
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও পিআর পদ্ধতি। চলমান রাজনৈতিক বিতর্কের প্রধান দুই ইস্যু। এই ইস্যুতে দু’টি ধারায় বিভক্ত রাজনৈতিক দলগুলো। এক ধারার নেতৃত্বে আছে বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোট। আরেক ধারায় জামায়াত এনসিপিসহ আরও কয়েকটি দল। তবে এই বিরোধের নেপথ্যে দর কষাকষি না অন্য কিছু- এ নিয়ে শুরু হয়েছে নানা গুঞ্জন। অনেকে বলছেন, নির্বাচন নিয়ে বিরোধিতার পেছনে বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল হলেও আদতে আগামী দিনের সরকারে এনসিপি, জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলোর অংশগ্রহণের বিষয়টিও আলোচনা আছে। তাদের মতে, মূলত এনসিপি ও জামায়াত চাইছে- বিএনপি’র ওপর চাপ সৃষ্টি করে ভোটের মাঠে আকাক্সিক্ষত সুযোগ তৈরি করে নেয়া। ওদিকে দেশে যাতে নতুন কোনো সংকট তৈরি না হয় সেদিকে গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। এজন্য জুলাই সনদে বড় ধরনের ছাড় দেয়ার মানসিকতা দেখিয়েছে বিএনপিসহ এসব দল। এই সনদ চূড়ান্ত করা ও এতে স্বাক্ষরের বিষয়েও নমনীয় অবস্থানে আছে এই দলগুলো। এসব দলের নেতারা মনে করছেন কিছু বিষয়ে যে বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে তা রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য। সতর্কতার সঙ্গে এই বিষয়গুলো সমাধান করার পক্ষে দলগুলো। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও এমন পরিস্থিতিতে দলগুলোকে আলোচনায় বসার পরামর্শ দিচ্ছেন। একইসঙ্গে অহেতুক বিতর্ক না করার পরামর্শ দিয়েছেন।
চলমান রাজনৈতিক বিরোধকে দেশের জন্য ক্ষতিকর উল্লেখ করে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, এতে তৃতীয় পক্ষ লাভবান হতে পারে। দেশে অচলবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। এজন্য রাজনৈতিক পক্ষ সমূহকে এখনই সাবধান হওয়া উচিত। তিনি বলেন, সব দলেরই নিজস্ব কৌশল থাকতে পারে। মতপার্থক্যও থাকবে। তাই বলে নির্বাচনের পথে বাধা সৃষ্টি করা গণতান্ত্রিকসুলভ আচরণ নয়। এই মুহূর্তে সবাইকে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সমীচীন বলে মনে করেন তিনি। এদিকে জুলাই সনদ নিয়ে দলীয় সুবিধা নেয়ার গুঞ্জনকে জোরালোভাবে নাকচ করেছেন জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীল নেতারা। তারা বলছেন, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রয়োজন। যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে আদৌ সম্ভব নয়। কারণ হিসেবে তারা বলেন, ১৩ই জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর দেশে নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনের ভারসাম্য একদিকে হেলে পড়েছে। যার প্রভাব পড়বে আসন্ন নির্বাচনের মাঠে। তাই হেলে পড়া প্রশাসনে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। এজন্য নির্বাচনের মাঠ ঢেলে সাজাতে হবে।
ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীল একজন নেতা বলেন, যে যাই বলুক বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা বিএনপি’রই বেশি। এতে আমাদের তেমন অসুবিধারও কোনো কারণ নেই। কিন্তু সেই নির্বাচনটা হতে হবে অবাধ ও নিরপেক্ষ। এই অবাধ ও নিরপেক্ষতার গ্যারান্টিই পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আমরা চাই ক্ষমতার ভারসাম্য।
