
‘চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু করার, বলার ক্ষমতা নেই। মাঝে মাঝে মন চায় মরে যাই। আসলে এই মানসিক যন্ত্রণা আর নিতে পারছি না।
মোবাইল ফোনে গত মঙ্গলবার কালের কণ্ঠের কাছে এভাবে ইতালির ভিসা ও পাসপোর্ট না পাওয়া নিয়ে দুঃখ-কষ্টের কথা বলছিলেন শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার বাসিন্দা মো. কাদির শেখ। ইতালি যেতে তিনি ২০২৩ সালের ১৬ আগস্ট ভিএফএস গ্লোবালের সিলেট বিভাগের অফিসে পাসপোর্ট জমা দেন। আশা ছিল অল্প কিছুদিনের মধ্যে ইতালি পাড়ি জমাবেন। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, দুই বছর পার হলেও এখনো ইতালি পাড়ি জমাতে পারেননি কাদির শেখ। উল্টো পাসপোর্ট আটকে থাকায় অন্য কোনো দেশেও যেতে পারছেন না।
হতাশা নিয়ে কাদির শেখ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পাসপোর্ট না পাওয়ার কারণ ভিএফএসের কাছে অনেকবার খোঁজার চেষ্টা করেছি। তারা শুধু বলে, আপনাদের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই হচ্ছে। শিগগিরই আপনারা একটা সিদ্ধান্ত পাবেন।
কান্না জড়ানো কণ্ঠে তিনি আরো বলেন, ‘আমার পাসপোর্টটা থাকলে আরেক দেশে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। সেটাও বন্ধ। এখন এই মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে।
কাদির শেখের মতো আরো অসংখ্য ইতালি যেতে প্রত্যাশী ভুক্তভোগীর ভাষ্য মতে, ২০২৩-২৪ সালে জমা দেওয়া প্রায় তিন থেকে চার হাজার কর্মীর পাসপোর্ট ফেরত দেয়নি ভিএফএস গ্লোবাল। এতে এই কর্মীরা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্য কোনো দেশে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ফলে নানা ধরনের ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তাঁরা, যা এখন এই কর্মীদের অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে।
মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার বাসিন্দা মামুনুর রশিদ। ইতালি যেতে সাত লাখ টাকা খরচ করে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দেশটি থেকে ওয়ার্ক পারমিট আনেন তিনি। এরপর ২৬ নভেম্বর ভিএফএস গ্লোবালে পাসপোর্ট জমা দেন। পাসপোর্ট জমা দিতে আরো দুই লাখ টাকা খরচ হয় তাঁর। জমি বিক্রি ও ঋণ করে এই টাকা জোগাড় করেন তিনি।
কালের কণ্ঠকে মামুনুর রশিদ বলেন, ‘খুব মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে আছি। অনেক টাকা ঋণ করেছি। দুই বছর ধরে বসে আছি। কোনো কিছু করতে পারছি না। আগে একটা চাকরি করতাম। তাড়াতাড়ি ভিসা পেয়ে যাব এই আশ্বাসে চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। এখন ঋণ শোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ঋণের দায়ে বেশির ভাগ সময় পালিয়ে থাকতে হয়।’
পাসপোর্ট ভোগান্তির চেয়েও ভিসা জটিলতায় ভুগছেন অনেকে
২০২৪ সালে ইতালির শ্রমবাজারে ভিসা জটিলতা তৈরি হলে পাসপোর্টের স্ক্যান কপি রেখে মূল পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইতালি দূতাবাস, যাতে কর্মীরা চাইলে অন্য কোনো দেশেও যেতে পারেন। কিন্তু সে সময় তিন থেকে চার হাজার কর্মী পাসপোর্ট ফেরত পাননি বলে অভিযোগ করছেন। যাঁরা পাসপোর্ট ফেরত পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে এখনো প্রায় ৫০ হাজার কর্মী ভিসা জটিলতায় ভুগছেন বলে অভিযোগ তাঁদের। কর্মীদের ভাষ্য মতে, ইতালি যেতে ওই দেশ থেকে ওয়ার্ক পারমিট আনতে কর্মীদের অনেক অর্থ খরচ করতে হয়েছে। যদি তাঁরা ইতালির ভিসা না পান তাহলে ওই মাধ্যম থেকে কিছু অর্থ ফেরত পাওয়ার কথা, যা দিয়ে অন্য কোনো দেশে যাওয়ার চেষ্টা করা যাবে। কিন্তু ইতালির ভিসা দেওয়া কিংবা বাতিল না করায় তাঁরা কোনো অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না। কারণ, তাঁরা নিশ্চিত নন, তাঁদের ভিসা হবে কি হবে না। এর ফলে তাঁরা নানা ধরনের ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বাসিন্দা লোটাস পারভেজ। