
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে কুমিল্লার দেবিদ্বারে নিহত শহীদ আব্দুর রাজ্জাক রুবেলের মা হাসনে আরা বেগম ছেলে হত্যার জন্য শেখ হাসিনাকে দায়ী করে ট্রাইব্যুনালের কাছে তার ফাঁসি ছেয়েছেন। তিনি বলেন, আমার ছেলেকে যেদিন হত্যা করা হয়, তখন তার স্ত্রী আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পতনের পর মুক্ত দেশে তার একটি ছেলে সন্তান জন্ম হয়েছে। বয়স ১১ মাস। ছেলের বউ এই সন্তানসহ ট্রাইব্যুনালে এসেছে। এ সময় ছেলের বউ এবং তার কোলে থাকা ১১ মাসের নাতিকে দেখিয়ে বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সালাউদ্দিন আমার ছেলে রুবেলকে দুটি গুলি করেছে। অন্যরা কুপিয়েছে। সালাউদ্দিন নৌকার পার্টি করে। আমার ছেলে হত্যার জন্য শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড চাই। এ সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
আমার ছেলে হত্যার জন্য শেখ হাসিনার বিচার হতে হবে। সোমবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ তিনি জবানবন্দিতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এমন সাক্ষ্য দেন। এ সময় শহীদ রুবেলের স্ত্রীও কান্নায় ভেঙে পড়েন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলায় এদিন দেবিদ্বার উপজেলার শহীদ আব্দুর রাজ্জাক রুবেলের মা হাসনে আরা বেগমসহ ৫ জন সাক্ষ্য দেন। অপর সাক্ষীরা হলেন-জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেটিনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক যাকিয়া সুলতানা, পরিচালক ডা. খায়ের চৌধুরী, রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা শহীদ মারুফ হোসেনের বাবা মো. ইদ্রিস, জুলাই আন্দোলনে লক্ষ্মীপুরে আহত ছাত্রী আমেনা আক্তার। পরে তাদের জেরা করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।
এ মামলায় অপর দুই আসামি হলেন-সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। বিকালে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে মঙ্গলবার পর্যন্ত বিচার কার্যক্রম মুলতবি করেন ট্রাইব্যুনাল।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রেটিনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক যাকিয়া সুলতানা জবানবন্দিতে বলেন, চিকিৎসা নেওয়া জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ১১ জন দুই চোখের দৃষ্টি চিরতরে হারিয়েছেন। এ ছাড়া ৪৯৩ জন চিরতরে হারিয়েছেন এক চোখের দৃষ্টি।
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ ৪ আসামিকে আত্মসমর্পণ করতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তিনি পলাতক আসামি।
এদিন আদালতে প্রসিকিউশনের পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, আব্দুস সোবহান তরফদার, বিএম সুলতান মাহমুদ, গাজী এমএইচ তামিম, আবদুস সাত্তার পালোয়ান ও ফারুক আহাম্মদ, মঈনুল করিম, সাইমুম রেজা তালুকদারসহ অন্য প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন।
শহীদ রুবেলের মায়ের জবানবন্দি : হোসনে আরা বেগম বলেন, আমার ৪ মেয়ে ও ১ ছেলে। গত বছরের ৪ আগস্ট সকালে আন্দোলনে যোগ দিতে বাসা থেকে বের হয় আমার ছেলে আব্দুর রাজ্জাক রুবেল। বেলা দেড়টার দিকে বাড়ির পাশের একজন আমাকে বললেন, দেবিদ্বার থানার বানিয়াপাড়া আজগর আলী স্কুলের কাছে আপনার ছেলে আহত হয়েছে। সেখানে গিয়ে আমি দেখি দুজন মহিলা কাঁদছেন। রাস্তায় প্রচুর রক্ত। সেখান থেকে আমি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাই। সেখানে গিয়ে আমার ছেলের বউ, চার মেয়েকে দেখতে পাই। উপস্থিত লোকজন আমাকে বলেন, আপনার ছেলে মারা গেছেন। আমি ছেলের লাশ এক নজর দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ি।
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, নয়ন নামে এক দারোগা ওইদিন রাত নয়টার দিকে আমাকে ফোন দিলে আমি থানায় যাই। তিনি পোস্টমর্টেমের কাগজে আমার স্বাক্ষর নেন। এ সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমান সরকার আমাকে বলেন, মামলা করার দরকার নেই। নগদ ৭ লাখ টাকা, দুটি দোকানঘরের ব্যবস্থা করেছি। আমি এতে রাজি হইনি। তিনি বলেন, হাসিনা লোক দিয়ে আমার ছেলেকে মেরেছে।
১১ জন দুই চোখ, ৪৯৩ জন এক চোখের দৃষ্টি চিরতরে হারিয়েছেন : জবানবন্দিতে যাকিয়া সুলতানা বলেন, হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নেওয়া জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ২৮ জন দুই চোখে গুরুতর দৃষ্টিস্বল্পতায় ভুগছেন। ৪৭ জন এক চোখে গুরুতর দৃষ্টিস্বল্পতায় ভুগছেন। আর ৪৩ জন এক চোখে সাধারণ দৃষ্টিস্বল্পতায় ভুগছেন।
জবানবন্দির সময় যাকিয়া সুলতানার পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করে দেখান, আন্দোলনে আহত ৮৬৪ জন হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছিলেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, হাসপাতালটিতে যেসব রোগী চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন, তাদের অধিকাংশই মেটালিক পেলেট, কেউ কেউ রিয়েল বুলেটে আহত ছিলেন। রোগীদের আহত হওয়ার ধরন ছিল চোখের কর্নিয়া ছিদ্র হয়ে যাওয়া, চোখের সাদা অংশ ছিদ্র হয়ে যাওয়া, চোখ ফেটে যাওয়া, চোখের রেটিনা আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া ও চোখে রক্তক্ষরণ।
ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুরসহ ৪ জনকে আত্মসমর্পণে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তির নির্দেশ : এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ ৪ আসামিকে আত্মসমর্পণ করতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তিনি পলাতক আসামি। এ মামলায় তিনটি অভিযোগ আনা হয়েছে। সেগুলো হলো-গণ-অভ্যুত্থানের সময় ১৯ জুলাই রাজধানীর রামপুরায় কার্নিশে ঝুলে থাকা যুবক আমির হোসেনকে গুলি, গুলি বাসিত খান মুসার (৭) মাথা ভেদ করে চলে যায়। এতে তার দাদি মায়া ইসলাম মারা যান। একইদিন রামপুরায় মো. নাদিম নামের আরও এক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়।
শুনানিতে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই মামলায় মোট পাঁচ আসামি। তাদের মধ্যে চার আসামিকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আবেদন করলে তা মঞ্জুর করা হয়।
পুলিশের সাবেক এডিসি শচীন মৌলিককে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ : এদিকে তেজগাঁও এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় পুলিশের রমনা ট্রাফিক বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শচীন মৌলিককে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে এসে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাড্ডা এলাকায় শহীদ মারুফের বাবা ইদ্রিস বলেন, বিজিবির গুলিতে আমার সংসারের বড় ছেলে শহীদ হন। গুলিবিদ্ধ মারুফকে হাসপাতালে নিতেও দেয়নি পুলিশ-বিজিবি। এমনকি অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে গুলির খতস্থানকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখেন এক পুলিশ সদস্য। এভাবে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। তিনি ছেলে হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন।