
তীব্র বিতর্কের মুখে সিলেট ছাড়ছেন বিদায়ী ডিসি মুহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ। তাকে নিয়ে জল্পনার অন্ত নেই সিলেটে। কেন তিনি রক্ষা করতে পারেননি সাদাপাথর?- এ প্রশ্ন সর্বত্র। তার আমলেই সিলেটে বালু ও পাথর লুটে রেকর্ড হয়েছে। চোখের সামনে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নিয়েছে খেকোরা। নির্বিচারে পরিবেশ ধ্বংস করা হয়েছে। এ নিয়ে জনগণের মধ্যে হা-হুতাশ দেখা দিলেও কার্যত প্রশাসন ছিল নির্বিকার। আর সব কিছুর জন্য দায়ী করা হচ্ছে মাহবুব মুরাদকে। তার আমলে সিলেটের বালু ও পাথর যেভাবে লুট হয়েছে অতীতে কখনোই তা হয়নি। এজন্য শুধু প্রত্যাহারই নয়, তদন্তের মাধ্যমে ডিসি মুরাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি উঠেছে। এক বছর আগে ক্রান্তিকালে সিলেটের জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন মুহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ। যোগদান করেই তিনি বালু ও পাথর লুটে কড়াকড়ি দেখিয়েছিলেন। আর এই কড়াকড়ির কারণেই তার হাতের মুঠোয় চলে আসে সব সিন্ডিকেট। একে একে সবাই এসে ধরা দেন তার হাতের মুঠোয়।
জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন- ডিসি সিলেটে যোগদান করেই বালুমহালগুলো ইজারা দেয়া শুরু করেন। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তিনি বালু ও পাথরখেকোদের সঙ্গে আঁতাত করেই ইজারা দেন। কমপক্ষে ৫-৬টি বালুমহাল তিনি ইজারা দেন। শেষ পর্যায়ে তিনি ইজারা দেন কোম্পানীগঞ্জের বালুমহাল। এই মহালটি গত বছরও দেয়া হয়েছিল। প্রায় ১০ কোটি টাকার বিনিময়ে দেয়া এই বালুমহাল ইজারা নিয়ে স্থানীয় ভাবে আপত্তি ছিল। এ নিয়ে একাধিকবার স্থানীয়দের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে মৌখিক ও লিখিত ভাবে আপত্তি জানানো হয়। এই আপত্তি ডিসি মুরাদ অগ্রাহ্য করেন। সর্বশেষ কোম্পানীগঞ্জের বালুমহালের ইজারার অংশ থেকে কালাসাদেক মৌজা বাদ দিতে অনুরোধ জানানো হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- কালাসাদেক মৌজার অবস্থান হচ্ছে সাদাপাথরের মুখ পর্যন্ত। ফলে কোয়ারি এলাকায় লুটপাট বন্ধ করতে হলে কালাসাদেক মৌজা ইজারার বাইরে রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু জেলা প্রশাসন থেকে যে লিজ দেয়া হয়েছে সেখানে কালাসাদেক মৌজাকে বাদ দেয়া হয়নি। ফলে শেষ মুহূর্তে যা হওয়ার তাই হয়েছে।
গতকাল ভোলাগঞ্জ, গুচ্ছগ্রাম, কালাইরাগ, কালীবাড়ি সহ কয়েকটি এলাকার লোকজন জানিয়েছেন- ইজারার ভেতরে কালাসাদেক মৌজা থাকার কারণে বালুখেকোরা সাদাপাথর এলাকা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। ইজারা থাকায় সাদাপাথরের গা ঘেঁষেই তারা বৈধভাবেই বালু উত্তোলন করে। জুলাই মাসের শেষদিকে টানা বৃষ্টিতে যখন ঢল নামে তখন সাদাপাথরে পানি বেড়ে যায়। বৃষ্টি থাকায় পর্যটকরাও কম যান। আর এই সুযোগে বালুর সঙ্গে পাথর লুট শুরু করে। টানা দুই সপ্তাহের লুটে শূন্য করা হয় সাদাপাথরকে। মিডিয়ায় আসায় লুটপাট নিয়ে দেশ জুড়ে তোলপাড় শুরু হলেও তখন জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ নীরব থাকেন। হৈচৈ শুরু হওয়ার পর অ্যাকশনে নামে প্রশাসন। আর পাথর লুটের ঘটনার জন্য সরাসরি দায়ী করা হচ্ছে সিলেটের প্রশাসনকে।
তবে জেলা প্রশাসক মাহবুব মুরাদ পাথর লুটের ঘটনায় নিজের ব্যর্থতার দায় নিতেও রাজি হননি। পাথর লুটের কয়েক দিন পর তিনি যখন সাদাপাথর পরিদর্শনে যান তখন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। সেখানে তিনি জানিয়েছেন- প্রশাসন ব্যর্থ নয়। লুট বন্ধে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল সেগুলো কার্যকর হয়নি। এতে প্রশাসনের ভুল ছিল না বলে তিনি মন্তব্য করেন। শুধু সাদাপাথরই নয়, পাশেই রেলওয়ের সংরক্ষিত সম্পত্তি ‘বাঙ্কার’। স্বাধীনতার পর থেকে বাঙ্কার এলাকা নিরাপদ ছিল। কিন্তু এবার আর নিরাপদ থাকেনি বাঙ্কার। ওখান থেকে শতকোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। স্থাপনা ভাঙচুর করার কারণে রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ওই এলাকায় নির্ধারিত বাসস্থানে বসবাস করতে পারেননি। তারা দূরবর্তী একটি স্কুলে অবস্থান করেন। আর এই সুযোগে