Image description
বিটিআরসিতে নিয়োগ পদোন্নতিতে অনিয়ম

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে (২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল) ১৫ বছরে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ-পদোন্নতিতে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও কারসাজির আশ্রয় নেওয়া হয়। গাড়িচালক থেকে শুরু করে পরিচালক, এমনকি কমিশনার ও পরামর্শক পদে নিয়োগেও আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। মঞ্জুরিবিহীন পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত ৫ জন পরামর্শক এবং প্রকল্পে কর্মরত ২৫ জন কর্মকর্তার বয়স প্রমার্জন করে নিয়োগ দেওয়া হয়। একজন কমিশনার পদে থেকে প্রায় তিন বছর অবৈধভাবে বেতন ও ভাতা সুবিধা নিয়েছেন। ওই সময়কালে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ছাড়াই প্রকল্পভিত্তিক কর্মরত ও জুনিয়র কনসালটেন্টদের অনেক পদে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ধীরে ধীরে তারা সিন্ডিকেট তৈরি করে নিয়োগ-পদোন্নতির ক্ষমতা নিজেদের হাতে নেয়। শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে চাকরি করেন কমিশনের লাইসেন্সিং শাখার মহাপরিচালক এবং দুই উপপরিচালক।

গত ১২ মার্চ ‘এ যেন মিনি আওয়ামী কার্যালয় : বিটিআরসিতে ফ্যাসিস্টের দোসররা বহাল তবিয়তে’ শিরোনামে যুগান্তরে প্রতিবেদন প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসে সংশ্লিষ্ট দপ্তর। গঠন করা হয় একাধিক তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে যুগ্মসচিব মোহাম্মদ আবদুল হান্নানের নেতৃত্বে গঠিত বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন যুগান্তরের হাতে এসেছে। তাতে দেখা যায়, ২০০৯ সালে বিটিআরসিতে নিয়োগ পাওয়া ২৯ জন কর্মকর্তার মধ্যে অন্তত ১৫ জনের নিয়োগে অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে কমিটি। একই সঙ্গে তিন কর্মকর্তা নিয়মবহির্ভূতভাবে পদোন্নতি পেয়েছেন বলে প্রমাণ পেয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। আরও অন্তত ৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও চাকরি বিধিমালা ভঙ্গের প্রমাণও উঠে এসেছে তদন্তে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব (টেলিকম) ও বর্তমানে বাংলাদেশ হাই-টেক পার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত পৃথক কমিটি একজন পরিচালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করে। এতে তার বিরুদ্ধে অনিয়ম প্রমাণিত হলেও তিনি রাজস্ব বিভাগে স্বপদে এখনো বহাল।

২০০৯ থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের আগ পর্যন্ত বিটিআরসির নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নে অনিয়ম তদন্ত করতে কমিশনের লাইসেন্সিং শাখার মহাপরিচালককে প্রধান করে আরও একটি কমিটি গঠন করে সংস্থাটি। ১৬ মার্চ গঠিত এ কমিটিকে ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। তবে কমিটি এখন পর্যন্ত তদন্ত শেষ করতে পারেনি।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে গঠিত বিভাগীয় তদন্ত কমিটি বলছে, প্রকল্পভিত্তিক কর্মরত ও জুনিয়র কনসালটেন্টদের কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ছাড়াই সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ধীরে ধীরে তারা সিন্ডিকেট তৈরি করে নিয়োগ-পদোন্নতির ক্ষমতা নিজেদের হাতে নেয়। এই কমিটির প্রাথমিক তদন্তে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন উপপরিচালক থেকে পরিচালক পদে পদোন্নতি পাওয়া এয়াকুব আলী ভূইয়া, আফতাব মো. ওয়াদুদ এবং এমএ তালেব। একই সঙ্গে ১৭ জন ড্রাইভার নিয়োগ এবং রাজস্ব খাতের বিভিন্ন পদে জনবল কাঠামোবহির্ভূতভাবে, মঞ্জুরিবিহীন পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত পাঁচজন পরামর্শক এবং প্রকল্পে কর্মরত ২৫ জনকে বয়স প্রমার্জন করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, এসব নিয়োগ ও পদোন্নতি ‘বিটিআরসির চাকুরি প্রবিধানমালা ২০০৯’ লঙ্ঘন করে সম্পন্ন হয়েছে।

