Image description

আসন্ন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্টিত হবে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। শুধু নির্বাচন আয়োজনের জন্যই এ সরকার গঠিত হবে। এবং এর মেয়াদ থাকবে তিন মাস। নতুন এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন তা এখনো নির্ধারিত হয়নি। তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নতুন সরকারের প্রধান পদে থাকছেন না, এটা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত। শীর্ষনিউজ ডটকমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজের গত ২১ জুলাইয়ে প্রকাশিত সংখ্যায় “নির্বাচন আয়োজনে নতুন সরকার আসছে” শিরোনামে প্রতিবেদনে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছিল। যা নিয়ে ব্যাপক তোলাপাড় সৃষ্টি হয় জাতীয় এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে।

কোন ফর্মূলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান নিয়োগ হবে তা নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনার পর অবশেষে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জুলাই সনদের খসড়ায়ও এটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধীদলের) এবং জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলের মনোনীত একজন প্রতিনিধির সমন্বয়ে ৫ সদস্যের কমিটি গঠিত হবে। এই কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে ব্যর্থ হলে বিচার বিভাগ থেকেও দু’জন প্রতিনিধি এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

তবে এখন যেহেতু নির্বাচিত সরকার বা জাতীয় সংসদ নেই, একেবারেই ভিন্ন প্রেক্ষাপট বিরাজ করছে- তাই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন বা কোন পদ্ধতিতে সরকার প্রধান বাছাই করা হবে তা এখনো নির্ধারিত হয়নি। আশা করা হচ্ছে, অচীরেই একটা সিদ্ধান্ত আসবে। এ বিষয়গুলো নিয়ে সরকার এবং দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও কূটনৈতিক মহল বেশ তৎপর। সর্বশেষ গত ১৫ আগস্ট প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন। প্রধান বিচারপতির হেয়ার রোডস্থ বাসভবনে এই সাক্ষাত হয়। সাক্ষাতের বিষয়বস্তু যদিও শুধুমাত্র ‘সৌজন্য’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাস্তবে কিন্তু রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই আলোচনা হয়েছে। তারমধ্যে রয়েছে, আসন্ন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং রাষ্ট্রপতি ইস্যু, জানাচ্ছে কূটনৈতিক সূত্রগুলো।

সূত্রমতে, রাষ্ট্রপতি পদে মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর আয়ু শেষ হয়ে আসছে। এর আলামত ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে। গত ১৬ আগস্ট রাতে অনেকটা হঠাৎ করেই বিদেশস্থ বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলো থেকে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর ছবি নামানোর নির্দেশ দেয়া হয়। নির্দেশটি ছিল অলিখিত। যে কারণে মিশনগুলোর অনেকেই বিভ্রান্তিতে পড়ে গিয়েছিলেন- এটি আদৌ সঠিক কিনা। পরবর্তীতে অবশ্য, সরকারের তরফ থেকে পরিষ্কারভাবে মৌখিক নির্দেশ দেয়ার পর সবগুলো মিশন থেকেই ছবি নামানোর কাজ সম্পন্ন হয়।

কিন্তু এর শেষ পরিণতি কি, তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, ছবির স্থানটি আপাততঃ খালি থাকবে। তার পরও এ নিয়ে আলোচনা শেষ হচ্ছে না। মোটামুটি সবারই এটা বুঝ হয়ে গেছে যে, রাষ্ট্রপতি পদে সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর আয়ু শেষ হয়ে এসেছে। রাষ্ট্রপতি পদে পরিবর্তন নিয়ে যাতে বড় ধরনের কোনো আলোড়ন সৃষ্টি না হয়, দেশবাসীর মাথায় আগে থেকেই ‘সেট’ হয়ে থাকে মূলতঃ এজন্যই ছবি নামানোর কাজটা আগে করা হয়েছে।

