
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার । এ নিয়ে সার্বিক প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন ( ইসি ) । রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছে । জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি দল এরই মধ্যে দেশব্যাপী সম্ভাব্য প্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে । অন্যদিকে মাঠে সরব বিএনপির মনোনয়ন- প্রত্যাশীরাও । সব মিলিয়ে তৃণমূলে বইছে ভোটের হাওয়া । আওয়ামী লীগ ছাড়া ভোটের মাঠে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় রয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ।
এ ছাড়াও অন্য দলগুলোর মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টি ( এনসিপি ), ইসলামী আন্দোলন , খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, এলডিপি, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি ( বিডিপি ) , গণঅধিকার পরিষদের নেতারাও তাঁদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন । নির্বাচনীমুখী প্রচারে স্বতন্ত্র প্রার্থীরও দেখা মিলছে কোথাও কোথাও । ত্রয়োদশ নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা জানিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা বলছেন , নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে বিএনপিতে প্রার্থী মনোনয়নের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে এবং নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এটা চূড়ান্ত হবে । জানতে চাইলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান গতকাল সোমবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য , সৎ , যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে । বিগত দিনে কারা কতটা ভূমিকা রেখেছেন । দলের জন্য , সবকিছু যাচাই-বাছাই করেই দল প্রার্থী মনোনয়ন দেবে ।
এদিকে নির্বাচন সামনে রেখে ৩০০ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে প্রচারে নেমেছে জামায়াতে ইসলামী । তবে সময় ও পরিস্থিতির প্রয়োজনে এতে পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা আছে বলে জানিয়েছেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম । দলের নির্বাচনী প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ ৩০০ আসনে আমরা প্রার্থী দিয়েছি । প্রার্থীরা কেন্দ্রের নির্দেশ অনুযায়ী নিজ নিজ এলাকায় প্রচারে নেমেছেন । কোথাও কোনো সমস্যা হচ্ছে না । ' তিনি আরও বলেন , ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করলেও তা একেবারেই চূড়ান্ত নয় । সমমনাদের সঙ্গে জোট বা আসন সমঝোতা হলে প্রার্থী তালিকায় পরিবর্তন আসবে ।
এদিকে আজকের পত্রিকার প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে তৃণমূলে নির্বাচনী আমেজের চিত্র পাওয়া গেছে । সম্ভাব্য প্রার্থীদের তৎপরতায় সরগরম হয়ে উঠেছে ভোটের মাঠ । ভোটারদের আস্থা অর্জনে প্রতিদিন নতুন নতুন কর্মসূচি হাতে নিচ্ছেন তাঁরা ; ব্যস্ত রয়েছেন ঘরোয়া বৈঠক, জনসভা , সেমিনারের পাশাপাশি সামাজিক অনুষ্ঠান , দোয়া মাহফিল এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন জনাকীর্ণ এলাকায় ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণে প্রচার - প্রচারণা ও মোটরসাইকেল শোডাউন করছেন অনেক প্রার্থী । স্থানীয় নেতাদের নির্বাচনী প্রচারকে চাঙা করতে কোথাও কোথাও আসছেন কেন্দ্রীয় নেতারাও ।
সমানতালে বিএনপি - জামায়াত মাদারীপুর -২ আসনে এত দিন ধরে রাজত্ব করে এসেছেন আওয়ামী লীগ নেতা শাজাহান খান । পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে শাজাহান খান ও তাঁর ছেলে আসিব খানসহ এই এলাকার আরও অনেক নেতা কারাগারে । আওয়ামী লীগবিহীন ওই আসন কবজায় নিতে বিএনপির পাশাপাশি পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীও বেশ সরব । এই আসনে জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থী আব্দুস সোবহান খান প্রচারে নেমেছেন ।