পাথরখেকোরা গোটা বাঙ্কার এলাকা লুট করেছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন- বাঙ্কার ছাড়াও কোয়ারি এলাকার কালাইরাগ, কালীবাড়ি, কলাবাড়ি সহ কয়েকটি এলাকায় রীতিমতো পাথর হরিলুট চলেছে। এসব পাথর লুট বন্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর ভূমিকা রাখা হয়নি। লোকবলের দোহাই দিয়ে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন গা ভাসিয়ে দিয়েছিল স্রোতের তালে। আর ইউএনও আজিজুন্নেছারও ছিল রহস্যময় নীরবতা। ফলে কোম্পানীগঞ্জের শারপিনটিলা, সাদাপাথর সহ কয়েকটি এলাকায় লুট ঠেকানো সম্ভব হয়নি। গত দুই মাস ধরে আলোচনায় ছিল সিলেটের গোয়াইনঘাটের রয়্যালিটি ঘাট। জৈন্তাপুরের সারি-১ বালুমহালের ইজারাদার কামরুল ইসলামের পক্ষে ঘাট বসিয়েছিল গোয়াইনঘাটের আলোচিত বালুখেকো স্ট্যালিং তারিয়াং, জাহিদ খান, জিয়ারত খান সহ কয়েকজন। গোয়াইনঘাট সদরে ঘাট বসানোর কারণে বর্ষায় মৌসুম পুরোটাই জাফলংয়ে অবাধে লুটপাট চালিয়েছে বালুখেকোরা। এ নিয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসককে একাধিক অভিযোগ দেয়া হলেও কোনো কাজ হয়নি। উল্টো লেঙ্গুরা গ্রামের প্রতিবাদকে পুঁজি করে বালুখেকোদের পক্ষ নিয়ে প্রশাসন সাধারণ মানুষকে নির্যাতন করে।
‘টাঙ্গাইল সিন্ডিকেট’ গোয়াইনঘাটের একটি আলোচিত সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে ডিসি মাহবুব মুরাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠে। বালুখেকো জাহিদ খান ও জিয়ারত খানের সঙ্গে ডিসি’র সরাসরি যোগাযোগ ছিল। তাদের দাপট এতটাই বেশি ছিল জাফলংয়ে সফরকালে দুই উপদেষ্টার গাড়িবহর জাহিদ খানের নেতৃত্বে পথরোধ সহ নানা ঘটনা ঘটানো হয়। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বালুখেকোরা একের পর এক মামলা দিয়ে বিপর্যস্ত করে গোয়াইনঘাট বিএনপি’র ত্রাণ বিষয়ক সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন তালুকদারকে। রিয়াজ জানান, বালু লুটপাটের প্রতিবাদ করার কারণেই ওসি তোফায়েল ও বিট অফিসার এসআই উৎসবের ইন্ধনে একের পর এক তাকে মামলার আসামি করা হয়। গোয়াইনঘাট সদরে ইজারাঘাট বসানোর বিষয়ে সারি-১ এর ইজারাদার কামরুল ইসলাম মাসখানেক আগে মানবজমিনকে জানিয়েছিলেন- প্রশাসনের মৌখিক অনুমতির প্রেক্ষিতে তারা জৈন্তাপুরের পরিবর্তে গোয়াইনঘাটে ইজারাঘাট বসিয়েছেন। তবে জাফলং লুটের ঘটনা তিনি অস্বীকার করেন। এদিকে- গতকাল জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদকে প্রত্যাহারের ঘটনায় স্বস্তি ফিরেছে সিলেটে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কীম জানিয়েছেন- বালু ও পাথর লুট বন্ধে অযোগ্য ও অদক্ষতা দেখিয়েছেন বিদায়ী জেলা প্রশাসক। প্রাকৃতিক সম্পদের তিনি যে ক্ষতি করে গেছেন এর জন্য তার বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত। দৃশ্যমান কিছু না হলে পাথরখেকোরা পিছু হটবে না বলে জানান তিনি। বেলা’র সিলেটের সমন্বয়ক এডভোকেট শাহ সাহেদা আক্তার জানিয়েছেন- বালু ও পাথর লুটে জেলা প্রশাসকের অঘোষিত বা অলিখিত সমর্থন ছিল। এজন্যই বালু ও পাথর লুটের ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন- আইনিভাবে কী করা যায় সেটি আমরা চিন্তাভাবনা করছি। তবে বর্তমানে প্রশাসন থেকে কাগজপত্র দিয়ে সহযোগিতা করা হয় না বলে অভিযোগ করেন তিনি। সুজন সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন- জেলা প্রশাসক সহ যারা ব্যর্থ হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। যদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তাহলে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের অপরাধ করতে সাহস পাবে না।
সিলেটের ডিসি পদে নিয়োগ পেলেন সারওয়ার আলম: সিলেটের নতুন জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন প্রশাসনের আলোচিত কর্মকর্তা মো. সারওয়ার আলম। উপ-সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা সারওয়ার আলম বর্তমানে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। গতকাল তাকে সিলেটের ডিসি নিয়োগ দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সারওয়ার আলম র্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আলোচিত ছিলেন।