Image description
গোঁজামিল স্বজনপ্রীতি পক্ষপাত

উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে নেওয়া ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে প্রস্তাবনা মূল্যায়নে রিভিউয়ার প্যানেল (মূল্যায়ন কমিটি) গঠন নিয়ে গোপনীয়তা, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক্ষেত্রে যোগ্যতার বদলে প্রাধান্য পেয়েছে রাজনৈতিক আনুগত্য ও ব্যক্তিগত পরিচিতি। পুরো প্রক্রিয়াটিতে ছিল ‘বন্ধুকোটা, ‘ছাত্রকোটা’ ও ‘রাজনৈতিক আদর্শ কোটা’। শুধু তাই নয়, সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক দিয়ে ব্যবসায় অনুষদ, অর্থনীতি, হিসাববিজ্ঞান এমনকি স্থাপত্যবিষয়ক গবেষণার গবেষণা প্রস্তাব মূল্যায়ন করানো হয়েছে। গণযোগাযোগ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানের শিক্ষকদের দেওয়া হয়েছে ইংরেজি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ ও প্রত্নতত্ত্বের মতো ভিন্ন বিষয়ের গবেষণা যাচাইয়ের দায়িত্ব। এ ছাড়া প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পতিত সরকারপন্থি শিক্ষকদের। ফলে প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে আজ মঙ্গলবার জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

ইউজিসি সূত্রমতে, উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন ও গবেষণায় গতি আনতে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘হায়ার এডুকেশন অ্যাক্সিলারেশন অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন (হিট)’ প্রকল্পটি নেওয়া হয়। গত বছরে জুন থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পটি শেষ হবে ২০২৮ সালের ডিসেম্বরে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ১৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে সরকার দেবে ২ হাজার ৩৩ কোটি এবং বিশ্বব্যাংক দেবে ১ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য হলো উচ্চশিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, শিক্ষার্থীদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করা এবং স্নাতক ডিগ্রিধারীদের কর্মসংস্থান বাড়ানো। বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বাড়ানো, নেতৃত্ব দক্ষতা বাড়ানো এবং ব্যবস্থাপক ও উচ্চ পদে বসার জন্য প্রস্তুত করা। সেজন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ হাজার শিক্ষককে পেশাগত উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি ৬ লাখ শিক্ষার্থীকে সরাসরি এর আওতায় এনে প্রশিক্ষিত করা হবে। কিন্তু প্রকল্পের রিভিউয়ার প্যানেল নির্বাচনে চরম স্বজনপ্রীতি, গোপনীয়তা, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে। ফলে একদিকে যোগ্যরা বঞ্চিত হয়েছেন, অন্যদিকে অযোগ্যরা সুযোগ পেয়েছেন। অনেকটা গোঁজামিল দিয়ে সাজানো এ প্রক্রিয়ায় গবেষণার নামে অর্থ লোপাটের পথ তৈরি করা হচ্ছে—এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

ইউজিসি ও প্রকল্পের তথ্য বলছে, প্রজেক্ট প্রস্তাবনা মূল্যায়নের জন্য গঠিত রিভিউয়ার কমিটিতে অনভিজ্ঞদের এবং এক অনুষদের শিক্ষকদের আরেক অনুষদের গবেষণা প্রস্তাবনা মূল্যায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রিভিউ বোর্ড ও প্রেজেন্টেশন মূল্যায়ন কমিটিতে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের আধিক্য রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কয়েকজন শিক্ষককেও রাখা হয়েছে, যাদের গবেষণাপত্রের মান আন্তর্জাতিক সূচকে একেবারের নিচের দিকে। নিজের পিএইচডি ডিগ্রি নেই—এমন শিক্ষক হয়েছেন পিএইচডির রিভিউয়ার। রিভিউয়ারদের পেশাগত দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। যেমন—জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর আইনুন নাহারের স্কোপাস প্রোফাইল পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১০ সালে তিনি মাত্র একটি স্কোপাস ইনডেক্সড আর্টিকেল (বিশ্বের বৃহৎ একাডেমিক ডাটাবেজ) প্রকাশ করেছেন। গুগল স্কলারে তার কোনো প্রোফাইল খুঁজে পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে, একই বিভাগের আরেক শিক্ষক প্রফেসর মির্জা তাসলিমা সুলতানার গুগল স্কলার প্রোফাইল অনুযায়ী তার এইচ-ইনডেক্স মাত্র ৩ এবং আই-১০ ইনডেক্স মাত্র ১। তার প্রকাশিত তিনটি নিবন্ধে মোট সাইটেশন মাত্র ৬৪টি। এর মধ্যে একটি নিবন্ধই ৫৩ বার সাইটেড হয়েছে, যেখানে তিনি তৃতীয় লেখক।

আরেক সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গীতি আরা নাসরীনের ইনডেক্সড জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার সংখ্যাও সীমিত। সমালোচকরা বলছেন, শিক্ষকতার পাশাপাশি বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এ শিক্ষকের একাডেমিক রেকর্ড প্রকল্পের মতো একটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের উদ্যোগের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ। শুধু ইউজিসির একজন সদস্যের বদৌলতে স্থান পেয়েছেন তিনি।

