Image description

কলকাতার হগ মার্কেট। সবার কাছে পরিচিত নিউমার্কেট হিসেবে। গত সপ্তাহে এই নিউমার্কেটের আইকনিক ক্লক টাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম চারদিকের পরিস্থিতি। গত বছরের ৫ই আগস্ট বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্কে যে শীতলতা এসেছে তা সর্বগ্রাসী হয়েছে। বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক, এমনকি মানুষে মানুষে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তার বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আর তাই এক সময় নিউমার্কেট, মারকুইস স্ট্রিট, সদর স্ট্রিট-যেখানে বাংলাদেশি মানুষের ভিড়ে গমগম করতো তা এক রকম উধাও। এখানকার দোকান বা মলে, এমনকি রেস্টুরেন্টগুলো যেভাবে ভিড়ে ঠাসা থাকতো এখন তা চোখে পড়ে না। 

সারাদিন নিউমার্কেট ও সংলগ্ন এলাকা ঘুরেও সেই পুরনো জমজমাট ভিড়ের ছবিটি পাইনি। আগে যেখানে প্রতি একশ’ জনের মধ্যে ৬০-৭০ জন বাংলাদেশির দেখা পাওয়া যেতো, এবার সেখানে হাতেগোনা কয়েকজন বাংলাদেশির দেখা পেলাম। এরা কেউই পর্যটক নন। মেডিকেল ভিসায় চিকিৎসা করাতে এসেছেন। এরই ফাঁকে নিউমার্কেটে সামান্য কেনাকাটা করছেন। আগের মতো বিশাল বিশাল সুটকেস বা পেটি ভর্তি করার মতো কেউ বাজার করছেন না। 

ঢাকার বাসিন্দা আসিফ হোসেনের সঙ্গে দেখা হতেই জানালেন, তিনি মায়ের ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য ভারতে এসেছেন। বলেন, ‘চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এই নিয়ে পরপর তিনবার এলাম। কিন্তু এবার দেখছি বাংলাদেশিদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। মেডিকেল ভিসার সংখ্যা বাড়ায় কলকাতায় বাংলাদেশির সংখ্যা বেড়েছে।’

মারকুইস স্ট্রিটের এক নামকরা পরিবহন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথায় উঠে এসেছে নিউমার্কেট অঞ্চলের হতাশার ছবিটি। জানালেন, বাংলাদেশে পরিবর্তনের পর থেকে ভারত সরকার পর্যটক ভিসা প্রদান বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে যে হাজার হাজার বাংলাদেশি প্রতিদিন কলকাতায় আসতেন তা এখন বন্ধ। আগে থেকে যারা মেডিকেল ভিসা নিয়ে রেখেছিলেন, তারাই শুধু আসছিলেন। মেডিকেল ভিসার ক্ষেত্রে ভারত সরকার নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার ফলে বাংলাদেশিদের আসা এক রকম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অতি সম্প্রতি মেডিকেল ভিসার ক্ষেত্রে উদার মনোভাব নেয়ায় আবার বাংলাদেশিদের কলকাতায় আসা বাড়ছে বলে তিনি জানান। 

নিউমার্কেটের একটি শাড়ির দোকানের কর্মী শ্যামল দত্ত জানালেন, গত এক বছর ভীষণ খারাপ অবস্থায় কাটিয়েছি। আগে যেখানে বাংলাদেশি ক্রেতার সংখ্যা নিয়ে আমরা খুশি ছিলাম, সেখানে গত এক বছরে ৫০ জন বাংলাদেশি ক্রেতা পাইনি। 
তিনি বলেন, ‘শুধু আমরাই নই, নিউমার্কেট সংলগ্ন সব ব্যবসায়ীরা প্রচণ্ড আর্থিক কষ্টে কাটিয়েছেন। সবচেয়ে করুণ অবস্থা ফুটপাথের ব্যবসায়ীদের।’

