
ব্যাংক খাতের ‘মাফিয়া সিন্ডিকেট’ এস আলম গ্রুপ ও নজরুল ইসলাম মজুমদারের হাতে লুট হওয়া পাঁচ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে ব্যাংকগুলোর সম্মতি নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একীভূতকরণে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতির জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। সম্মতি পেলেই চলতি সপ্তাহে ব্যাংক একীভূতকরণের ঘোষণা আসতে পারে। একই সঙ্গে নতুন ব্যাংকটির নাম নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা। এরই মধ্যে আলোচনায় আছে ইউনাইটেড ইসলামী বা আল ফাতাহ—এই দুটি নাম। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কাছেও চাওয়া হবে প্রস্তাব। আগামী অক্টোবরের মধ্যে ঠিক হতে পারে ব্যাংকটির নাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক সূত্র বিষয়গুলো নিশ্চিত করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর গত সোমবার এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আগামী সপ্তাহ থেকেই একীভূতকরণের কাজ শুরু হবে। তবে বাস্তবে কার্যক্রম শুরু হতে অবশ্য আরও কিছু সময় লাগতে পারে। যদিও চলতি সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ের সম্মতি পেলেই ব্যাংকগুলো সরকার অধিগ্রহণের বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে। এরপর আগামী সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে একীভূতকরণের ঘোষণা এবং অক্টোবরের মধ্যে নতুন ব্যাংক হিসেবে কার্যক্রম শুরু হতে পারে। তবে একীভূতকরণ সম্পন্ন করতে কমপক্ষে ১ বছর সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
খরচ আসবে যেভাবে: কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, সদ্য প্রণীত ব্যাংক অধ্যাদেশ ২০২৫-এর অধীনে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে প্রথমে সরকার অধিগ্রহণ করবে। এরপর একীভূতকরণের কার্যক্রম শুরু হবে। এসব ব্যাংক একীভূত করতে ৩০-৩৫ হাজার কোটি টাকা লাগতে পারে। সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেটে এর খরচ হিসেবে ১৩ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ রেখেছে। একই সঙ্গে ব্যাংক একীভূতকরণে বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের সহায়তার প্রতিশ্রুতি রয়েছে, যা বাংলাদেশি টাকায় সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার মতো। সব মিলিয়ে চলতি বছরের মধ্যেই একীভূতকরণের ফ্রেমওয়ার্ক ঠিক হয়ে যাবে বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, লুট হওয়া ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণের বিকল্প নেই। এ বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সরকারকে অবহিত করা হয়েছে। সরকারও এ বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত। এখন এই প্রক্রিয়া পরিচালনার খরচ সামাল দিতে যেই পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, তার সংস্থাপন হলেই কার্যক্রম দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে। আমরা আশা করছি, চলতি বছরের মধ্যেই ফ্রেমওয়ার্ক নির্দিষ্ট করা যাবে। ঠিক থাকলে আগামী ৩-৪ বছরের মধ্যে এই পাঁচ ব্যাংক মিলে একটি শক্তিশালী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হবে। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন বলেও জানান এই ব্যাংকার।
নাম নিয়ে যত আলোচনা: বেসরকারি খাতের ৫ শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংক মিলে গঠিত হবে একটি নতুন ব্যাংক। নতুন নামে ও নতুন আঙ্গিকে গড়ে ওঠা ব্যাংকটির নাম নিয়ে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা। এরই মধ্যে দুটি নামের বিষয়ে বেশ আলোচনা শোনা যাচ্ছে। যার মধ্যে একটি হচ্ছে ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক ও অন্যটি আল ফাতাহ (বিজয়ী বা জয় করা) ইসলামী ব্যাংক। যদিও এখনো কোনো নাম চূড়ান্ত করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।
মালিকানায় থাকবে যারা: বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, একীভূতকরণের পর একটি নতুন নামের শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটি প্রাথমিকভাবে সরকারি মালিকানায় চলবে। পরে ধাপে ধাপে বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা হবে। সে ক্ষেত্রে প্রথমে বিদেশি ও বেসরকারি খাতে ভালো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী খোঁজা হবে। না পাওয়া গেলে শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে সরকার ধীরে ধীরে মালিকানা হস্তান্তর করবে।
নতুন কার্যালয়: ৫টি ব্যাংক সরকারি মালিকানায় নেওয়ার পর একীভূতকরণের কার্যক্রম শুরু হবে। এ ক্ষেত্রে নতুন ব্যাংকের জন্য আলাদা কার্যালয় করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে মতিঝিলের সেনাকল্যাণ ভবন কার্যালয় নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
গড়ে তোলা হবে এসএমই ব্যাংক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র বলছে, ৫ বেসরকারি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক একীভূত করে একটি বৃহৎ এসএমই ব্যাংক গড়ে তোলা হবে। এই ব্যাংকটি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা গড়ে তুলতে কাজ করবে। বৃহৎ বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে দেশের প্রান্তিক অর্থনীতিকে গতিশীল করতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে ক্ষেত্রে অঞ্চলভিত্তিক ভাগ করে বিনিয়োগেরও চিন্তা করা হচ্ছে। অর্থাৎ সেই অঞ্চলের আমানত সেই অঞ্চলেই বিনিয়োগের বিষয়ে নীতিমালা তৈরি করা হবে।
আমানতকারীদের সুরক্ষা: কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ৫ ইসলামী ব্যাংকের শতভাগ আমানতকারীকে সুরক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের শতভাগ অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে বৃহৎ আমানতকারীদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমানতের বিপরীতে তাদের দেওয়া হতে পারে ব্যাংকের শেয়ার। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, একীভূত প্রক্রিয়ায় কোনো কর্মীর চাকরি যাবে না। আমানতকারীদেরও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই; তাদের সব টাকা ফেরত দেওয়া হবে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান কালবেলাকে বলেন, এই মুহূর্তে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার কোনো বিকল্প নেই। সঠিকভাবে পরিচালিত করতে পারলে এটি বড় সুযোগ তৈরি করতে পারে।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন কালবেলাকে বলেন, আশার দিক হচ্ছে এরই মধ্যে ব্যাংকগুলো ফরেনসিক অডিট হয়ে গেছে। এখন কার্যক্রম শুরু হলে কত সময় লাগবে, তা বোঝা যাবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ব্যাংক একীভূত করার ক্ষেত্রে প্রথমে ব্যাংকগুলোকে সরকার অধিগ্রহণ করবে। এরপর ব্যাংকগুলোর ঘাটতি মূলধনে সরকার বিনিয়োগ করবে। এরপর ব্যাংক একীভূতকরণের কার্যক্রম শুরু হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একীভূতকরণের উদাহরণ থাকলেও বাংলাদেশেরটা ব্যতিক্রম। কারণ বিশ্বের কোথাও এ ধরনের লুটপাট হওয়ার প্রেক্ষাপটে ব্যাংক একীভূত করতে হয়নি। এখন বাংলাদেশ নতুন হিসেবে সেই অভিজ্ঞতার দিকে হাঁটছে। সে ক্ষেত্রে এটি কতটা কার্যকর হবে, তার জন্য সময় নিতে হবে। তবে সরকার আমানতকারী ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের সুরক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি ভালো দিক। তবে যোগ্যতার ভিত্তিকে ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদায়নের বিষয়টি নজর রাখতে বলেন তিনি।