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে ইতালি যেতে ভিএফএস গ্লোবালে পাসপোর্ট জমা দিয়েছেন। এরপর পাসপোর্ট ফেরত পেলেও এখনো ভিসা জটিলতায় তিনি। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘দূতাবাস থেকে যেভাবে ভিসা দিচ্ছে সেভাবে দিলে আগামী চার-পাঁচ বছরেও আমাদের ভোগান্তি কাটবে না। আমরা বারবার বলছি, নির্দিষ্ট একটি সমাধান চাই। ওরা এক মাস ভিসা দেবে, পাঁচ মাস আটকে রাখবে—এটা তো সমাধান নয়। এখন তারা যদি আমাদের ভিসা না দেয় আমাদের আবেদনটার তো নিষ্পত্তি করবে। এভাবে ঝুলিয়ে রাখার মানে হয় না। আমরা যে মাধ্যমে ওয়ার্ক পারমিট এনেছি, সেখানে তো কিছু অর্থ দেওয়া হয়েছে। আবেদন নিষ্পত্তি হলে তারা সেখান থেকে আমাদের কিছু অর্থ ফেরত দেবে। তখন আমরা অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারি। আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়ায় সেটাও করতে পারছি না।’
কর্মীদের এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ভিএফএস গ্লোবালের একজন মুখপাত্র কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২০২৫ সালের ওয়ার্ক ভিসার আবেদনগুলো নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী প্রক্রিয়া হচ্ছে। আগের বছরের ওয়ার্ক ভিসার আবেদন ইতালির আইন ডিক্রি ১৪৫/২০২৪ অনুযায়ী স্থগিত রয়েছে। ইতালি কর্তৃপক্ষ যাচাই সম্পন্ন করার পরই দূতাবাস সেগুলো প্রক্রিয়া করতে পারবে, যা বর্তমানে চলমান। আর যেসব ভিসা আবেদনের সিদ্ধান্ত এখনো বাকি রয়েছে, সেসব পাসপোর্ট ইতালি দূতাবাসে সংরক্ষিত থাকে। আবেদনকারীরা চাইলে যেকোনো সময় তাঁদের আবেদন প্রত্যাহার করে দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট ফেরত নিতে পারেন।’
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের এখান থেকে যতজন মানুষ ইতালি যেতে চান, সেটি প্রক্রিয়া করার বিষয়টি আগেও দেখেছি ধীরগতি। এর কারণ, আমাদের চাহিদাটা বেশি বা মানুষজনের সংখ্যা বেশি। সে তুলনায় তাদের সক্ষমতাটা কম। এ বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কূটনৈতিকভাবে আলোচনা করতে হবে।’
২৬ আগস্ট থেকে হতে পারে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি
ইতালির শ্রমবাজারে ভিসা জটিলতা সৃষ্টি হলে ২০২৪ সালের ২২ এপ্রিল ইতালি দূতাবাসের সামনে মানববন্ধন করেন ইতালি গমনেচ্ছুকর্মীরা। এর পর থেকে প্রায় পাঁচ-ছয়বার রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় মানববন্ধন ও সভা-সমাবেশ করেছেন ইতালি গমনেচ্ছুকর্মীরা। কিন্তু কোনোভাবেই এর সমাধানের কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এবার সমাধানের পথ খুঁজে পেতে আগামী ২৬ আগস্ট থেকে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন শুরু করতে পারেন ইতালি গমনেচ্ছুকর্মীরা। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সামনে এ কর্মসূচি পালন করবেন তাঁরা।
তবে এই অবস্থান কর্মসূচি শুধু অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ইতালি গমনেচ্ছুকর্মীদের সমন্বয়ক লোটাস পারভেজ।
এ বিষয়ে কথা বলতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পশ্চিম ইউরোপ বিভাগের মহাপরিচালক মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শহিদুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাঁকেও পাওয়া যায়নি।
তবে গত ১১ আগস্ট এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় ইতালি দূতাবাসে ভিসার জন্য আবেদনকারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতালি দূতাবাসের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের ২২ অক্টোবরের আগে ইস্যু করা সব ওয়ার্ক পারমিট স্থগিত করা হয়। তা সত্ত্বেও এরই মধ্যে তারা প্রায় ৪০ হাজার মুলতবি আবেদনের মধ্যে আট হাজারেরও বেশি আবেদন নিষ্পত্তি করেছে। আরো প্রায় ২০ হাজার সম্ভাব্য আবেদনকারীর ওয়ার্ক পারমিট এবং এ সম্পর্কিত ভিসা প্রক্রিয়াকরণে যাচাই-বাছাই শিগগিরই শুরু করার কথা রয়েছে।