Image description

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর ওপর উচ্চ শুল্ক চাপিয়েছেন ডনাল্ড ট্রাম্প। এতে উচ্চ শুল্ক আরোপের কারণে দেশীয় কারখানাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ ১০-১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া স্থগিত বা বাতিল হওয়া ক্রয়াদেশ ফিরতে শুরু করেছে। অন্যদিকে উচ্চ শুল্কের কারণে প্রতিবেশী ভারত এবং চীন থেকেও ক্রয়াদেশ স্থানান্তর বাংলাদেশে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দেশ দুটির ব্যবসায়ীরা। এতে বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনা বলছেন বিশ্লেষকরা।

তবে বাড়তি ক্রয়াদেশ ধরে রাখতে সরকারের সহযোগিতার পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ চান ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া উচ্চ শুল্ক থাকায় প্রতিযোগী দেশের তুলনায় আরও বেশি ক্রয়াদেশ পাওয়ার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এখনই পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ তাদের। সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে নানামুখী সংকটে এ সুযোগ হাতছাড়ার শঙ্কাও রয়েছে পোশাকশিল্প ব্যবসায়ীদের।

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের আরোপ করা পাল্টা শুল্ক কার্যকর হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের কারখানাগুলোয় তৈরি পোশাকের বাড়তি ক্রয়াদেশ দিতে দর কষাকষি করছে অনেক মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। ভারত ও চীনে উচ্চ শুল্কের কারণে সেখান থেকে ক্রয়াদেশ সরিয়ে আনতে চায় এসব ক্রেতা।
আমেরিকার শীর্ষ ১০ পোশাক রপ্তানিকারক ভিয়েতনাম, চীন, বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, হন্ডুরাস, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান ও কোরিয়া। এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিযোগী হচ্ছে ভিয়েতনাম, চীন, ভারত। ট্রাম্প প্রশাসনের উচ্চ শুল্কের জেরে এখন তুলনামূলক ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত দুই সপ্তাহে মার্কিন ক্রেতাদের কাছ থেকে আসতে শুরু করেছে বাড়তি ক্রয়াদেশ। এ ছাড়া, বাতিল হওয়া অর্ডারও ফিরছে এখন। তারা বলছেন, আগামী কয়েক মাসে ক্রয়াদেশ বাড়তে পারে ৮ থেকে ১০ শতাংশ। আর গ্রীষ্মে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, মার্কিন ক্রয়াদেশ ধরে রাখার কৌশল হিসেবে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এ ছাড়া চীনা বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপনে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বেশির ভাগ কারখানায় ক্রয়াদেশ আমাদের সক্ষমতার তুলনায় কম আছে। তবে, বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে, ক্রয়াদেশ বাড়বে। কোথাও কোথাও যেমন আমার কারখানায় টপআপ পরিমাণের অর্ডার দিয়েছিল কিন্তু আমি নিতে পারিনি। কারণ যে সময় দিয়েছিল সেই সময়ের মধ্যে আমার শিপমেন্ট করা সম্ভব হবে না। 
শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াতেও চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের, যা রপ্তানিকারকদের শঙ্কা কাটিয়ে আশা জাগাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। 

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, বাংলাদেশের অর্ডার একটু বেশি আসবে। কিন্তু ভারত যেসব টিশার্ট করে মেজরিটি হলো এমব্লিশমেন্ট, চিলড্রেন, ফ্যান্সি, লেডিস ব্লাউজ, লেডিস টপস যেগুলো বাংলাদেশে আমরা সেই অর্থে কন্টিনিউ করি না। তবে যে অর্ডারগুলো ক্রেতারা ধরে রেখেছিল সে অর্ডারগুলো এখন তারা ধীরে ধীরে প্লেস করছে। তো এটা নতুন কোনো ক্রয়াদেশ তা না কিন্তু। ভারত ও চীনে উচ্চ শুল্কের কারণে ক্রয়াদেশ সরিয়ে আনতে চায় এসব ক্রেতা। 
তবে, নতুন সুযোগের সঙ্গে যোগ হয়েছে চ্যালেঞ্জও। অর্থনীতিবিদদের মতে, বিদ্যুৎ-গ্যাসের সংকট, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি এবং বাণিজ্য প্রতিযোগিতা মোকাবিলা করতে হবে এ খাতকে।
আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, এখন পর্যন্ত আশা রাখতে পারি সরকার ইন্ডাস্ট্রিকে প্রায়োরিটি দিবে এবং গ্যাসের সরবরাহ ঠিক রাখবে। কিন্তু এক্সপানশনের ক্ষেত্রে যারা নতুন তারা কেউই কিন্তু কানেকশন পাচ্ছে না।’