তিনি বলেন , “আমরা শান্তিপূর্ণভাবে পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে মাঠে নেমেছি । যুব ও সাধারণ জনগণের বিপুল সাড়া পাচ্ছি । তাই সাংগঠনিকভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি । সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী নির্বাচিত হবে বলে আমি আশাবাদী । ’ একই আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্তত ৭ জন মাঠে রয়েছেন এই মুহূর্তে । নিজ নিজ জায়গা থেকে তাঁরাও ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টা করছেন । এই আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের সহশিক্ষা - বিষয়ক সম্পাদক এবং সাবেক নারী সংসদ সদস্য হেলেন জেরিন খান বলেন , ‘ দীর্ঘ ১৭ বছর বাংলাদেশের মানুষ ভোট দেওয়া থেকে বঞ্চিত ছিলেন । আগামী নির্বাচনে সৎ , যোগ্যদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে সংসদে পাঠাতে কাজ করব । আমাকে মনোনয়ন দিলে আমি নির্বাচনে অংশ নিয়ে জনগণের পাশে থাকতে চাই । ’
বিএনপির মনোনয়নের দৌড়ে নবীন- প্রবীণের পাশাপাশি বহিষ্কৃতরাও পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বিএনপির টিকিটে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেই জয় সুনিশ্চিত , এমনটা ধরে নিয়ে দলটির মনোনয়ন পেতে মরিয়া অনেকেই । মনোনয়নপ্রত্যাশীরা কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ নিবিড় রাখছেন , রাষ্ট্র সংস্কারে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৩১ দফা নিয়ে ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন । কোনোভাবেই যাতে মনোনয়নবঞ্চিত না হতে হয় , সে জন্য নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন তাঁরা । এটা করতে গিয়ে অনেক জায়গায় নিজেদের মধ্যে কোন্দলেও জড়িয়ে পড়ছেন মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ।
ময়মনসিংহ -১ আসনে বিএনপির মনোনয়ন চেয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন দলটির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ; চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক বিচারপতি টি এইচ খানের সন্তান আফজাল এইচ খান; ময়মনসিংহ উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য ও হালুয়াঘাট উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সালমান ওমর রুবেল । জুলাই অভ্যুত্থানের আগে থেকেই তিন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মাঠে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছেন তাঁরা । বিএনপির প্রার্থিতার দৌড়ে রয়েছেন হেভিওয়েট নেতা ও তরুণ প্রার্থী । দেশের অনেক জায়গায় মনোনয়ন পেতে তরুণ - প্রবীণের লড়াই বেশ জমে উঠেছে । বাগেরহাট -১ আসনে প্রার্থিতার দৌড়ে রয়েছেন একাধিক হেভিওয়েট ও তরুণ প্রার্থী । তাঁরা হলেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য , সাবেক সংসদ সদস্য ও বাগেরহাট জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান; বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য ওয়াহিদুজ্জামান দিপু; বাগেরহাট জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি মাসুদ রানা; জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার ( জাসাস ) সাবেক খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও বাগেরহাট জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি মঞ্জুর মোর্শেদ স্বপন , ফকিরহাটের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ কামরুল ইসলাম । মনোনয়নপ্রত্যাশী এই ৫ নেতাই প্রচারে নেমেছেন সর্বশক্তি দিয়ে । আবার কেন্দ্রের সঙ্গেও তাঁদের প্রত্যেকেরই নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে । এই প্রতিযোগিতা শেষে দলের কাছ থেকে সবুজ সংকেত কে পান, সেটাই এখন দেখার বিষয় । এদিকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে অতীতে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন এমন অনেক নেতাও দলের মনোনয়নে এমপি হওয়ার আশা করছেন ।
ময়মনসিংহ -১১ আসনে বিএনপির মনোনয়ন চান দলটি থেকে বহিষ্কৃত ফখর উদ্দিন আহমেদ বাচ্চু । সব অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়ে দল তাঁকেই মনোনয়ন দেবে বলে তাঁর প্রত্যাশা । ফখর উদ্দিন আহমেদের দাবি , দলের হাইকমান্ড থেকে আশ্বাস পেয়েই তিনি নির্বাচনী প্রচারে নেমেছেন । যদিও এই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ভালুকা উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক মোহাম্মদ মোরশেদ আলম বলেন , দলের হাইকমান্ড মনোনয়নের ব্যাপারে তাঁকেই আশ্বস্ত করেছেন । অন্য এলাকার প্রার্থী নিয়েও রয়েছে আলোচনা । পাবনা -৩ আসনে কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সভাপতি হাসান জাফির তুহিনের প্রার্থী হতে পারেন , এমন খবর পাওয়া গছে । জাফির তুহিন পাবনা -২ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন । কিন্তু কেন্দ্রীয় বিএনপি তাঁকে পাবনা -৩ আসনে কাজ করার জন্য অনুমতি দিয়েছে , এমন খবর এলাকায় আসার পর চলছে নানা আলোচনা- সমালোচনা । এই আসনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরাও তুহিনকে নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন ।
