতৃত্বে থাকা নেতাদের কাছে। তারা জানান- ৫০ কোটি টাকার পাথর লুটের ৪-৫ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়েছে। এই চাঁদার বেশির ভাগ টাকা নেয় পুলিশ। লুটের সময় ওই এলাকায় সরাসরি অবস্থান ছিল বদলি হওয়া এসআই ওবায়দুল্লাহ, মোবারক ও উৎসব কর্মকারের। লুটের টাকার ভাগ যায় রাজনৈতিক নেতা ও পরিবহন শ্রমিক নেতাদের কাছে।
পাথর লুটের ঘটনায় দুদক যে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সেখানে এসেছে সিলেট জেলা বিএনপি’র পদ হারানো নেতা শাহপরান ও পূর্ব জাফলং বিএনপি’র সভাপতি আমজাদ বক্সের নাম। তবে তারা এ লুটের কথা অস্বীকার করেছেন। আমজাদ বক্স বুধবার বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন- লুটের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল পুলিশ কর্মকর্তারা। তারাই নেতৃত্ব দিয়ে এই লুটপাট চালিয়েছে। লুটের সিংহভাগ টাকা তাদের পকেটে গেছে। আর দোষ দেয়া হচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের। তিনি বলেন- জাফলং বাড়ি হওয়ার কারণে অনেক সময় অনেক দুর্নাম না করেও মাথা পেতে নিতে হয়। এবারো তাই হচ্ছে। তবে পাথর লুটের সময় তিনি নিজে ওই এলাকায় গিয়ে বাধা দিয়েছেন বলে জানান। এদিকে- লুটের ঘটনায় এসেছে পরিবহন শ্রমিক নেতা সমেদ আহমদ ও সোহাগ আহমদের নাম। এ ছাড়া স্থানীয় ইসমাইল, ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন আনু, রাজ্জাক, কালা আলিমসহ কয়েকজন জড়িত থাকার কথা জানিয়েছেন বল্লাঘাটের ব্যবসায়ীরা। তারা জানিয়েছেন- জাফলং লুটের সময় জেলা পরিষদ ডাক বাংলোর নিচের এলাকাসহ মোট ১৮টি পয়েন্টে চাঁদাবাজি করা হয়েছে। এতে নেতৃত্ব ছিল অর্ধশতাধিক ব্যক্তির। তারা শূন্য পয়েন্ট থেকে আগত নৌকা, ট্রাক ও ট্রাক্টর থেকে এই টাকা তুলে। বিজিবি’র নামে স্থানীয় কামাল আহমদ মেম্বার টাকা তুলেছেন বলে জানান তারা।
কামাল আহমদ মেম্বার জাফলংয়ের নিয়ন্ত্রক স্ট্যালিন তারিয়াংয়ের ম্যানেজার। তবে কামাল আহমদ মেম্বার গতকাল বিকালে জানান- তিনি পাথর লুটে জড়িত থাকলেও তো মামলা করতেন না। আগস্টের প্রথম দিকে পর্যটন স্পটে যে পাথর লুট হয়েছে সেই ঘটনায় তিনি বাদী হয়ে গোয়াইনঘাট থানায় মামলা করেছেন। ওই মামলায় আনু, হাকিমসহ কয়েকজনকে আসামি করেছেন। এখন তাকে পাথরখেকো সাজাতে একটি মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে জানান তিনি। এদিকে জাফলং পাথর লুটের ঘটনায় ১৮ই আগস্ট গোয়াইনঘাট থানায় মামলা করেছিলেন উপজেলা ভূমি অফিসের কর্মকর্তা আব্দুল মোনায়েম। এতে অজ্ঞাতনামা একশ’ থেকে দেড়শ’ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়- ৭ ও ৯ই আগস্ট জাফলংস্থ গেজেটভুক্ত পাথর কোয়ারি থেকে অবৈধ ও অননুমোদিতভাবে কোটি টাকার পাথর লুটপাট করেছে একটি চক্র। রাত ১টা থেকে ভোররাত ৪টার মধ্যে সরানো হয়েছে পাথর। এতে ব্যবহৃত হয়েছে ৫০ থেকে ৬০টি নৌকা। যেখানে প্রায় ১শ’ থেকে দেড়শ দুর্বৃত্ত অংশ নেয়। মামলা হলেও পুলিশ এখনো আসামিদের গ্রেপ্তার করেনি। গোয়াইনঘাট থানার ওসি সরকার তোফায়েল আহমদ জানিয়েছেন- জাফলংয়ে পাথর লুটের ঘটনায় মামলা হয়েছে। আসামিদের শনাক্তে কাজ করছে পুলিশ। বুধবার গোয়াইনঘাটে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় জাফলং জিরো পয়েন্টে পাথর লুটের ঘটনাটি আলোচিত হয়েছে। সভায় ইউএনও রতন কুমার অধিকারী জানিয়েছেন- পাথর লুটে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। লুট হওয়া পাথর উদ্ধারে প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালাচ্ছে বলে জানান তিনি। এতে উদ্ধার করা হচ্ছে পাথর।
তিতারাই ঘাটে চাঁদাবাজি: জাফলং সদরে তিতারাই রয়্যালিটি ঘাট। ওই ঘাটে উজান থেকে আসা নৌকা ভলগেট থেকে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। জাফলং লুটের জন্য এই ঘাটকেই বেশি দায়ী করা হচ্ছে। এ ঘাটের নেতৃত্বে রয়েছে স্থানীয় জিয়ারত, ছত্তারসহ কয়েকজন। তারা প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করছে। গত রোববার ওই ঘাটে অভিযান চালায় প্রশাসন। অভিযানে ইজারা বহির্ভূত এলাকা থেকে বালু আহরণ করায় ৩টি নৌকার মালিক রাকিবুল হাসান, মো. আনসার, পিন্টু শাহা নামের কয়েকজনকে আটক করা হয়। পরে মামলায় ৩ জনকে ৬ লাখ টাকা জরিমানা করেন এসিল্যান্ড ওমর ফারুক। জরিমানা আদায়ের পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। তবে অভিযান পরিচালনা ও জরিমানা নিয়ে বালুখেকোদের চোখ রাঙানির মুখে পড়তে হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। একই সময় যৌথ বাহিনীর একটি টিম গিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে ঘাট বন্ধ করে এলেও সেটি পুনরায় চালু রেখেছে বালুখেকোরা। এই ঘাট হচ্ছে জৈন্তাপুরের সারি-১ বালু মহালের ইজাদার কামরুল ইসলামের। তিনি জৈন্তাপুরের বালু মহালের ইজারাদার হলেও রয়্যালিটি আদায় করেন আরেক উপজেলা গোয়াইনঘাট সদর থেকে। ফলে শুধু সারি-১ কিংবা ২ নয়, ইজারা বহির্ভূত এলাকা জাফলং, বাংলাবাজার ও হাজীপুর এলাকা থেকে লুটপাট করা বালু রয়্যালিটি আদায়ের মাধ্যমে বৈধ হয়ে যায়।