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, লো ভেল্যু গার্মেন্টস সেগমেন্ট থেকে তারা এক্সিট করে যাচ্ছে। যেখানে ১ বা ২ শতাংশ দাম বৃদ্ধি পেলে ব্যবসার ক্ষতি হয় সেখান থেকে তারা কিন্তু সরে আসবে। এবং সরে আসার ক্ষেত্রে যে দেশগুলোতে তারা যেতে পারে তার সর্বাগ্রে আছে বাংলাদেশ।

মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলো প্রকট আকার ধারণ করেছে। সুতার সংকট আছে, গ্যাসের সংকট আছে। এর ফলে ডায়িং করে এই সময়ের মধ্যে অর্ডার আমি শেষ করে শিপমেন্ট করতে পারবো না বলেই এই বড় পরিমাণ কাজের অর্ডার নেই নাই। 
আমেরিকা রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ৮৬ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক। গত অর্থবছর রপ্তানি হয়েছে ৭৫৪ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক।
বিজিএমইএ’র সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ভোক্তারা যদি শুল্কের বিষয়টি ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারে, তাহলে ক্রয়াদেশ বাড়বে। যেসব মার্কিন ক্রেতা ভারতে কাজ করে, তবে বাংলাদেশে করে না, সেসব ক্রেতার ক্রয়াদেশ নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। 

স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এস এম খালেদ বলেন, আমাদের কারখানায় গত বছর একটি মার্কিন ক্রেতার জ্যাকেটের কাজ হয়েছে ৭ লাইনে। তারা বাড়তি যে ক্রয়াদেশ দিতে চাচ্ছে, তাতে মোট ১৭ লাইন লাগবে। তিনি বলেন, বাড়তি ক্রয়াদেশের কাজ করতে আমাদের আড়াই লাখ ডলার বিনিয়োগ লাগবে। আমাদের প্রত্যাশা, সবকিছু অনুকূলে থাকলে চলতি অর্থবছরে আমাদের রপ্তানি ৩৫ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
এদিকে চীনা কোম্পানি হান্ডা (বাংলাদেশ) গার্মেন্টস কোম্পানি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপনের জন্য প্রায় চার কোটি ডলারের বিনিয়োগ করবে। এ জন্য ৩০শে জুলাই বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) সঙ্গে জমির ইজারা চুক্তি করেছে হান্ডা। এ ছাড়া চীনের তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠান খাইশি গ্রুপ চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করবে।

প্রতিষ্ঠানটি চার কোটি মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করে অন্তর্বাসসহ অন্যান্য পোশাক উৎপাদনের কারখানা করবে। এ জন্য গত বুধবার বেপজার সঙ্গে চুক্তি করেছে খাইশি গ্রুপ।
উল্লেখ্য, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প গত ৩১শে জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভিয়েতনামের মতো বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে পাল্টা শুল্ক সংশোধন করে ২০ শতাংশ করেন। তার বিপরীতে চীনা পণ্যে এখন শুল্ক ৩০ শতাংশ। তবে ভারতের পণ্যে শুল্কের হার ২৫ শতাংশ, যা প্রতিযোগী দেশের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। শুধু তাই নয়, রাশিয়ার জ্বালানি কেনার ‘অপরাধে’ ভারতের পণ্যে আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। ২৭শে আগস্ট ভারতের বাড়তি ২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হবে। যদিও সব দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক ৭ই আগস্ট থেকে কার্যকর হয়েছে।