নির্বাচন আয়োজনের নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস থাকছেন না, এটা শীর্ষ কাগজের গত ২১ জুলাইয়ের প্রতিবেদন এবং এ প্রতিবেদনেও ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার পর তাঁর ‘এক্সিট’ হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদটা খালি করা হবে। ড. ইউনূস যাতে রাষ্ট্রপতি পদে যেতে পারেন, এ ব্যাপারে রাস্তা তৈরি করতেই মার্কিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন প্রধান বিচারপতির বাসভবনে সৌজন্য সাক্ষাতে গেছেন, বলছে সূত্রগুলো।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আশা করেছিলো, এশিয়া অঞ্চল নিয়ে মহাপরিকল্পনা এই দফায় বাস্তবায়ন করতে পারবে। পরিকল্পনা ছিল মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন আরাকানকে মানবিক করিডোর দেয়া হবে বাংলাদেশের উপর দিয়ে। মানবিক করিডোরের নামে মূলতঃ এনজিওগুলোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সরবরাহ হতো। ১ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে কোনো নারী-শিশু নেই। আরাকান আর্মির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যই এদের প্রস্তুত করা হয়েছে। মিয়ানমার পুরোটা দখল করার মতো সেনা জনবল আরাকান আর্মির নেই। তাই রোহিঙ্গাদের যুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল। সেই যুদ্ধটা বাধানো গেলে যুদ্ধের অজুহাতে বাংলাদেশে নির্বাচনের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতো। যুদ্ধ যেহেতু অনির্দিষ্টকাল যাবৎ চলতো, তাই বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনও অনির্দিষ্টকাল বন্ধ থাকতো। সেক্ষেত্রে ড. ইউনূস সরকার দীর্ঘস্থায়ী হতো, এতে দেশের জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো বালাই থাকতো না। এমন ব্লু-প্রিন্ট বাস্তবায়নের জন্যই মূলতঃ মানবিক করিডোরের কাজ অনেকটা দ্রুততার সঙ্গেই এগোচ্ছিল। কিন্তু বেশি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সবকিছু উলট-পালট হয়ে যায়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, ড. ইউনূসকে নিজের চেয়ার ঠিক রাখতে গিয়ে পদত্যাগের হুমকিও দিতে হয়।

নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, মানবিক করিডোর ইস্যুতে গোলমাল বেধে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ড. ইউনূসকে পরিস্থিতি শান্ত করার পরামর্শ দেয়া হয়। করিডোরের ইস্যুটি তাৎক্ষণিকভাবে আপাততঃ স্থগিত রাখতে বলা হয়। সেই থেকে এ বিষয়ে আর কোনো তৎপরতা প্রকাশ্য হয়নি। বরং ড. মুহাম্মদ ইউনূস পরে টিভি ভাষণে এটিকে ‘চিলে কান নিয়ে যাওয়া’র সঙ্গে তূলনা করেছেন। অর্থাৎ তিনি এ পথে আপাতত: নেই।

কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘকালের পরিকল্পনা, যে কারণে বার্মা অ্যাক্ট করা হয়েছে, মিয়ানমার থেকে আরাকানকে আলাদা করা হয়েছে, ভারতের সীমান্ত রাজ্যগুলোতে এবং বাংলাদেশেও অনেক শ্রম ও অর্থ ব্যয় হয়েছে সেই পরিকল্পনা থেকে এত সহজে বেরিয়ে আসবে অথবা প্রকল্পটি বাদ দেবে- এটা মনে করার কোনো যুক্তি নেই। মার্কিনীদের পলিসি এরকমের নয়। মূলতঃ মানবিক করিডোর ইস্যু থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ছিটকে পড়লেও এটাকে সামাল দিয়ে সামনের দিকে এগোনোর চেষ্টা করছে তারা।

