Image description
সন্ধ্যা হলেই সক্রিয় হয়ে ওঠে এসব চক্র মিথ্যা ঘটনা তৈরি করে চলে আক্রমণ

গত ১৮ আগস্ট সন্ধ্যায় একটি জরুরি কাজে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় যান মুমিনুল ইসলাম। কাজ শেষ করে রাত সাড়ে ৮টার দিকে পল্লবী মেট্রো স্টেশনের দিকে যাচ্ছিলেন। স্টেশন থেকে ২০০ মিটার দূরে থাকতেই একজন মাঝ বয়সী লোক এসে মুমিনুল ইসলামকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার বাসা ‘বি’ ব্লকে না?’ না বলার পরেও তাকে দাঁড়াতে বললেন। মুমিনুল দাঁড়াতেই বলে বসলেন, ‘তুমি কাজটা ঠিক করো নাই। একটু আগে যেটা করলে।’ তখন মধ্য বয়সী আরেকজন লোক এসে পাশের জনকে বলেন, ভাই পোলাপান ডাকব? আশপাশেই আছে, সবাই রেডি। মুমিনুল কিছুই বুঝতে পারছিল না কী হচ্ছে তার সাথে। পরে আসা লোকটা বললেন, আপনি একজনের গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরেছেন। কাজটা কি ঠিক করেছেন? একটু আগে আপনি যাকে রিকশায় তুলে দিলেন।

 

মেয়েটি তার আপু পরিচয় দিলেও লাভ হয়নি। চক্রটি বলে, আপনি আমাদের বড় ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ঘুরেছেন। দূরে কয়েকজন ছেলে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে মুমিনুল বুঝতে পারলেন এটি একটি চক্র। পরে দুই ব্যক্তি বলেন, আপনি কি চান পোলাপান ডাকি? তাহলে কিন্তু এখান থেকে যেতে পারবেন না। আর আপনি যদি বলেন তাহলে আমিই সমাধান করে দিই।

সমাধানের কথা জানতে চাইলে পোলাপানদের ড্রিংকস খাওয়ার জন্য কিছু টাকা ও তাদের কাছে সরি বলতে বলেন। মুমিনুল না করাতে, চক্রটি আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে কথা বলতে থাকে। তখন মানিব্যাগে থাকা এক হাজার ৬০০ টাকা নিয়ে নেয়। পরে বিকাশে থাকা দুই হাজার ৪০০ টাকাও নিয়ে যায় চক্রটি।

মুমিনুল ইসলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের এক পোস্টে বলেন, একজন আপুকে ভারত থেকে একটা জিনিস আনতে দিয়েছিলাম। সেটি আনতে গিয়েই পল্লবী মেট্রো স্টেশনে এই ঘটনা ঘটে। আমি তো রীতিমতো বোকা বনে গেলাম। দুইজন ছাড়াও দূরে কয়েকজন ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। ওরা আমাকে মারার জন্য ছটফট করছিল। তারা চেয়েছে একটি জটলা সৃষ্টি করে আমার থেকে সব কেড়ে নিবে। তখন চিন্তা করলাম এখানে জোরাজুরি করে বিপদ বাড়ানো উচিত হবে না। টাকার চেয়ে আমার জীবনটা অনেক দামি। তাই মানিব্যাগ বের করে টাকা দিলাম। তারা সব নিয়েও সন্তুষ্ট ছিল না। পরে বিকাশের টাকাও ক্যাশ আউট করে নিয়ে যায়।

তিনি আরো বলেন, আমার মানিব্যাগে সব তন্নতন্ন করে খুঁজতে গিয়ে আমার অফিসের আইডি কার্ডটা ওদের চোখে পড়ে। ফোন আর মানিব্যাগটা আমাকে ফেরত দিয়ে বলে, আপনার বাপ-মায়ের দোয়া আছে বলে বেঁচে গেলেন। শুধু টাকাগুলো নিয়ে ছেড়ে দিলাম। এই হচ্ছে দেশের অবস্থা, নিরাপত্তার অবস্থা। যেখানে রাত সাড়ে ৮টায়ও নিরাপত্তা নেই। এমন একটা দেশে থাকি যেখানে নিরাপত্তা চাওয়া কিংবা পাওয়া যেন আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতো।

