
কুয়াকাটার মৎস্য বন্দর আলীপুর। নিভৃত এক জেলে পল্লী। যেখানে প্রতিটি ঘর থেকেই পাওয়া যায় সমুদ্রের গন্ধ। এই পল্লীতে বাস করেন আ. রশীদ। পরিবারে সদস্য সংখ্যা আটজন। স্ত্রী নুরভানু, ছেলে হাসান, বিবাহযোগ্য মেয়ে জয়নব, ১২ বছর বয়সী জায়েদা, ১০ বছরের জুনায়েদ এবং সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী ছোট মেয়ে আয়শাকে নিয়ে কোনোমতে চলছিল দিন। মাস তিনেক হলো হাসানকে বিয়ে করিয়ে ঘরে বৌ এনেছেন। পাশের তাহেরপুর গ্রামের সোহরাব সরদারের মেয়ে। বিয়ের ১১ দিনের মাথায় সাগরে বাবার সঙ্গে মাছ শিকারে গিয়ে বাবা-ছেলে এখন দু’জনই নিখোঁজ।
হাসানের সদ্যবিবাহিতা কিশোরী স্ত্রী আকলিমা স্বামীর অপেক্ষায় আছেন। হাতের মেহেদির রং এখনও মুছে যায়নি। নুরভানু অপেক্ষায় আছেন ছেলে ও স্বামীর জন্য। ছোট মেয়ে আয়শা সারাক্ষণ মায়ের আচল ধরে ঘুরে বেড়ালেও কতক্ষণ পরপর বাবা ও বড়ভাইকে অনেক দিন ধরে না দেখার কারণ জানতে চাইছে মায়ের কাছে। কখন আসবে, তার জন্য কী নিয়ে আসবে-এই প্রশ্নবানে জর্জড়িত মা নুরভানু।
বাবার আয়-রোজগারে সহযোগী হতে হাসান (২২) মাছ ধরার পেশায় নামে। ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। জেলে আ. রশীদের পক্ষে সংসারের বোঝা সামলানো অসম্ভব হয়ে উঠায় ছেলে হাসান নাম লেখায় জেলে পেশায়। সেদিন একটি মাছধরা ট্রলারসহ ১৪ জনের দল সাগরে গিয়ে সবার সঙ্গে বাপ-ছেলেও নিখোঁজ হন। বাবা আ. রশীদও তার যৌবন বয়সে মাছ ধরার পেশায় যুক্ত হন। তার বাবা তোজাম্বর আলীও জেলে ছিলেন। এভাবে বংশ পরম্পরায় তারা জেলের কাজ করছেন। হাসানও ১৪ বছর বয়স থেকে সমুদ্রে কঠোর পরিশ্রমের জীবন বেছে নিতে বাধ্য হন।
প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে, বিশেষ করে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে সমুদ্র প্রচণ্ড উত্তাল থাকে। ঝুঁকিপূর্ণ হলেও উপকূলের জেলেরা এই মোক্ষম সময়টাতেই মাছ ধরার জন্য মুখিয়ে থাকেন। কারণ এটা ইলিশ শিকারের উপযুক্ত সময়। এখন জেলে পল্লীতে একদিকে চলে ইলিশ উৎসব, অন্যদিকে পরিবারের প্রিয়জনকে হারানোর বেদনায় চোখের পানি ফেলে কোনো কোনো পরিবার।
প্রতিবছর এমন দিনে কুয়াকাটার জেলে পল্লীগুলোর চিরচেনা দৃশ্য নিয়ে এখন আর কেউ মাথা ঘামায় না। ২০২১ সালে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজ হয়ে পরে লাশ উদ্ধার হয় কুয়াকাটার খাজুরা গ্রামের মানিকের। তার স্ত্রী আখি বেগম বলেন, ‘সাগরপাড়ে জন্ম নিয়া মাছ ধরতে হবে জীবন বাজি রেখে। কেউ ফিরবে আবার কাউকে সাগরে গিলে খাবে! এটাই নিয়তি। এই কয় বছরে এখন আর এসব নিয়া চিন্তা করি না।’
সাগরপাড়ের জেলে পরিবারগুলোর জীবনচক্র সাগরজলে মাছ শিকারের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। তবু এই পেশা থেকে বের হতে পারেন না জেলেরা। আড়তদারদের কাছ থেকে দাদন (অগ্রিম) নিয়ে ট্রলার মালিকরা মাছ ধরার সরঞ্জাম জোগাড় করেন। আবার এই ট্রলার মালিকরা দাদনের বিনিময়ে জেলেদের মাছ ধরা পেশায় আটকে রাখেন। এভাবেই দাদনচক্রে প্রবেশ করে এক-একটি উপকূলীয় জেলে পরিবার। ফলে প্রতিবছর ইলিশ মৌসুমে সাগরে মাছ শিকারে গিয়ে অনেকের সম্পদ বিনষ্ট হওয়ার পাশাপাশি পরিবারের কর্মক্ষম মানুষটাকে হারাতে হয়। এতে কেউ হারাচ্ছেন বাবা কিংবা সন্তানকে, আবার কেউ হারাচ্ছেন তার প্রিয় মানুষটাকে। কেউ কেউ হচ্ছেন বিধবা কিংবা সন্তানহারা। কিন্তু তবুও পেশা বদলাতে পেরেছে খুব কম সংখ্যক জেলেই।
নিখোঁজ জেলে আ. রশীদ ও ছেলে হাসানের পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে গেলে কেঁদে উঠেন হাসানের মা নুরভানু। তিনি বললেন, ‘আমার পোলা আর স্বামী বাইচ্চা আছে, না মইর্যা গ্যাছে-তা কইতে পারি না। অ্যাহোনো প্রত্যেকদিন নদীর ঘাটে যাই, যদি কেউ কোনো খবর লাইয়া আসে’। কিভাবে সংসার চলছে, জানতে চাইলে নুরভানু বলেন, চিংড়ি মাছের মাথা ভেঙে যা আয় হয় তাতে কোনোমতে সংসার চলে।
কুয়াকাটার চরগঙ্গামতি এলাকার জেলে নজির আহম্মেদ বলেন, ‘আমাগো এই জাইল্যা পেশাডা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। সাগরের উত্তাল ঢেউ, ট্রলার দুর্ঘটনা-সবকিছু আমাগো সঙ্গে জড়িত। কিন্তু আমাগো পোলারা ছাড়া এই পেশা চালানো সম্ভব না। সাগরই আমাগো জীবিকার একমাত্র উৎস’।
এদিকে, সমগ্র উপকূলের জেলে পল্লীর প্রতিচ্ছবিই এমন-যেখানে বাবা ও সন্তানদের সমুদ্রের মাঝে হারানো সাধারণ ঘটনা। জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তারা সমুদ্র ছাড়তে চায় না। কারণ এখানেই তাদের জীবিকা এবং অস্তিত্ব।
সমুদ্রের শীতল বাতাস, ঢেউয়ের গর্জন, ঝড়ের ভয়ডর-সব মিলিয়ে এই জেলে পরিবারগুলোকে এক অনিশ্চিত জীবনের মুখোমুখি দাঁড় করায়। কিন্তু তাদের ধৈর্য, আশা এবং একে অপরের প্রতি মমতা তাদের পেশায় টিকিয়ে রেখেছে। এভাবে আ. রশীদ ও হাসানের পরিবার প্রতিটি দিন কাটায়-আশা ও দুঃখের মিশ্রণে। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে, যে কোনো দিন হাসানরা ফিরে আসবেন-এমন প্রত্যাশায়।