যুক্তরাষ্ট্র ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে ‘বিএনপি মাইনাস’র যে নীতিতে চলে আসছিলো, ৫ আগস্টের (২০২৪) পরও একই নীতিতে অটল ছিল কঠোরভাবে। এই কর্মসূচিতে তারা অন্তর্র্বতী সরকারের সঙ্গে জামায়াত এবং জামায়াতের বি টিম এনসিপিকেও যুক্ত করেছে, দীর্ঘকাল এভাবে নির্বাচন ছাড়াই সরকার পরিচালনার প্রলোভন দিয়ে। কিন্তু এখন হঠাৎ করেই সবকিছু পাল্টে যাচ্ছে। জামায়াত-এনসিপির সঙ্গে কোনো রকমের আলোচনা না করেই ড. ইউনূস লন্ডনে উড়ে গিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে সমঝোতা এমনকি লিখিত চুক্তিও হয়েছে, যা যৌথ ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। এমন সমঝোতার খবরে জামায়াত এবং এনসিপি যেন আকাশ থেকে পড়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে তারা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। পরবর্তীতে একমত্য কমিশনের বৈঠকও বয়কটে করেছে। ড. ইউনূস  ফোন করে জামায়াতের মান ভাঙিয়েছেন- তাদের স্বার্থ দেখবেন, আশ্বাস দিয়েছেন। যারফলে জামায়াত পরে ঐকমত্য বৈঠকে যোগ দেয়। কিন্তু গত ৫ আগস্ট হাসিনা পলায়নের বর্ষপূর্তের দিনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে জাতীয় নির্বাচনের যে সময়সীমা ঘোষণা করেন জামায়াত এবং এনসিপি এটিকে ঠেকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিল। ব্যর্থ হয়েছে। প্রকাশ্যে ক্ষোভও প্রকাশ করেছে। এমন একটা দিনে এনসিপির শীর্ষ নেতারা শহীদ পরিবার ও আহতদের পাশে না থেকে কক্সবাজারে প্রমোদ ভ্রমণে গেছেন, যা নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। দলের পক্ষ থেকে তাদের ‘শোকজ’ও করা হয়েছে।

এরপরও দল দু’টি নির্বাচন ঠেকানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে আসছে। প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। অবশেষে দেখা যাচ্ছে,  তাদের এসব চেষ্টা কোনোই কাজে আসছে না। ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাদের দেখানো পথে এখন আর হাঁটছেন না। তিনি লন্ডনের চুক্তি অনুযায়ীই চলছেন। আদতে এর বাইরে যাওয়ার সুযোগও নেই তাঁর। তাঁর নিজেরও তো ‘এক্সিট’র অপরিহার্যতা রয়েছে। ড. ইউনূস এটা ভালো করেই বোঝেন যে, তিনি না চাইলেও নির্বাচন হয়ে যাবে এবং তাকে সরে যেতে হবে। তবে তা মোটেই সম্মানজনক হবে না তাঁর জন্য।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এমন স্বার্থপর আচরণে চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছে জামায়াত এবং এনসিপি। তারা এখন প্রকাশ্যেই ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় সমালোচনা করছেন। ১৬ আগস্ট দলের এক আলোচনায় সভায় দেয়া বক্তৃতায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, “যাকে গণঅভ্যুত্থানের পরে সরকারপ্রধান বানানো হয়েছে উনি লন্ডনে গিয়ে সিজদা দিয়ে এসেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনা আছে কি না অন্তর্র্বতীকালীন সরকারপ্রধান একটি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সাথে বসে প্রেস কনফারেন্স করছেন। তিনি দাবি করেন, সেদিনই সরকারকে লন্ডনে ‘বিক্রি করে’ দেওয়া হয়েছে।”

এর পরের দিন রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটশন মিলনায়তনে আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তৃতাদানকালে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “আপনি বলেছেন সংস্কারের পর নির্বাচন। তাহলে এখন সংস্কার নিয়ে টালবাহানা কেন? আমরা কি ৩০ দিন চড়ুইভাতি খেলতে গিয়েছিলাম। এটা কি হাডুডু খেলা ছিল। খেলা খেলা ছিল। আমরা তো সিরিয়াসলি নিয়েছি।”