শিক্ষকরা অভিযোগ করেন, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদে অন্তত ৩০টির বেশি স্বতন্ত্র বিভাগ রয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে মাত্র তিন সদস্যের একটি মূল্যায়ন কমিটিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের দুজন শিক্ষককে রাখা অস্বাভাবিক। এমন বিষয় জানার পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ইউজিসির চেয়ারম্যানকে বিষয়টি অবহিত করেন। সেখানে তারা লো-প্রোফাইলধারী, শিক্ষক নেটওয়ার্কের শিক্ষক দিয়ে প্রেজেন্টেশন মূল্যায়নে রিভিউয়ার করার বিষয়টি জানান। জবাবে ইউজিসি চেয়ারম্যান জানান, এ শিক্ষকরা জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন। তাই তাদের মূল্যায়ন করা হয়েছে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আজম খান বলেন, আমরা আবেদন করেছিলাম কিন্তু কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় বেশি পেয়েছে। কোন ক্রাইটেরিয়াতে বিষয়গুলো নির্ধারণ হয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এদিকে হিট প্রকল্পে স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তুলে গত ৭ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) একদল শিক্ষক। তাদের অভিযোগ, হিট প্রকল্পে স্বীকৃত ও অভিজ্ঞ গবেষকদের বাদ দিয়ে লো-প্রোফাইল ও কম সাইটেশনধারী শিক্ষকদের প্রকল্প নির্বাচিত হয়েছে। এমনকি অতীতে ব্ল্যাকলিস্টেড কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রকল্পও অনুমোদন পেয়েছে।

শাবিপ্রবির সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, হিট প্রকল্পটি একটি চক্রের জালে জড়িয়ে গেছে। পুরো রিভিউ বোর্ড গঠন প্রক্রিয়া হয়েছে অত্যন্ত গোপনীয় ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়। কারা রিভিউয়ার ছিলেন, কীভাবে নির্বাচিত হয়েছেন বা তাদের যোগ্যতা কী—এসব প্রকাশ করা হয়নি। একে অন্যের পরিচিতদের রিভিউ করেছেন এমনকি নিজ বিভাগের সহকর্মীদের প্রজেক্টও রিভিউ করা হয়েছে, যা স্পষ্ট কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট। ফলে পুরো প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকল্প বরাদ্দে যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক পরিচয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষক প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ পেয়েছেন। এর মধ্যে ড. স্নিগ্ধা কট্টর বামপন্থি এবং ড. মিজানুর রহমান আওয়ামীপন্থি শিক্ষক সমিতির প্যানেল থেকে নির্বাচিত শিক্ষক নেতা ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন শিক্ষকের মধ্যে আইন বিভাগের এবিএম আবু নোমান ও রসায়ন বিভাগের ফণী ভূষণ আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগের ড. মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বামপন্থি হিসেবে পরিচিত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ জন শিক্ষকের মধ্যে ৪ জন আওয়ামীপন্থি। তারা হলেন—ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন রিসার্চের ড. রুবাইয়্যাত জাহান, আইন বিভাগের ড. জুলফিকার আহমেদ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জুলফিকার আলী ইসলাম ও গণিত বিভাগের গৌর চন্দ্র পাল। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নির্বাচিত হয়েছেন ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম ও ড. শফিকুল ইসলাম। তারা দুজনই শিক্ষক সমিতির গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন এবং আওয়ামীপন্থি হিসেবে পরিচিত। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাদ্দ পাওয়া চারজন শিক্ষকের মধ্যে তিনজনই আওয়ামীপন্থি। এর মধ্যে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের ড. মাসুদ রানা জুলাই আন্দোলনের পর প্রক্টর হলেও কিছুদিনের মধ্যে পদত্যাগ করেন। গবেষণায় সহকারী হিসেবে কাজ করছেন তিনজন শিক্ষক। ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের ড. কামাল হোসেন ও ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগের এস এম শাহিদুল আলম আওয়ামীপন্থি। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

তথ্যমতে, হিট প্রকল্পে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বাধিক ১৫টি প্রজেক্ট পেয়েছে। এ ছাড়া বুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৮টি করে প্রজেক্ট পেয়েছে। মোট ৪৩টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৫১টি প্রজেক্ট অনুমোদিত হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও স্বজনপ্রীতি হয়েছে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির পরেই গবেষণায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় করা বিশ্ববিদ্যালয় ইউল্যাব, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (এআইইউবি), ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির (আইইউবি) কোনো শিক্ষকের গবেষণা চূড়ান্ত বরাদ্দের তালিকায় স্থান পায়নি।

শিক্ষকরা বলছেন, এত বড় প্রকল্পে শিক্ষক নির্বাচন করার আগে আনুষ্ঠানিক কোনো ব্রিফিং বা অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। পুরো প্রক্রিয়াটি সাইলেন্ট মোডে (নীরবে) চলেছে। ইউজিসির মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তারাও বলছেন, এ প্রকল্পের অনেক বিষয়ে তারা অবহিতও নন। অনেক ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানকে অবহিত করা হয়নি।

প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অনেক প্রকল্প শুধু প্রেজেন্টেশনের ভিত্তিতে বাদ দেওয়া হয়েছে। যেসব গবেষণা প্রস্তাবনা প্রাসঙ্গিক ছিল, সেগুলো অযোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা মূল্যায়ন হওয়ায় বাদ পড়ে। অন্যদিকে অপ্রাসঙ্গিক প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে।

সার্বিক অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হিট প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক ড. আসাদুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, এই প্রকল্পের মূল্যায়ন ও গবেষক নির্বাচন প্রক্রিয়া কোনো অনিয়ম হয়নি। যারা বিভিন্ন অভিযোগ তুলেছেন, সেগুলোর বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়েছে। আপনাদের যত প্রশ্ন আছে সেখানে করবেন। ইউজিসির কাছে প্রতিটির ব্যাখ্যা আছে।

ইউজিসির আরেক সদস্য ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খানের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন দিয়েও সাড়া মেলেনি। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হলেও উত্তর মেলেনি।