Image description
ট্রাইব্যুনালে শহীদ আস-সাবুরের বাবার মর্মস্পর্শী জবানবন্দি

আদালতে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হত্যাকাণ্ডের ভিডিও দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না হতভাগ্য বাবা এনাব নাজেজ জাকি (৬০)। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দিন আশুলিয়ায় গুলি করে হত্যার পর ছয়জনের লাশ তুলে স্তূপ করা হয় ভ্যানে। সোমবার আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে চাঞ্চল্যকর এই ভিডিও দেখানোর সময় ছয়টি লাশের একটি দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এটাই আমার ছেলে।’ এরপর তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় আদালতে তখন সবার চোখে পানি, পিনপতন নীরবতা। নাজেজ জাকি আশুলিয়ায় পুলিশের গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী আস-সাবুরের বাবা। ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন আশুলিয়ায় যে ছয়টি লাশ পোড়ানো হয়েছিল, তার একটি ছিল সাবুরের।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন আশুলিয়ায় শহীদ আস-সাবুরের বাবাসহ তিনজন। আস-সাবুরের বাবা এনাব নাজেজ জাকি জবানবন্দিতে বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সহযোগীদের নির্দেশে তার ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যা করে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তাই ওরা যেভাবে আমার ছেলেকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, আমিও তাদের সেই শাস্তি দেখতে চাই।

এদিন এই মামলায় ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন যাত্রবাড়ী এলাকায় শহীদ ইমাম হাসান তায়িমের ভাই রবিউল আউয়াল ভুঁইয়া। তিনি বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশের গুলিতে গত বছরের ২০ জুলাই ইমাম হাসান তায়িম যাত্রাবাড়ীর কাজলা পদচারী-সেতুর কাছে মারা যান। ইমাম নারায়ণগঞ্জের সরকারি আদমজী নগর এমডব্লিউ কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। তাকে দফায় দফায় গুলি করে হত্যার পর বুট দিয়ে মুখের ওপর আঘাত করা হয়। এছাড়া রাজশাহীর আন্দোলনকারী সহযোদ্ধা জসিম উদ্দিন। তিনি সেখানে গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী আলী রায়হান ও শাকিব আনজুমের মামলায় সাক্ষ্য দেন। পরে তাকে জেরা করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। এ নিয়ে এ পর্যন্ত ১২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হলো। জবানবন্দিতে তিনজনই জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত গণহত্যার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনদের দায়ী করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান।

বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ সোমবার এ জবানবন্দি দেন তারা। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে বুধবার পর্যন্ত আদালতের কার্যক্রম মুলতুবি করেন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। আদালতে প্রসিকিউশনের পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, আব্দুস সোবহান তরফদার, বিএম সুলতান মাহমুদ, গাজী এমএইচ তামিম, আবদুস সাত্তার পালোয়ান ও ফারুক আহাম্মদ, মঈনুল করিম, সাইমুম রেজা তালুকদারসহ অন্য প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন।

এদিন বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকাল পৌনে ৫টা পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ চলে। তবে মাঝে কিছুক্ষণ বিরতি দেওয়া হয়। প্রসিকিউশন জানায়, ৮১ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫ দিনে ১২ জনের সাক্ষ্য নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। অন্য সাক্ষীদের মধ্যে রয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা ও জাতীয় দৈনিকের একজন সম্পাদক।

গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আন্দোলন দমনে ১৪০০ জন আন্দোলনকারীকে হত্যার নির্দেশ প্রদান, উসকানি, প্ররোচনাসহ ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ’-এর পাঁচ অভিযোগে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

শহীদ আস-সাবুরের বাবার জবানবন্দি : ট্রাইব্যুনালে ১০ নম্বর সাক্ষী হিসাবে জবানবন্দি দেন শহীদ আস-সাবুরের বাবা এনাব নাজেজ জাকি। তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আমার ছেলে আস-সাবুর আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় আন্দোলনে যায়। সেখানে পুলিশের প্রচণ্ড গুলাগুলির কারণে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে সে একটি বাসায় আশ্রয় নেয়। পরে আমরা তার আর কোনো খোঁজ পাইনি। বিকাল ৪টার দিকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরদিন বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অনেক খোঁজাখুঁজি করি। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমরান নামে একজন সমন্বয়ক আমার বড় ছেলেকে জানায়, আশুলিয়া থানার সামনে কয়েকটা পোড়ানো লাশ রয়েছে, সেখানে আপনার ভাইয়ের লাশ আছে কি না শনাক্ত করেন। এ খবর শুনে আমার বড় ছেলে রেজোয়ান কান্নায় ভেঙে পড়ে। আমার ভাগিনা হুমায়ন কবিরকে ঘটনাস্থলে পাঠাই। তার সঙ্গে আমার খালাতো ভাই মেহেদী হাসান ছিল। তারা আমার ছেলে আস-সাবুরকে তার টি-শার্টের পোড়া অংশ এবং মোবাইলের সিম দেখে তাকে শনাক্ত করে। লাশের সঙ্গে থাকা মোবাইল থেকে সিমটি বের করে অন্য একটি মোবাইলে সংযুক্ত করার পর দেখা যায় ওই সিমটি আমার ছেলে আস-সাবুরের। সেনাবাহিনী ও ছাত্ররা পোড়ানো ছয়টি লাশের জানাজা করে সন্ধ্যা ৬টার দিকে আমাদের কাছে হস্তান্তর করে। আমি আমার ছেলের দিকে একনজর তাকিয়েছি। কিন্তু তার চেহারা এমন বীভৎস ছিল, তাকে চেনার কোনো উপায় ছিল না। দ্বিতীয় জানাজা শেষে রাত সাড়ে ৮টার দিকে তার লাশ নিয়ে আমরা গ্রামের বাড়ি নওগাঁ জেলার মহাদেবপুরে নিয়ে যাই। পরের দিন ৭ আগস্ট সকাল ৯টায় তৃতীয় জানাজা শেষে তার লাশ দাফন করা হয়।’