অন্যদিকে কমিশনের লাইসেন্সিং শাখার মহাপরিচালক আশীষ কুমার কুন্ডু এবং দুই উপপরিচালক আসাদুজ্জামান ও শারমিন সুলতানা প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত। মহাপরিচালক আশীষ কুমার কুন্ডুর বিরুদ্ধে সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। উপপরিচালক আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। শারমিন সুলতানার বিরুদ্ধে অনুমোদন ব্যতীত বিদেশ ভ্রমণের প্রমাণ মিলেছে।

আরেক পরিচালক এয়াকুব আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগে অনিয়ম প্রমাণিত হলেও তিনি রাজস্ব বিভাগে স্বপদে বহাল। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এয়াকুব আলীর পদায়নে প্রশাসন বিভাগের মহাপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন কর্তব্যে অবহেলা করেছেন।

বিটিআরসিতে কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নিয়োগ ও পদোন্নতিতে আইন লঙ্ঘন করে তৎকালীন আওয়ামী সরকার ও তার প্রশাসন। পাশাপাশি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে শর্ত উপেক্ষা করে ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুশফিক মান্নান চৌধুরীকে বিটিআরসির কমিশনার হিসাবে নিযুক্ত করে। ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পরও ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকেন তিনি। এ খবর জানাজানি হলে অন্তর্বর্তী সরকার তার নিয়োগ বাতিল করে।

যুগান্তরের হাতে আসা সংশ্লিষ্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর ৩০ জুলাই স্বাক্ষরিত চিঠিটি পর্যালোচনা করা হয়। এতে দেখা যায়, ‘অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ হয়েছে মর্মে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে দেওয়া মতামত ও সুপারিশের ভিত্তিতে অভিযুক্তদের ‘বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’ (ওএসডি) করার নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি তাদের ‘সাইনিং পাওয়ার’ বা স্বাক্ষরের ক্ষমতাও প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হয়।

এদিকে পরিচালক এয়াকুব আলীর পদায়নে প্রশাসন বিভাগের মহাপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন কর্তব্যে অবহেলা করেছেন মর্মে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এয়াকুব আলীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং মহাপরিচালক আল মামুনকে বিটিআরসি থেকে প্রত্যাহার করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে তদন্ত কমিটি সুপারিশ করেছে।

এদিকে ৩০ জুলাই টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বিটিআরসির চেয়ারম্যানকে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করে, কমিশনার হিসাবে অধ্যাপক মুশফিক মান্নান চৌধুরীর যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে, তা নীতিবহির্ভূত। চিঠিতে তাকে কমিশনার পদে থেকে প্রাপ্ত বেতনভাতাদি ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়।

যদিও সোমবার পর্যন্ত এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক এখনো কোনো কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়নি বলেও জানা গেছে। বিটিআরসির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানা সময় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। এর মধ্যে তিনটি প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ীই এ নির্দেশনা জারি করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বিটিআরসিতে এসব নিয়োগ-পদোন্নতিতে অনিয়ম হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেকটা জেনেশুনেই। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যোগসাজশে নিয়ম ভেঙে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার ও জহুরুল হকের সময়ও অনিয়মিত নিয়োগপ্রাপ্তদের পদোন্নতি দিয়ে সিন্ডিকেটকে আরও শক্তিশালী করা হয়। ২০২৩ সালে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দপ্তর এক কমপ্লায়েন্স অডিটে বিটিআরসির নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অনিয়মের বিস্তৃত তথ্য প্রকাশ করে। তবুও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং অডিট আপত্তি এড়িয়ে অভিযুক্তদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী বলেন, মন্ত্রণালয়ের চিঠি কমিশন সভায় আলোচনা হবে। আগামী সপ্তাহে কমিশন সভা রয়েছে। সিদ্ধান্ত যাই আসুক, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।