Image description
মায়ানমার সীমান্ত

প্রতিনিয়ত অভিনব কৌশলে মাদক কারবারিদের বিভিন্ন চক্র মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে মূলত ইয়াবার বড় চালান নিয়ে আসছে গত প্রায় মাস ধরে দেশ থেকে ওষুধ, খাদ্য, নির্মাণসামগ্রী, কৃষি উপকরণসহ বিভিন্ন পণ্যের বিনিময়ে মায়ানমার থেকে ইয়াবা, আইসসহ আরো মাদকদ্রব্য নিয়ে আসতে সংশ্লিষ্ট চক্রগুলোর ৎপরতা বেড়েছে কোস্ট গার্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সূত্রে জানা গেছে, এসব পণ্যের বিনিময় হয় সাগরের মায়ানমার অংশে বিশেষ করে মাছ ধরার নৌযানে পণ্য নেওয়া হয় মায়ানমারের আরাকান আর্মির সদস্যদের কাছে

এসব পণ্যের বিনিময়ে সেখান থেকে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য নৌযানে আনা হচ্ছে সাগর নদী ব্যবহার করে দেশ থেকে মায়ানমারে পণ্য পাচারকালে কোস্ট গার্ড গত এক মাসে কমপক্ষে চারটি চালান আটক করেছে এর আগে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরও পাচারে জড়িত একজনকে গ্রেপ্তার করেছে

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, মায়ানমার থেকে সাগরপথে নৌযানে ইয়াবার চালান এনে নাফ নদ পার করে তা টেকনাফ, নাইক্ষ্যংছড়ি ও থানচি উপজেলার বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় নেওয়া হচ্ছে।

এরপর এসব চালান সীমান্ত থেকে ১৭টি পথে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোস্ট গার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কালের কণ্ঠকে বলেছেন, পণ্যের বিনিময়ে ইয়াবা আনার চক্রের মূল হোতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। তবে ইয়াবা বহনকারীদের বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা ধরা পড়ার পর এসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম দপ্তরের উপপরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে মায়ানমারে বিভিন্ন পণ্য যাচ্ছে। তার বিনিময়ে দেশে ইয়াবা, আইসসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য আনা হচ্ছে। আমাদের কাছে এসংক্রান্ত তথ্য আছে। এসংক্রান্ত চালান ধরার পর আমরা এ নিয়ে কাজ শুরু করেছি। মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে অন্যান্য অংশের সংযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

 আরাকান আর্মি রাখাইনে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য তারা বাংলাদেশের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তাই সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্র মায়ানমার থেকে ইয়াবা ও আইস এনে বাংলাদেশ থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে ট্রান্স ন্যাশনাল সিন্ডিকেট কাজ করছে। মায়ানমার ও টেকনাফ সীমান্তে তাদের সদস্যরা থাকে। বাংলাদেশে সাগরপথে, নাফ নদ হয়ে টেকনাফ, নাইক্ষ্যংছড়ি, থানচির বিভিন্ন দুর্গম এলাকা দিয়ে মাদক দেশে আনা হচ্ছে। তারপর কমপক্ষে  ১৭টি পথে তা দেশের বিভিন্ন স্থানে নেওয়া হচ্ছে। তাতে শত শত বাহক জড়িত।

সূত্র জানায়, আগে ইয়াবা ও আইসের বিনিময় হতো ডলার, টাকা বা স্বর্ণের বিনিময়ে। কিন্তু মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর পরিবর্তন এসেছে আগের বিনিময় পদ্ধতিতে। রাখাইন রাজ্যে সহিংস পরিস্থিতি বিরাজ করায় এখন বাংলাদেশ থেকে চিনি, সার, পেঁয়াজ, সিমেন্ট, রসুন, লবণ, জ্বালানি, ভোজ্য তেল, শুঁটকি নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও নেওয়া হচ্ছে চিংড়ি পোনা, চকোলেট, টিন, কাঠ, টাইলস, শাড়ি, থ্রিপিস, কম্বল, কসমেটিকস, গয়না, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন পণ্য। কোস্ট গার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা লে. কমান্ডার মো. সিয়াম-উল-হক কালের কণ্ঠকে বলেন, পাচারকারীদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় বহু দ্রব্য আরাকান আর্মির কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। তার বিনিময়ে মূলত ইয়াবা সংগ্রহ করে বাংলাদেশে আনা হচ্ছে।

গত ১১ আগস্ট চট্টগ্রামের হালিশহর থানার কাট্টলী ঘাটসংলগ্ন সমুদ্র এলাকায় ৭৫০ বস্তা সিমেন্ট ও দুটি বোটসহ ২০ জন পাচারকারীকে আটক করে কোস্ট গার্ড। কোস্ট গার্ড জানিয়েছে, একটি চক্র সিমেন্টের বিনিময়ে ইয়াবা, মদসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে পাচার করত। তারই সদস্য আটককৃতরা। গত ৮ আগস্ট বাঁশখালী থানার খাটখালী মোহনায় অভিযানে ১০০ বস্তা সিমেন্টসহ একটি বোট জব্দ করে কোস্ট গার্ড। এই পাচারকাজে জড়িতরা সিমেন্টের বিনিময়ে ইয়াবা, মদসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে আনত। গত ৩ জুলাই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মইজ্জারটেক থেকে ১০ হাজার পিস ইয়াবাসহ জয়নাল আবেদীন নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এই অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, জয়নাল কাপড়ের ব্যবসায় জড়িত। তিনি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে কাপড় সরবরাহ করতেন। ২৪ লাখ টাকা সমমূল্যের কাপড় দিয়ে মায়ানমার সীমান্ত এলাকা থেকে তিনি ইয়াবার চালান সংগ্রহ করেছিলেন। কোস্ট গার্ড পূর্ব জোনের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট শাকিব মেহবুব বলেন, বাংলাদেশ থেকে মালপত্রগুলো ফিশিং ট্রলারে করে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর এগুলো গভীর সমুদ্র দিয়ে মায়ানমারে নিয়ে যাওয়া যায়। সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণ দিক দিয়ে তারা মায়ানমারে ঢোকে। তারপর পণ্যগুলো দিয়ে সেখান থেকে চক্রের সদস্যরা ইয়াবা ও অন্যান্য মাদক নিয়ে আসে। মায়ানমারে যুদ্ধ পরিস্থিতির পর আরাকান আর্মির কাছে অর্থসংকট তীব্র হয়। তাই তারা ইয়াবা ও অন্যান্য মাদকের বিনিময় করে। কোস্ট গার্ডের কর্মকর্তারা বলেন, কারা কারা দেশে এই ঘটনার মূল হোতাএ নিয়ে তদন্ত চলছে। যাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তারা মূলত বাহক। বড় অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তারা এই কাজ করছে। তদন্ত শেষে বলতে পারব এই চক্রে কতজন জড়িত।