নিউমার্কেটের উল্টোদিকের ফুটপাথে জাঙ্ক জুয়েলারির ব্যবসা করেন শেখ জামির। তিনি জানালেন, বাংলাদেশি ক্রেতাই ছিল আমাদের বড় ভরসা। কিন্তু গত এক বছরে তারা কেউ না আসায় বিক্রিবাট্টা ৭০ শতাংশ কমে গেছে। অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন।’ 
নিউমার্কেট অঞ্চলের শ্রী লেদার্স, খাদিমের মতো জুতার বিপণিগুলোতে এখন স্থানীয় মানুষের ভিড় ছাড়া বাংলাদেশিদের ভিড় নেই। আগে দোকানের ভেতরে ভিড়ের জন্য প্রবেশ করা যেতো না। কিন্তু এখন একরকম ফাঁকা।
শ্রী লেদার্সের এক কর্মী জানান, বাংলাদেশিরা আমাদের এই অঞ্চলের দোকানগুলোর বড় ক্রেতা ছিলেন। কিন্তু গত এক বছরে তাদের অনুপস্থিতি আমাদেরও আর্থিক সংকটে ফেলেছে। এখন অবশ্য কিছু বাংলাদেশির দেখা পাওয়া যাচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের অভিমত, গত এক বছরে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নিউমার্কেট অঞ্চলের আর্থিক পরিস্থিতি। মূলত বাংলাদেশি পর্যটকদের ওপর ভিত্তি করে এই অঞ্চলের অবকাঠামো তৈরি হয়েছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশি পর্যটকের অভাবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, মুদ্রা বিনিময়ের কারবারিরা।
কস্তুরি, ধানসিঁড়ি, প্রিন্স-এর মতো রেস্টুরেন্টগুলোতে ঢুঁ দিয়ে দেখা গেল আগের মতো বসার জায়গার অভাব নেই। বাংলাদেশিদেরও দেখা নেই। কর্তৃপক্ষ জানালেন, বাংলাদেশিদের লক্ষ্য রেখেই আমরা আমাদের খাবারের পদ তৈরি করতাম। কিন্তু এখন  রান্নার পরিমাণ অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছি। স্থানীয়দের ভরসায় চলছি।  

পরিবহন ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এখন পেট্রাপোল থেকে প্রতিদিন কয়েকশ’ যাত্রী আসছেন। কলকাতা থেকেও অনেকে বাংলাদেশে যাচ্ছেন। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা আবার বাড়ছে। আরএনটেগোর হাসপাতাল সূত্রে খবর, তাদের হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা কিছুদিন আগের থেকে ৩০ শতাংশ বেড়েছে। একই মত, টাটা ক্যান্সার, মেডিকা, পিয়ারলেসের মতো হাসপাতালগুলোর।
চিকিৎসা নিতে আসা শামিমা ও তার পরিবার জানালেন, শহর কলকাতা আগের মতোই নিরাপদ আছে। তবে বিভিন্ন সামাজিকমাধ্যম এমন রটনা করছে, তাতে কিছুটা শঙ্কিত ছিলাম। কিন্তু এসে দেখতে পাচ্ছি সবকিছু আগের মতোই আছে।

তবে মেডিকেল ভিসায় যে পরিমাণে বাংলাদেশি সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আসছেন, তার একটি বড় অংশ আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য দক্ষিণ বা উত্তর ভারতমুখী হচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশিরা আগের তুলনায় বেশি আসছেন ঠিকই, আর তাতে পরিবহন সংস্থা এবং কলকাতা সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালগুলো নতুন করে লাভের মুখ দেখলেও সেভাবে খুশি নন নিউমার্কেট, সদর স্ট্রিট, মারকুইস স্ট্রিটের মানি এক্সচেঞ্জ, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট এবং ফুটপাথের ব্যবসায়ীরা। তাদের অভিমত, যতদিন পর্যটক ভিসা স্বাভাবিক না হবে, ততদিন নিউমার্কেটও স্বাভাবিক হবে না।