দুবারের সাবেক এমপি চাটমোহর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি কে এম আনোয়ারুল ইসলাম বলেন , “বাইরের কোনো প্রার্থীকে পাবনা -৩ আসনের মানুষ মানবে না । আশা করি , দল যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা যাচাই - বাছাই করে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেবে । ' আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী হাসানুল ইসলাম রাজা বলেন , ‘ কেউ ধানের শীষ পেয়ে গেছেন মর্মে প্রচারণা চালাচ্ছেন ; যাঁদের সুদীর্ঘকাল ধরে এই আসনের মাটি - মানুষের সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না । তিনি কিনা মন্ত্রী হওয়ার আশ্বাসে এই আসনের সাধারণ সহজসরল মানুষকে ধোঁকা দিয়ে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছেন ।”
মনোনয়নপ্রত্যাশী ইসলাম হীরা বলেন , ‘ দল থেকে কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি । তাই আমি আমার মতো করে কাজ করে যাচ্ছি । ' হাসান জাফির তুহিন অবশ্য দাবি করেন , দেড় মাস আগে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানই তাঁকে এখানে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন । তিনি বলেন , “ দলের নির্দেশে আমি এখানে কাজ করছি । তারেক রহমান এই অঞ্চলের মানুষের জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন । আশা করি, সবচেয়ে বেশি ভোটে এই আসনের মানুষ আমাকে বিজয়ী করবে । 'এদিকে বিএনপিতে মনোনয়ন নিয়ে দৌড়ঝাঁপে ব্যতিক্রমও আছে কোথাও কোথাও , যেখানে একক প্রার্থী মাঠে রয়েছেন । সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের মৌলভীবাজার -৩ আসনে তাঁর ছেলে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য এম নাসের রহমান বিএনপির একক প্রার্থী হিসেবে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন । মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে কোন্দল , দলাদলি ও মনোমালিন্যকে বড় কোনো সমস্যা হিসেবে দেখছেন না বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান । তিনি বলেন , “এত বড় একটা দলে ( বিএনপি ) এগুলো হয়েই থাকে । আশা রাখি সময়ের প্রয়োজনে সঠিক সময়ে সবাই এক হয়ে যাবে ।”
জামায়াত আমিরকে নিয়ে আলোচনায় মৌলভীবাজার -১ তারকা নেতারা প্রার্থী হবেন , এমন সম্ভাব্যতার কারণে কোনো কোনো আসন এরই মধ্যে এসেছে আলোচনায় । মৌলভীবাজার -১ আসনে প্রার্থী দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী । জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান এই নির্বাচনী এলাকার বাসিন্দা । তিনিও এই আসনে প্রার্থী হতে পারেন । জামায়াত আমির এই আসনে প্রার্থী হবেন , স্থানীয় জামায়াতের নেতা- কর্মীদের এমনটাই চাওয়া বলে জানা গেছে । মৌলভীবাজার জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ইয়ামীর আলী বলেন , ‘ জামায়াতের আমিরের নিজ জন্মস্থান হওয়ায় এলাকার মানুষ উনাকে প্রার্থী হিসেবে চাচ্ছে । আমরাও চাচ্ছি । তৃণমূল মানুষের কথা আমরা কেন্দ্রে জানিয়েছি । ' অন্যদিকে আসনটিতে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরাও প্রভাবশালী । তাঁদের মধ্যে প্রবাসী দুই নেতার তারেক রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে তাঁরাও আলোচনায় রয়েছেন বলে জানা গেছে । ভোটারদের প্রত্যাশা আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে ভোটারদের কাছে গিয়ে ভোট ও দোয়া চাচ্ছেন মনোনয়নপ্রত্যাশীরা । এ নিয়ে ভোটারদের মধ্যও দেখা দিয়েছে উৎসবের আমেজ । বিভিন্ন দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নিয়ে আলোচনা - সমালোচনায় চায়ের দোকান থেকে সর্বত্র মুখর রেখেছেন ভোটাররা । এবার সত্যিকার অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে প্রত্যাশা তাঁদের ।