দলটির মহাসচিব মাওলানা ইউনূস আহমাদ বলেন, স্বাধীনতার ৫৪ বছরের প্রায় প্রতিনিধি নির্বাচনে ভোট ডাকাতি ও জালিয়াতি হয়েছে। এ কারণে রাষ্ট্র পরিচালনায় জনমতের প্রতিফলন হয়নি। জুলাই অভ্যুত্থানের পর প্রত্যাশা ছিল অতীতের মতো নির্বাচন হবে না। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে দলগুলো একমত না হওয়া আমাদের হতাশ করেছে।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, পৃথিবীর ৯১ দেশে পিআর পদ্ধতি চালু আছে। যদিও পিআরের ছয়টি সিস্টেম আছে। আমরা বলেছি- বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং জনমানুষের আর্থ-সামাজিকের উপযোগী করে যে পদ্ধতিটা এপ্লিকেবল সে পদ্ধতি এখানে চালু করতে হবে। তিনি বলেন, পিআর পদ্ধতিতে তিন থেকে চারটি লাভ। এই সিস্টেমে ব্যক্তি নয়, দলের পক্ষে ভোট চাওয়া হয়। ফলে ব্যক্তির স্বার্থের চেয়ে দলের স্বার্থটা বড় হয়ে দাঁড়ায়। তখন ভোট নেয়ার ব্যাপারে কালো টাকা, পেশিশক্তি, মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ হয়। কোনো দল টোটাল কাস্টিং ভোটের এক পারসেন্টও যদি পায় তাহলে তিনশ-এর মধ্যে এক পারসেন্ট মানে তারা ৩টি আসন বা ৩টি সিট পাবে। কোনো দল যদি ত্রিশ পারসেন্ট ভোট পায় তাহলে ওই দল ৯০টা সিট পাবে। এভাবে দলগুলোর মধ্যে সিট ভাগ করা হবে। অংশগ্রহণকারী দলগুলো নির্বাচনের আগে তিনশত জনের একটি তালিকা নির্বাচন কমিশনে জমা দিবে। কোনো দল ৩০টি সিট পেলে এই তালিকার প্রথম ৩০ জনকে এমপি হিসেবে ঘোষণা করা হবে। তাহলে এখানে ব্যক্তি স্বার্থ থাকলো না, দলের স্বার্থ হয়ে গেল।
তিনি বলেন, বর্তমান সিস্টেমে যে যাকে ভোট দিয়েছে সে বিজয়ী না হলে ভোটার বলে যে, তার ভোট পচে গেছে। পিআর পদ্ধতিতে হলে ভোট আর পচবে না। প্রতিটি ভোট মূল্যায়িত হবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের অংশীদার নিশ্চিত হয়। জামায়াত সেক্রেটারি বলেন, যদি বিএনপি অনড় হতে পারে; আমরাও তো অনড়। আমাদের পিআর দিতে হবে। অনেকে বলে পিআর না দিলে কী করবেন। যখন দিবে না তখন সেটার বিষয়ে কথা বলবো। তিনি বলেন, কেয়ারটেকারও আমাদের দাবি একসময় মানতে চায়নি। অনেকে বলেছেন, না, এটা হয় না। কেউ কী নিরপেক্ষ হয়? কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেয়ারটেকারও মানতে বাধ্য হয়েছে।
জামায়াত পিআর নিয়ে এমন অবস্থান নিলেও আদতে তারা এতে অনড় অবস্থানে নেই একটি সূত্র জানিয়েছে। সূত্রের দাবি এ ইস্যুতে আলোচনার মাধ্যমে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান চায় দলটি। সংসদের উচ্চ কক্ষে পিআর পদ্ধতি হলেও দলটি ছাড় দিতে রাজি হতে পারে।
অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারাও পিআর এবং জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির ওপর জোর দিচ্ছেন। দলটির সূত্র জানিয়েছে, দলটি এখনো নিবন্ধন পায়নি। এছাড়া সারা দেশে তাদের সাংগঠনিক কাঠামোও জোরালো হয়নি। এ অবস্থায় আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনে অংশ নেয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন নেতারা। সূত্রের দাবি, জুলাই সনদসহ নির্বাচন ইস্যুতে দলটি সময় ক্ষেপণের কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। যদিও নেতারা বলছেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হলে নির্ধারিত সময়ে তাদের নির্বাচনে অংশ নিতে কোনো সমস্যা নেই।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকির ভাষ্য, বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন দেশ ও দেশের জনগণের প্রধান জাতীয় স্বার্থ। এটাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন যেকোনো তৎপরতাই জাতীয় স্বার্থের বিরোধিতা। এ রকম অবস্থান নেয়া ঠিক হবে না। কেউ অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চাইলে সেটাকে তো ফ্যাসিবাদের ইশারা বলে মনে করা হবে।