এনাব নাজেজ জাকি বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এবং সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের উকসানিতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশে সে সময়কার আশুলিয়া থানার ওসি, এসআই, কনস্টেবল আমার ছেলেকে হত্যা করে। শুধু তাই নয়, আমার ছেলেসহ আরও পাঁচজনকে পুলিশ ভ্যানে তুলে পেট্রোল ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এ সংক্রান্ত দুটি ভিডিও ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শন করা হয়। একটিতে হত্যাকাণ্ডের পর লাশগুলো একটি রিকশাভ্যানে চ্যাঙদোলা করে তুলে স্তূপ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় ভিডিওতে একটি পুলিশ ভ্যানের ভেতরে লাশগুলোকে আগুন দিয়ে পোড়ানোর দৃশ্য রয়েছে। সেখানে একজন পুলিশ সদস্যকে আগুনের তীব্রতা বাড়ানোর জন্য কাঠের বেঞ্চ নিক্ষেপ করতে দেখা যায়। ভিডিও প্রদর্শনকালে সাক্ষী কান্নায় ভেঙে পড়েন। সাক্ষী ভিডিওতে রিকশা ভ্যানের ওপর পড়ে থাকাবস্থায় তার ছেলের মৃতদেহ শনাক্ত করেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার ও শাস্তি চাই। যেভাবে আসামিরা আমার ছেলেকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, আমি সে ধরনের শাস্তি চাই।

পুলিশ যেভাবে ইমাম হাসানকে হত্যা করে : ১১ নম্বর সাক্ষী হিসাবে জবানবন্দি দেন শহীদ ইমাম হাসান ভূঁইয়া তায়িমের বড় ভাই রবিউল আওয়াল ভূঁইয়া। তিনি বলেন, তার বাবা রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের জ্যেষ্ঠ উপ-পরিদর্শক মো. ময়নাল হোসেন ভূঁইয়া। ২০২৪ সালের ২০ জুলাই দুপুর ১২টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল ছিল। সেদিন ইমাম হাসান মাকে চা খাওয়ার কথা বলে বাইরে গিয়ে আন্দোলনে অংশ নেয়। যাত্রাবাড়ীর কাজলা পদচারী-সেতুর পাশে ইমাম হাসানকে গুলি করা হয়। যাত্রাবাড়ী থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক সাজ্জাদুজ্জামান প্রথমে ইমাম হাসানের পায়ে গুলি করেন। পরে এডিসি শামিম আরেকজনের হাত থেকে অস্ত্র নিয়ে তার শরীরের নিচের দিকে গুলি করেন। তারপর ওসি তদন্ত জাকির হোসেন অনেকবার গুলি করেন। ঘটনাস্থলে তখন যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী ও প্রলয়, ডিসি ইকবাল, এডিসি মাসুদুর রহমান মনির, এসি নাহিদ, এসি তানজিল, ওসি আবুল হাসান, ওসি অপারেশন ওয়াহিদুল হক মামুনসহ ১০-১৫ জন পুলিশ সদস্য ছিলেন। জবানবন্দিতে রবিউল আরও বলেন, ঘটনাস্থলে ইমাম হাসান আধাঘণ্টা পড়েছিল। পরে পুলিশ ভ্যানে তাকে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে নেওয়া হয়। সেখানে ভ্যান থেকে মাটিতে নামিয়ে পাঁচ-ছয়জন পুলিশ সদস্য বুটজুতা দিয়ে মাড়িয়ে তার চেহারা বিকৃত করে ফেলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন এডিসি শামীম, এডিসি মাসুদুর রহমান মনির ও এসি নাহিদ। পরে কেউ তাকে ভ্যানে করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। রাজশাহীর আন্দোলনকারী সহযোদ্ধা জসিম উদ্দিন তার জবানবন্দিতে বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দুপুরে রাজশাহী শহরে পুলিশের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অস্ত্রধারীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। এতে ছাত্রনেতা আলী রায়হান ও শাকিব আনজুম গুলিতে মারা যায়। এ সময় তিনি নিজেও আহত হন।

১০ জুলাই শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সোমবার সকালে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ। কয়েক দিন আগে তিনি দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেছিলেন। তিন আসামির মধ্যে একমাত্র তিনি কারাগারে আটক। বাকি দু’জনকে পলাতক দেখিয়ে এ মামলার কার্যক্রম চলছে।