
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আজ থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ হবে। গতকাল সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, সাধারণ ছাত্রদের বাঁচাতে চাইলেন যিনি ঠিক তার বুকেই তাক করা হলো বন্দুকের নল। ঘড়ির কাঁটায় সময় তখন দুপুর ২টা ১৭ মিনিট। এ সময়ই গর্জে ওঠে পুলিশের সাবেক এএসআই মো. আমির হোসেনের রাইফেল। যে অস্ত্র কেনা হয়েছিল আবু সাঈদের ট্যাক্সের টাকায়, শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য, সে অস্ত্রই বিদ্ধ করলো আবু সাঈদকে। পরে হাসপাতালে নেয়ার পথে সহযোদ্ধাদের বাহুডোরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন তিনি।
গতকাল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সূচনা বক্তব্য শেষ হয়েছে। আলোচিত এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ২৮শে আগস্ট দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য এইদিন ধার্য করেন।
এ মামলার ৩০ আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন। তাদের মধ্যে ৬ জন কারাগারে আছেন। বাকি ২৬ জন পলাতক, যাদের মধ্যে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি হাসিবুর রশীদও রয়েছেন। অন্যদিকে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন, এএসআই আমির হোসেন, বেরোবির সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী, রাফিউল হাসান রাসেল ও আনোয়ার পারভেজ।
কাঁদলেন শহীদ আবু সাঈদের বাবা: সূচনা বক্তব্য শেষে ট্রাইব্যুনালে আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের দুটি ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। এ সময় ছেলেকে গুলি করার দৃশ্য দেখে কাঁদেন শহীদ আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন। আজ তিনি ছেলে হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দেবেন বলে জানিয়েছে প্রসিকিউশন সূত্র। সূচনা বক্তব্যে তাজুল ইসলাম বলেন, চব্বিশের জুলাই বিপ্লবে সাহসের উজ্জ্বল প্রদীপ হয়ে জ্বলে উঠেছিল শহীদ আবু সাঈদ। পুলিশের গুলির মুখে দাঁড়িয়ে দু’হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে যেন বলতে চেয়েছিলেন ‘এভাবে মানুষ মারা চলবে না।’ তিনি বলেন, সেদিন সকালে রংপুরের আকাশে ঝরছিল বৃষ্টি। কিন্তু সব উপেক্ষা করে ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’ স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে উত্তরের শহর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২০২৪ সালের ১৬ই জুলাই বিশাল প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেন বেরোবির শিক্ষার্থীসহ স্কুল-কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। যা ছিল তারুণ্যের দ্রোহযাত্রা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। নগরীর লালবাগ এলাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে বিক্ষোভ মিছিল এগিয়ে এলে শিক্ষার্থীদের বাধা দেয় অসংখ্য সশস্ত্র পুলিশ। তাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। এ ছাড়া এই মামলার পাঁচ নম্বর আসামি মো. আরিফুজ্জামান ওরফে জীবনের নেতৃত্বে পাঁচজন পুলিশ সদস্য স্টিল ও কাঠের লাঠি দিয়ে আবু সাঈদের মাথায় আঘাত করেন। এতে তার মাথা থেকে রক্ত বের হয়।
তিনি আরও বলেন, প্রথম গুলিটি যখন আবু সাঈদের পেটে লাগে, তখন তিনি হতবাক হয়ে যান। আবার বুক প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যান। তখনই তাকে পরপর দুই রাউন্ড গুলি করেন ৯ নম্বর আসামি সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়। এরপর রাস্তার ডিভাইডার পার হয়ে বসে পড়েন আবু সাঈদ। একজন সহযোদ্ধা তাকে মাটি থেকে তোলার জন্য ধরতে গেলে আবার সে পড়ে যান। আবু সাঈদকে নেয়ার সময় তাদের লক্ষ্য করে আবার গুলি চালায় পুলিশ। এতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাওহিদুর হক সিয়ামের শরীরের বাঁ দিকটি ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। প্রায় ৬০টি ছররা গুলি তার মাথা, মুখ-হাত, বাহু, পেট, কোমর ও পায়ের বাঁ দিকে বিদ্ধ হয়। আবু সাঈদকে নিয়ে আন্দোলনরত ছাত্ররা রিকশায় করে রওনা দেন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উদ্দেশ্যে। হাসপাতালে নেয়ার পথে সহযোদ্ধাদের বাহুডোরেই ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে আবু সাঈদ।
ট্রাইব্যুনালকে অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, এই মামলায় নিরপেক্ষ, নির্ভুল এবং দৃঢ় বিচার নিশ্চিত করুন। দোষীদের যথাযথ শাস্তি দিন, যাতে জনগণের বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরে আসে। কারণ আমরা এমন একটি পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে ন্যায়বিচার কেবল একটি রায় নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি বার্তা। অপরাধী যত বড়ই হোক, বিচার থেকে কেউ রেহাই পাবে না।’
তিনি বলেন, বিচারের হাত দীর্ঘ। অনুপস্থিতি ন্যায় প্রতিষ্ঠায় বাধা নয়। এই মামলায় কিছু আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার কার্যক্রম চললেও, তা ন্যায়বিচার থেকে বিচ্যুতি নয়। বরং, এটি প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশে অপরাধীর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আইন তার নিজস্ব গতিতে কাজ করছে। আইনের যথাযথ বিধান অনুসরণ করেই এই ট্রাইব্যুনাল অনুপস্থিত আসামিদের বিরুদ্ধেও রায় দেয়ার পূর্ণ ক্ষমতা রাখে। ২৪ জন আসামি দীর্ঘদিন ধরে আদালতে উপস্থিত না থেকে পলাতক রয়েছেন। তাদের এই ইচ্ছাকৃত অনুপস্থিতি কিংবা বিদেশে আশ্রয় নেয়ার ফলে বিচারপ্রক্রিয়া থেমে থাকলে তা ন্যায়বিচারের পরিপন্থি হতো।
মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার চেয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী এবং আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থার স্বীকৃত নীতি অনুসারে অপরাধের দায়মুক্তির সুযোগ নেই, যতদিন না অপরাধ প্রমাণিত হয় বা নির্দোষ প্রমাণিত হন। ন্যায়বিচারের হাত দীর্ঘ এবং দৃঢ়, অনুপস্থিতি তাকে থামাতে পারে না।