
বছর না ঘুরতেই রাজধানীর মোহাম্মদপুরে রামচন্দ্রপুর খালের উদ্ধার করা জায়গা আবার বেদখল হয়ে গেছে। গাবতলী-সদরঘাট বেড়িবাঁধ সড়কের সাতমসজিদ হাউজিংয়ের ১ নম্বর সড়কে বহুল আলোচিত-বিতর্কিত সাদিক অ্যাগ্রো খামারের স্থাপনা খালের জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এবার সেই জায়গাকে ব্যক্তিমালিকানাধীন দাবি করে জোরেশোরে চলছে সুবিশাল ১০ তলা ভবন নির্মাণের কাজ। তবে এতে এখনো বাধা দেয়নি ডিএনসিসি। করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য, তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।
কোটি টাকার ‘উচ্চবংশীয়’ গরু এবং ‘১৫ লাখ টাকার’ ছাগলকাণ্ডে আলোচনায় আসা সাদিক অ্যাগ্রোর খামারটি গত বছরের ২৭ জুন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। গত বছরের ৫ আগস্ট রাষ্ট্রক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর সেই জমি নিজেদের বলে দাবি করছেন বেশ কয়েকজন। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রশ্ন তুলেছেন, খালের জায়গা দখলের অভিযোগেই যদি সাদিক অ্যাগ্রোকে উচ্ছেদ করা হয়, তাহলে সেই জায়গায় কীভাবে এখন বহুতল ভবন হচ্ছে?
গতকাল বুধবার সরেজমিন দেখা যায়, সাদিক অ্যাগ্রোর স্থাপনা উচ্ছেদের পর ফাঁকা হওয়া সে জায়গাটি চারটি আলাদা প্লটে ভাগ করা হয়েছে। যার মধ্যে খালের পশ্চিম পাশের প্রথম ও দ্বিতীয় প্লটে রয়েছে অটোরিকশার দুটি গ্যারেজ। সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা তৃতীয় প্লটটির ভেতরে ফাঁকা। আর চতুর্থ প্লটে উঠছে সুবিশাল বহুতল ভবন। খালের মাটি ভরাট করা যে জায়গা সিটি করপোরেশন পিলার গেড়ে চিহ্নিত করেছিল, এই চারটি প্লট সেই পিলারের বাইরে হাউজিং এলাকার ভেতরেই অবস্থিত।
পশ্চিম পাশের প্রথম প্লটের মালিকানা দাবি করেছেন আব্দুল আলীম তালুকদার নামে একজন। দ্বিতীয় প্লটটির মালিক হিসেবে নিজেদের তুলে ধরেছেন প্রয়াত আবুল কালাম আজাদের স্ত্রী শাহানা আজাদ ও তার দুই ছেলে। তারা উত্তরাধিকার সূত্রে জমিটি পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। খালি থাকা তৃতীয় প্লটের মালিকানা দাবি করছেন বসির আহমেদ। বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলা চতুর্থ প্লটের মালিকানার দাবিদার মোহাম্মদ আলী আকন্দ নামে একজন। স্থানীয়রা জানান, এই চারজনের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েই সাদিক অ্যাগ্রোর খামারটি গড়ে তুলেছিলেন ইমরান আহমেদ।
ব্যক্তিগত রেষারেষির জেরে তাদের খামার উচ্ছেদ করা হয় বলে অভিযোগ করেন সাদিক অ্যাগ্রোর বর্তমান ম্যানেজার (ব্যবস্থাপক) জাহিদ উদ্দিন। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘খালের জায়গা বলে আমাদের খামার ভাঙা হয়েছে, একই জায়গায় এখন জমির মালিকরা অটোগ্যারেজ আর বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে। কথাগুলো আমরা তখনো বলেছি, এখনো বলছি—এগুলো ব্যক্তিমালিকানার জায়গা, আমরা ভাড়া নিয়েছিলাম। আমাদের সুনামহানি করার জন্য একটা পক্ষ তখন উঠেপড়ে লেগেছিল।’
একই ধরনের ভাষ্য সাত মসজিদ হাউজিং সোসাইটির নিরাপত্তা তত্ত্বাবধায়ক সাদেক হোসেনের। তিনি বলেন, ‘এখানকার (যেখান থেকে উচ্ছেদ করা হয় সাদিক অ্যাগ্রোকে) দুটি প্লট আড়াই কাঠা করে, একটি চার ও আরেকটি সাড়ে ছয় কাঠার। আর এটা খালের জমি কখনই ছিল না। এখানে ব্যক্তিগত গ্যাঞ্জাম ছিল, মানুষ সে সুযোগে ভাঙাইছে।’
যে প্লটটিতে ১০ তলা ভবন উঠছে, সেটি নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ওই ভবনের ভেতরে প্রায় ২০ জন শ্রমিককে কাজ করতে দেখা যায়। এরই মধ্যে চতুর্থতলার মূল কাঠামোর কাজ শেষে পঞ্চমতলার কাজ শুরু হয়েছে। প্লটটির মূল ফটকে ঝোলানো ব্যানারে লেখা রয়েছে, ‘চলতি বছরের ১২ আগস্ট রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বরাবর অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। ঠিকানা: বাড়ী # ১৩, রোড নং # ০১, সাতমসজিদ হাউজিং লি., মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭।’
