Image description

অতিবৃষ্টির কারণে যশোরের দুঃখ খ্যাত ভবদহ অঞ্চলের তিন উপজেলার দেড় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে । এই পরিস্থিতিতে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে । আর যেসব প্রতিষ্ঠানের আঙিনায় পানি রয়েছে , সেগুলোতে ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান । সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন , জলাবদ্ধতার কারণে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার ৬০ শতাংশের বেশি কমেছে । শিক্ষার্থীদের ঘাটতি পূরণে ক্লাস্টারভিত্তিক পাঠদান ও পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হবে । যশোরের মনিরামপুর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটি উত্তরপাড়া নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় । দোতলা ভবনবিশিষ্ট বিদ্যালয়টির সামনে বিস্তৃত খেলার মাঠ । তবে সেখানে কেউ খেলছে না । মাঠে কোমরপানিতে ভাসছে ডিঙিনৌকা । মাঠ ছাপিয়ে পানি ঢুকে পড়েছে শ্রেণিকক্ষে ।

পাশের সড়ক থেকে বিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে ভরসা বাঁশের সাঁকো আর কাঠের পাটাতন । মাঝেমধ্যে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে ডিঙিনৌকা । গতকাল সরেজমিন দেখা যায় , বিদ্যালয়টির নিচতলা ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় দ্বিতীয় তলায় কার্যক্রম চললেও শতাধিক শিক্ষার্থীর মধ্যে উপস্থিত মাত্র একজন । কথা হলে ওই শিক্ষার্থী জানায় , আশপাশের গ্রামগুলো পানির তলে , তাই ক্লাসে উপস্থিতি নেই । বিদ্যালয়টির শিক্ষক উজ্জ্বল চক্রবর্তী বলেন, ‘শতাধিক শিক্ষার্থী থাকা সত্ত্বেও পানির কারণে তারা ক্লাসে সময়মতো আসছে না । আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের আনার চেষ্টা করি, কিন্তু চারপাশে জলাবদ্ধতার কারণে তারা আসতে আগ্রহ দেখায় না । তা ছাড়া জীবন - জীবিকা নির্বাহের জন্য অনেকে মাছ ধরাকে পেশা হিসেবে নিয়েছে । ” ডহর মশিয়াহাটি উত্তরপাড়া নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একটু দূরেই কয়েকজনকে মাছ ধরতে দেখা যায় । তাদের মধ্যে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া রোহিত ধর নামের এক শিক্ষার্থীও রয়েছে । ছিপ দিয়ে মাছ ধরছে সে ।

কথা হলে রোহিত বলে , ‘ স্কুলের মাঠে মাঝা ( কোমর ) সমান জল । ক্লাসরুমেও জল । ক্লাস হচ্ছে না , তাই যাই না । বাড়িতেও জল । তাই রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে ডোবায় মাছ ধরছি । ' সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে , যশোরের মনিরামপুর , অভয়নগর , কেশবপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল গঠিত । বছরের পর বছর এসব এলাকার প্রায় ১৫০ টি গ্রাম বছরের ছয় মাস জলাবদ্ধ থাকে । ভারী বর্ষণে যশোরের মনিরামপুর , অভয়নগর ও কেশবপুর উপজেলার দেড় শ গ্রামের প্রায় চার লাখ মানুষ পানিবন্দী ।

এসব গ্রামের বেশির ভাগ ঘরবাড়ি , ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে প্লাবিত হয়েছে । এই অঞ্চলের নদীগুলো পলিতে ভরে যাওয়ায় আশির দশক থেকে স্থায়ী রূপ নিয়েছে জলাবদ্ধতা ; বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এটি প্রকট আকার ধারণ করে ।

গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন দেখা গেছে , অভয়নগরের সুন্দলী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় এবং সড়াডাঙ্গি জুনিয়ার স্কুল পুরোপুরি পানির নিচে । পাশে শেড করে বা রাস্তায় কোনোমতে ক্লাস চলছে । অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকলেও ছাত্র - ছাত্রীর উপস্থিতি কম । শিক্ষার্থী , অভিভাবক ও শিক্ষকেরা বলছেন , গ্রামের পর গ্রাম জলাবদ্ধতার কারণে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসতে পারছে না । জলাবদ্ধ এলাকার একাধিক শিক্ষার্থী জানায় , বিদ্যালয়ে যাওয়ার রাস্তায় কোথাও হাঁটুপানি , কোথাও কোমরপানি । স্কুলের মাঠে হাঁটুপানি , কোথাও আবার স্কুলের ক্লাসরুমে ও পানি । পানি মাড়িয়ে বাড়ি থেকে স্কুলে যেতে হচ্ছে ।

মনিরামপুর উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের বয়ারখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা তনুজা মল্লিক বলেন , “ শিক্ষার্থীদের বাড়িঘরে পানি উঠেছে , বিদ্যালয়েও পানি । ক্লাসরুমে পানির কারণে বেঞ্চের মাচা বানিয়ে কোনোরকমে শ্রেণি কার্যক্রম চালানো হচ্ছে । '

হাটগাছা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সনজিত মণ্ডল বলেন , ‘ সব শ্রেণিকক্ষে হাঁটুপানি । শিক্ষকেরা এলেও কোনো শিক্ষার্থী আসছে না । ’ শ্যামলী দাসর নামের এক অভিভাবক বলেন , ‘ আমাদের বাড়িঘর , রাস্তাঘাট — সব জায়গায় পানি । খুব কষ্টের মধ্যে আছি । স্কুলের সামনেও পানি ; তবে ভবনে পানি ওঠেনি । তাই প্রতিদিন কোলে করে ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যাই । প্রতিবছর এই ভোগান্তিতে পড়তে হয় । আমরা জলাবদ্ধতা নিরসনে স্থায়ী সমাধান চাই । ” নির্মল দাস নামের এক অভিভাবক বলেন , ‘ জলাবদ্ধতার কারণে অধিকাংশ বিদ্যালয়ে পানি উঠে গেছে । শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো ক্লাসে না আসায় পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে । শিক্ষকেরা বিদ্যালয়ে আসা - যাওয়ার মধ্যে থাকেন । এভাবে বছরের চার থেকে পাঁচ মাস অতিবাহিত হয় , ফলে শিক্ষার্থীরা পাঠদানে পিছিয়ে যাচ্ছে এবং অনেকে ঝরে পড়ছে । ' নারায়ণ চন্দ্র নামের এক শিক্ষক বলেন , ‘ জলাবদ্ধতার কারণে পাঠদান সম্ভব হচ্ছে না , শিক্ষার্থীরাও পিছিয়ে পড়ছে । একমাত্র সমাধান হলো জলাবদ্ধতা নিরসন । সরকার অনেক অর্থ ব্যয় করলেও কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসছে না । আমরা চাই বিদ্যালয়ের আসার পথ ও মাঠ উঁচু করে দেওয়া হোক । এতে চালু রাখা সম্ভব হবে বিদ্যালয়গুলো । '

যশোর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আশরাফুল আলম বলেন , “ তিন উপজেলায় ৯৪ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে । এতে উপস্থিতির হার ৫০ শতাংশের বেশি কমেছে । জলাবদ্ধ বিদ্যালয়গুলোর ছবিসহ মাটি ভরাটের আবেদন জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছি । আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে । তবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ ছাড় করাতে কিছুটা সময় লাগছে । ’ যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম বলেন , ভবদহ এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি অর্ধশতাধিক নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় , মাদ্রাসা এবং কলেজও জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে । শিক্ষার্থীরা যাতে পিছিয়ে না পড়ে , সে জন্য ক্লাস্টারভিত্তিক পাঠদান ও পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হবে । ”