এই ঘটনা এখন প্রতিনিয়ত ঘটছে। আর এসব ছিনতাই চক্রগুলো জটলা সৃষ্টি করে তাদের স্বার্থ হাসিল করছে। পথচারীর গতি রোধ করে একটি মিথ্যা ঘটনা তৈরি করে চালানো হয় মারধর। আর এই সুযোগে তারা সর্বস্ব কেড়ে নেয়। আর সাধারণ মানুষকে বুঝায় সে অপরাধী। পুলিশ বলছে, অনেক চেষ্টা করে অপরাধী ধরা হচ্ছে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই অনেকে জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছে। তারপর আবার ছিনতাইয়ে যুক্ত হচ্ছে। ফলে একই অপরাধীর পেছনে বারবার ছুটতে হচ্ছে।

পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাসে ৪২৫ জন, জুনে ৩০৫ জন এবং জুলাইয়ে ৩৭৮ জন ছিনতাই মামলার আসামি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন ঢাকার আদালত থেকে। অর্থাৎ এমন পরিস্থিতির মধ্যেও গত তিন মাসে ঢাকায় ছিনতাই মামলার ১ হাজার ১০৮ আসামি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তারা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ৫০টি থানার ১ হাজার ৫৮টি মামলায় আসামি ছিলেন।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় সাম্প্রতিক কিছু সঙ্ঘবদ্ধ কর্মকাণ্ড বৈধতা পাওয়ায় এসবকে কাজে লাগাচ্ছে অপরাধীরা। একে অনেকে মব হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে। তা ছাড়া সামাজিক শক্তি নিষ্ক্রিয় হওয়ার কারণে অপরাধীরা আরো বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কেউ আক্রমণের শিকার হলে আশপাশের মানুষ দাঁড়িয়ে দেখলেও কেউ প্রতিবাদ করে না। এতে অপরাধ করে সবাই পার পেয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তি নিরাপত্তার বিষয় নানা সঙ্কটের মধ্যে পড়ে সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, একটি গ্রুপ বর্তমানে মবকে পুঁজি হিসেবে গ্রহণ করেছে। এই প্রক্রিয়া ব্যবহার করে একটি ছিনতাই গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। এসব চক্র ব্যক্তির গতিরোধ করে নিজেরাই কোনো প্রসঙ্গ সৃষ্টি করে অভিযুক্ত করে। মিথ্যা অপরাধকে নানাভাবে প্রমাণিত করে আক্রমণ করে সব কিছু ছিনিয়ে নেয়। বিশেষ করে অর্থসহ মূল্যবান জিনিসগুলো নিয়ে নেয়। মব বা সাধারণ মানুষের জটলা হচ্ছে একটি ছোঁয়াছে রোগের মতো। অল্প একটু হলে সেটাকে বিশাল আকার ধারণ করা যায়। কারণ অন্যজনের অপরাধের জন্য নিজে থেকে উদ্যোগ নিয়ে আক্রমণ করে। তখন তার মতো একই সুযোগে থাকা মানুষকে একসাথে জড়ো করে।

তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যখন দেশজুড়ে একাধিক মব বা সঙ্ঘবদ্ধ আক্রমণের ঘটনা হয়েছিল, তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব করে। এতে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অপরাধী গোষ্ঠী নানা ধরনের অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। তা ছাড়া এখনো বিভিন্ন সময় জটলা সৃষ্টি করে মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। তাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো পদক্ষেপ নেই। তাই অপরাধীরাও এটিকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে। চক্রগুলো তাদের মতো করে একটি অপরাধের অভিযোগ তৈরি করে আক্রমণ চালায়। সন্ধ্যার পর থেকে সকাল পর্যন্ত ছিনতাইসহ নানা অপরাধ বেশি হচ্ছে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে দিন দিন অপরাধের মাত্রা বেড়েই চলবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্) মো: নজরুল ইসলাম বলেন, জটলা বা মব সৃষ্টি করে ছিনতাই একটি নতুন পদ্ধতি। আমরা খোঁজ নিয়ে জানার চেষ্টা করব কে বা কারা এসবের সাথে জড়িত। পরে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।