Image description

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মাদক কারবারিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এই কারবার টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ডও ঘটানো হচ্ছে মাদক কারবারের বা হাটের নিয়ন্ত্রণ নিতে নিত্যদিন ঘটছে সংঘর্ষ নিত্যপণ্যের বিনিময়ে মায়ানমার থেকে আনা হচ্ছে ইয়াবা, আইসসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত দেড় বছরে দেশে মাদকসংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৭৭ হাজার ৭৪২টি হিসাবে গড়ে প্রতিদিন মাদকসংক্রান্ত মামলা হয়েছে ১৪২টি

মাদকাসক্তের হাতে ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে হত্যার ঘটনাও ঘটছে ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা দুই বন্ধু রাব্বি সাব্বিরের সঙ্গে পরিচয় হয় এক তরুণীর

তারা দুজনই মেয়েটির প্রেমে পড়ে বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে চরম বিরোধ বাধে একজন আরেকজনকে হত্যার পরিকল্পনা করে এক রাতে মাদক সেবন করে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ে দুই তরুণের একজন সাব্বির
 
সময় বন্ধু রাব্বি মাদক সেবন করে সাব্বিরকে গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে এরপর লাশ গুম করতে ময়লার স্তূপে ফেলে দেয়

সম্প্রতি পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীর চর এলাকায় এই ভয়ংকর ঘটনা ঘটে রাব্বিকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পাওয়া গেছে জানিয়ে কামরাঙ্গীর চর থানার ওসি আমিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, তারা তিনজনই মাদকসেবী ছিল। মাদক বিক্রেতা চক্রের সদস্যও ছিল তারা।

ওসি বলেন, কামরাঙ্গীর চরে সংঘটিত সব অপরাধের মূলে রয়েছে মাদক। গত এক বছরে প্রায় দুই হাজার মাদক মামলা হয়েছে থানায়।

গত কয়েক দিন রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মগবাজার রেলগেট, পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীর চর, মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পসহ আরো কয়েকটি এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত প্রকাশ্যে মাদক সেবনের পাশাপাশি চলে বিক্রি। মূল সড়কের পাশাপাশি অলিগলিতে চলে সেবন। সেখানে কিশোর তরুণদের উপস্থিতিই বেশি। ঢাকা মহানগর পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, রাজধানীর প্রতিটি থানা এলাকায় রাতে মাদকের কারবার চলে।

পুলিশ বলছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে দিনের চেয়ে রাতে মাদকের কারবার বেশি হয়। মাদক বিক্রির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে আমরা অভিযান অব্যাহত রেখেছি। মাদক বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

ঢাকার পল্লবী থানা ও কালশী বাসস্ট্যান্ডের মাঝামাঝি বালুর মাঠ বস্তির পাশ ঘেঁষে সড়কে রিকশার গ্যারেজ। যদিও এখান থেকে কাউকে রিকশা ভাড়া করতে দেখা যায় না। তবে সেখানে দিন-রাত চলে কিশোর ও যুবক বয়সীদের আনাগোনা। তাদের কেউ সরাসরি বস্তিতে ঢোকে, আবার কেউ রিকশাচালকদের সঙ্গে কথা বলতে থাকে। রিকশাচালক মহসিন মিয়া জানান, এলাকার বখাটে কিশোর, যুবকরা নিজেরাই স্পটে গিয়ে মাদক সংগ্রহ করে। ভালো ঘরের অনেক ছেলেও আসে, কেউ আবার গাড়ি নিয়েও আসে। তারা বস্তির ভেতর যায় না। রিকশাচালকদের মাধ্যমে তারা মাদক সংগ্রহ করে। বাড়তি টাকার আশায় অনেক রিকশাচালক এখানে বসে থাকে।

জানা যায়, বস্তির নির্দিষ্ট কয়েকটি গলিজুড়েই মাদকের হাট জমে উঠেছে। এর মধ্যে শারমিনের মাদকের হাট উল্লেখযোগ্য। মূলত সে হেরোইন বিক্রেতা। তবে একই স্থান থেকে পাওয়া যায় চাহিদা অনুয়ায়ী গাঁজা বা ইয়াবা।

বস্তির ভেতর ঢুকে দেখা যায়, গলির শেষ প্রান্তে এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘিরে আছে বিভিন্ন বয়সী কিশোর ও তরুণরা। টাকা দিতেই পকেট থেকে বের করে দিচ্ছে কাগজে মোড়ানো মাদক। পাতা বলতেই দেওয়া হচ্ছে হেরোইন।

এ সময় সড়কটির অন্য পাশে থাকা ফ্লাইওভারের নিচে বসে কয়েকজন যুবককে গাঁজা সেবন করতে দেখা যায়। গাঁজার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে কালশী মোড় পর্যন্ত। এক পাশে থানা, অন্য পাশে ট্রাফিক পুলিশের টহলের মধ্যে এমন চিত্র দেখা গেলেও প্রতিকারের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।

গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টায় মিরপুর ১১ নম্বরে মিল্লাত ক্যাম্পের পানির পাম্প লাগোয়া গলিতে মানুষের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। লাইনটি শেষ হয় একটি ভবনের কলাপসিবল গেটে। গেটের ভেতরে এক হাত ঢুকিয়ে তারা টাকা দিচ্ছিল, অন্য হাতে নিচ্ছিল কাগজের ছোট প্যাকেট। তাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এটি মাদক কারবারি পৃথিবীর হাট। হেরোইন ও ইয়াবার প্রথম সারির এই বিক্রেতা এখানে কারবার করে চুটিয়ে। সকাল ৮টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত মাদক বিক্রি চলে। রাত ৮টার পর মাদকসেবীর ভিড় বেশি থাকে। লাল গাজর (ইয়াবা) ও পাতা (হেরোইন) চেয়ে টাকা দিলেই মেলে চাহিদামতো মাদক।

হেরোইনের হটস্পট পল্লবী : রাজধানীর মিরপুর-পল্লবীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় গড়ে ওঠা অসংখ্য বস্তিতে মাদকের কারবার চলছে। মিল্লাত ক্যাম্প ঘিরে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে মোস্তাক নামের এক ব্যক্তির হাত ধরে পল্লবীতে হেরোইনের বিস্তার শুরু হয়। পরে তার পরিবারের অন্য সদস্যরাও এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে।

পুলিশের রেকর্ড ঘেঁটে জানা যায়, মোস্তাকের বিরুদ্ধে একাধিক মাদক মামলা রয়েছে। কয়েকবার গ্রেপ্তার হলেও অদৃশ্য প্রভাবশালী শক্তির কারণে সে পার পেয়ে যায়। বর্তমানে প্রকাশ্যে না থাকলেও আড়ালে থেকেই ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করছে সে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, এখন হেরোইনের সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে মোস্তাকের ছেলে সুমন। মোস্তাকের কাছ থেকে আলাদা হয়ে মাদক ব্যবসায় জড়িয়েছে তার বোন আনোয়ারি, জামিলা ও রাজিয়া। জামিলার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে তার মেয়ে ফাতেমা। আনোয়ারির ব্যবসায় জড়িত তার মেয়ে শান্তি ও ছেলে মাহতাব।

মিল্লাত ক্যাম্পের বড় হেরোইন ব্যবসায়ী পৃথিবী। মোস্তাকের হয়েই সে এই মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। ক্যাম্পের একাধিক বাসিন্দা জানায়, সকাল থেকেই পৃথিবীর মাদকের হাটে ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন চোখে পড়ে। এখানে প্রতিদিন কোটি টাকার মাদক বিক্রি হয়। প্রতি দুই ঘণ্টা পর পর মাদক বিক্রির টাকা বস্তায় ভর্তি করে সরিয়ে নেওয়া হয়।

এই ক্যাম্পে ইয়াবার সবচেয়ে বড় চক্র নিয়ন্ত্রণ করে ল্যাংড়া রুবেল। তার বিরুদ্ধে মাদকের একাধিক মামলা থাকলেও নির্বিঘ্নে চলছে তার ব্যবসা। ক্যাম্পে অর্ধশত চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীর মধ্যে রয়েছে হাফিজ এবং তার তিন ছেলে হৃদয়, জয় ও সুজন, হাফিজের বোন মুন্নি, ভাই হাব্বি, সাব্বু ও তার মেয়ে শারমিন ও মেয়ের জামাই জুম্মন।

বেগুনটিলা বস্তিতে গড়ে ওঠা একাধিক মাদকের হাটের মধ্যে হেরোইনের জন্য পরিচিত শারমিনের মাদকের হাট। পল্লবী থানার খুব কাছেই বস্তির একটি গলিতে দিন-রাত প্রকাশ্যেই চলে মাদকের কেনাবেচা।

বাউনিয়া বাঁধ এলাকায় হেরোইনের বড় ব্যবসায়ী পাতা সোহেল।

মিরপুর-১০ ও মিরপুর-১১ : মিরপুর ১০ নম্বরে গড়ে ওঠা থার্টিন হার্টস ক্যাম্প, মুসলিম ক্যাম্প ও ওয়াপদা বিল্ডিংসহ আশপাশের এলাকায় মাদক কারবারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক মো. মফিজ। ডিলার হিসেবে কাজ করে মফিজের ছেলে মো. আলী ও মেয়ের জামাই হাসান। তাদের বিরুদ্ধে থানায় মাদকসহ একাধিক মামলা রয়েছে। এই মাদকচক্রের হয়ে খুচরা বিক্রেতা হিসেবে কাজ করে গুড্ডান, মোহন, সানি, সুরাজ, রাকিব, কাল্লু, শামীম (ওরফে জানু), মাজলা আশিক ও বাড্ডী।