জানতে চাইলে কনস্ট্রাকশন সাইটের প্রকৌশলী মো. বায়েজিদ আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘রূপকার বিল্ডার্স লিমিটেড জমির মালিক আকন্দ সাহেবের সঙ্গে চুক্তিতে এই ১০ তলা বিল্ডিং নির্মাণ করছে। গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে কাজ শুরু হয়েছে। আমরা রূপকার বিল্ডার্স লিমিটেডের আন্ডারে (অধীনে) কাজ করছি। আর জায়গাটার মালিক হচ্ছে আকন্দ সাহেব— এমনই জানি।’
প্রথম প্লটটির অটোরিকশা গ্যারেজের মালিক মো. শাহিন জানান, সাত মসজিদ হাউজিংয়ের সাবেক সেক্রেটারি রশিদ তালুকদারের ভাই আলীম তালুকদারের কাছ থেকে জায়গাটি ২০ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়ে গ্যারেজটি করেছেন।
তিনি বলেন, ‘ডিএনসিসির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আসিফ আহমেদসহ স্থানীয় বেশ কিছু নেতাকর্মীর সঙ্গে সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরানের বেশ ঝামেলা হয়েছিল। এজন্য তারা উচ্ছেদ করে দেওয়ার জন্য যা কিছু করার তা-ই করেছে। তবে সাদিক অ্যাগ্রোরও কিছু সমস্যা ছিল, তারা অতি মূল্যে বিদেশি জাতের পশু বিক্রি করেছে, কিছু পশুর নাকি দেশে বিক্রির অনুমতিও ছিল না। তবে ভাঙার সময় কিন্তু খালের জমি উদ্ধার করা হচ্ছে—এমনটাই জানিয়েছিল প্রশাসন, এসব কথা তো বলাও যায় না আসলে।’
একটি প্লটের মালিকানার শেয়ারে রয়েছেন (অংশীদার) মিন্টু ওয়ার্কশপের মালিক ইসমাইল হোসেন মিন্টু। তিনি বলেন, ‘একটি প্লটে আমাদের একটা সোসাইটি আছে ১০ জনের, সেই সোসাইটির শেয়ার আছে। আর এখানে যা আছে এগুলো সব ব্যক্তিমালিকানা জমি।’
তৃতীয় প্লটের মালিক মোহাম্মদ আলী আকন্দেরও দাবি এটা খালের জমি নয়, ব্যক্তিমালিকানার। তিনি বলেন, ‘আমার এখানে ৮ কাঠার মতো জায়গা আছে। সোসাইটির সড়কের জন্য কিছু জমি ছাড়তে হয়েছে। এই জমির হালনাগাদ সব কাগজপত্র আমার কাছে রয়েছে। গত বছর যখন সাদিক অ্যাগ্রো ভাঙে, তখনই কাগজপত্র দেখিয়ে বলেছিলাম, কিন্তু তারা কোনো কথা শোনেনি। আর বাকি যে প্লটগুলো আছে সবগুলোই তো ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি। তবে এগুলোর পেছনে খালের জমি আছে, আবার সেখানে তো পিলারও দেওয়া আছে।’
স্থানীয় চা দোকানি জসিম আলম বলেন, ‘সাদিক অ্যাগ্রোর জায়গা ব্যক্তিমালিকানাধীন জানতাম। খামার উঠাইছে স্থানীয় কাউন্সিলরসহ গত সরকারের স্থানীয় ছোট নেতারা, সাদিক অ্যাগ্রোর মালিকের লগে খারাপ সম্পর্কের কারণে। মূলত স্থানীয় কাউন্সিলরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল মালিকের।’
স্থানীয় বাসিন্দা মো. জুয়েল বলেন, ‘ওই খামারে ৫০০ জনের মতো মানুষ কাজ করত। বড় একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ছিল। ভেঙে দেওয়ার পর সবাই তো কর্মহারা।’
খালের ভরাট জায়গায় অন্তত ২০টি পরিবার ছাপরা ঘর বানিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছিল। গত বছর উচ্ছেদ করে দেওয়া হলে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি পরিবার অন্যত্র চলে গেছে। বর্তমানে ৮ থেকে ১০টি পরিবার পুনরায় সেই জায়গায় নতুন করে ছাপরা ঘর তুলেছে।
ষাটোর্ধ্ব বাবুল হোসেন সেখানে থাকেন তার স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়িঘর নেই। এখানেই আছি ১৬ বছর। গত বছর উচ্ছেদের পর কয়েক মাস রাস্তায় থেকেছি।’
জায়গাটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন। সাদিক অ্যাগ্রোর উচ্ছেদ করা জায়গায় ব্যক্তিগত স্থাপনা গড়ে ওঠার বিষয়ে জানতে চাইলে কিছুই বলতে পারেননি সংস্থাটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে ডিএনসিসির অঞ্চল-৫-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (উপসচিব) মো. ছাদেকুর রহমান বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। এটা আমার জানা নেই। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখব।’