
আস্থার সংকট কাটাতে ১০টি বহুজাতিক কোম্পানিকে আনা হচ্ছে পুঁজিবাজারে। এসব কোম্পানিতে আছে সরকারের মালিকানাধীন শেয়ার। অর্থ মন্ত্রণালয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো শনাক্ত ও নাম চূড়ান্ত করেছে। প্রধান উপদেষ্টা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানো ও কারসাজি প্রতিরোধে সম্প্রতি যে পাঁচ নির্দেশনা দিয়েছেন তার মধ্যে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করা অন্যতম একটি। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে শিল্প, বাণিজ্য, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ সচিবকে চিঠি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
বহুজাতিক ১০ কোম্পানির মধ্যে ইউনিলিভার বাংলাদেশ লি., কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লি. (কাফকো), সাইনোভিয়া বাংলাদেশ লি., নোভার্টিস (বাংলাদেশ) লি., সিনজেন্টা বাংলাদেশ লি.। এছাড়া পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোং লি., সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোং লি., কর্ণফুলী গ্যাস কোং লি., নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোং লি. এবং নেসলে বাংলাদেশ পিএলসিও আছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে সরকারি মালিকানার ৫ শতাংশ এবং বিদেশি কোম্পানির ৫ শতাংশ মিলে মোট ১০ শতাংশ শেয়ার পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত রয়েছে।
যদিও বিগত সরকারের সময় রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেয়ারবাজারে নিয়ে আসার উদ্যোগ কার্যকর হয়নি। তবে এবারের উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে দেশের স্টক এক্সচেঞ্জগুলোতে কিছুটা হলেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থ মন্ত্রণালয়) কেএইচ আনিসুজ্জামান চৌধুরী অস্ট্রেলিয়া থেকে যুগান্তরকে জানান, এ বিষয়ে কাজ হচ্ছে। ডেটলাইন দিতে পারব না। তবে পজিটিভওয়েতে কাজ চলছে। এসব কোম্পানিকে রাতারাতি পুঁজিবাজারে আনা যায় না। এর আগে রাতারাতি অনেক কাজ করতে গিয়ে বিপদ ঘটিয়েছে। আমরা সে পথে যেতে চাই না। তিনি আরও বলেন, সংকট কাটাতে এ পর্যন্ত ইতিবাচক অনেক পদক্ষেপ দেখছেন। আশা করি এ বিষয়ে আগামীতে ভালো ফল দেখতে পাবেন। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সূত্রমতে, অর্থ বিভাগের চূড়ান্ত করা ১০টি বহুজাতিক কোম্পানিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ এবং বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের শেয়ার রয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, পুঁজিবাজারের সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা এবং এর উন্নয়ন ও শক্তিশালী করতে গত ১১ মে প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেন। সেগুলো বাস্তবায়নে করণীয় ঠিক করতে গত ৩১ জুলাই প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরীর সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে সরকারের মালিকানা আছে এমন বহুজাতিক কোম্পানিসহ রাষ্ট্রমালিকানাধীন লাভজনক মৌল ভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিসমূহকে পুঁজিবাজারে সরাসরি তালিকাভুক্তির বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়। পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানিসহ রাষ্ট্রমালিকানাধীন লাভজনক মৌল ভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিগুলোর একটি তালিকা প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পত্র প্রদান করা হবে মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, চূড়ান্ত ১০টি প্রতিষ্ঠানসহ সরকারের মালিকানা আছে এমন বহুজাতিক কোম্পানি ও রাষ্ট্রমালিকানাধীন লাভজনক মৌল ভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিসমূহকে পুঁজিবাজারে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
জানা যায়, চিঠি পেয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। তবে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমানের কাছে এ উদ্যোগের অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে জানান, বহুজাতিক কোম্পানি নেসলে বাংলাদেশ পিএলসির বোর্ডে পরিচালক হিসাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি নিযুক্ত আছেন। বহুজাতিক এ কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার নির্দেশক্রমের চিঠি এখন পর্যন্ত হাতে আসেনি। এ ধরনের নির্দেশনা এলে মন্ত্রণালয় থেকে অবশ্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, আস্থাহীনতার কারণে বিগত আট বছরে কমপক্ষে ১৬ লাখ বিনিয়োগকারী বাজার থেকে বেরিয়ে গেছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৭ লাখ বিনিয়োগকারী কোনোভাবে টিকে আছে। দীর্ঘদিন ধরে স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজি, ভালো শেয়ারের মূল্য বাড়তে না দেওয়া, বাজার নিয়ন্ত্রণে কমিশনের নিষ্ক্রিয়তাসহ বেশ কিছু কারণেই এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
অর্থ বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, শেয়ারবাজারের গভীরতা বাড়াতে হলে স্থানীয় ভালো কোম্পানি এবং বহুজাতিক কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করতে হবে। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে। কারণ এ ধরনের কোম্পানি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করার যোগ্য। দেশে বহুজাতিক কোম্পানি অনেক থাকলেও বেশির ভাগই শেয়ারবাজারে আসেনি। তবে দুর্বল ভিত্তির ১০টি কোম্পানিকে তালিকায় না এনে একটি বহুজাতিক কোম্পানিকে তালিকায় আনা বেশি যৌক্তিক। এ পর্যন্ত যতগুলো বহুজাতিক কোম্পানি মার্কেটে আছে, তার সবগুলোর শেয়ারের দাম ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকারও ওপরে। তারা বিনিয়োগকারীদের ভালো ডিভিডেন্ডও দিচ্ছে। শেয়ারবাজারে আস্থা ফেরাতে এ ধরনের কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করতে হবে।
এদিকে বাংলাদেশে চালু সরকারি অংশীদারত্ব আছে এমন বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার পুঁজিবাজারে ছাড়তে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সম্প্রতি বৈঠক করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সেখানে বিএসইসি বলেছে, ‘দেশের যেসব বিদেশি বা বহুজাতিক কোম্পানিতে সরকারের মালিকানা আছে সেগুলোকে সরাসরি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে দ্রুত পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরীর সভাপতিত্বে বৈঠকে শিল্প সচিব ওবায়দুর রহমান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক, জ্বালানি সচিব জিয়াউল হক, বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত পুঁজিবাজারের গতি আনতে ৫টি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এর মধ্যে আছে ‘সরকারি মালিকানাধীন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে সরকারের শেয়ার কমিয়ে পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত’ এবং দেশীয় বড় কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তির জন্য উৎসাহিত করতে প্রণোদনাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ; স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজি রুখতে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তিন মাসের মধ্যে বাজার সংস্কার, পুঁজিবাজারের অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং ব্যাংক ঋণের নির্ভরতা কমাতে বড় কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজার থেকে তহবিল সংগ্রহের প্রয়োজনী পদক্ষেপ গ্রহণ।