
দেশে এই প্রথম উপজেলা হিসেবে সাভারকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা করেছে সরকার। বাতাসে দূষণের মাত্রা প্রতিবছর প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম থাকলে সেই বাতাস মানুষ সহজে গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু সাভারের বাতাসে এই মান প্রায় ২০ গুণ বেশি। এ ছাড়া সাভারের বাতাসে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১৬০ দিনের বেশি মাত্রাতিরিক্ত দূষণ থাকে।
জানা গেছে, ১৭ আগস্ট রবিবার রাতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. কামরুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক পরিপত্রের মাধ্যমে এ ঘোষণা জারি করা হয়।
পাশাপাশি উন্মুক্ত অবস্থায় কঠিন বর্জ্য পোড়ানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের বর্তমান মানদণ্ড অনুসারে পরিবেষ্টক বাতাস বা আশপাশের বাতাসের মান হতে হবে প্রতিবছর প্রতি ঘনমিটারে ৩৫ মাইক্রোগ্রাম। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সর্বশেষ মানদণ্ড অনুসারে এটি থাকতে হবে ৫।
প্রতিদিনের জন্য পরিবেষ্টক বাতাস বা আশপাশের বাতাসের মান আবার ভিন্ন। প্রতিদিন প্রতি ঘনমিটারে ৬৫ মাইক্রোগ্রাম থাকতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশে ২০২৩ সালে ১৬৪ দিন এই মান থেকে বেশি এসেছে। এ ছাড়া ২০২৪ সালে ১৬০ দিনের বেশি পাওয়া গেছে।
বায়ুদূষণের অন্যতম উপাদান কালো ধোঁয়া। রাজধানীর বাতাসে প্রতি মিটারে ৬-৮ মাইক্রোগ্রাম কালো ব্ল্যাক কার্বন বা কালো ধোঁয়া বিরাজমান। উন্নত বিশ্বের উন্নত শহরে যেখানে প্রতি মিটারে মাত্র ০.৫-০.৮ শতাংশ। ফলে রাজধানীর বাতাসে প্রায় ৭-১১ গুণ বেশি কালো ধোঁয়া রয়েছে। কালো ধোঁয়া নির্গমণে সবচেয়ে বেশি দায়ী ইটভাটা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুর নানা মাত্রায় দূষণের কারণে জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। কালো ধোঁয়া দেশের পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কালো ধোঁয়া নাকের মাধ্যমে রক্তে মিশে যাচ্ছে, ফলে রক্ত দূষিত ও বিভিন্ন রোগের কারণ হচ্ছে। কালো ধোঁয়ায় আক্রান্ত হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। আবার মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিচেনায় নিয়েই সাভার এলাকাকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা করা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারক মালিক সমিতি একমত পোষণ করেছে। দেশের মানদণ্ড অনুসারে সাভারের বায়ুমান তিনগুণ খারাপ। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে এটি ২০ গুণ খারাপ। এ ঘোষণার মাধ্যমে সাভার ও ঢাকা উভয় অঞ্চলের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পরিবর্তন আসবে এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত হবে।
কিভাবে সাভার ও ধামরাইয়ের বায়ু রাজধানীবাসীকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুষ্ক মৌসুমে প্রায় পাঁচ মাস উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে বায়ু প্রবাহিত হওয়ায় সাভার উপজেলায় সৃষ্ট বায়ুদূষণ ঢাকা শহরে প্রবেশ করে। এতে রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে বায়ুদূষণের তীব্রতা অনেক বেড়ে যায়। রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ওপর তা ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে।
জানা গেছে, বৈশ্বিক বিভিন্ন মানদণ্ড অনুসারে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশগুলোর মধ্যে প্রথমে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশে গড় দূষণ ১০০ পিএম ২.৫ পর্যন্ত ওঠানামা করে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দূষিত দেশের স্থান ধরে রেখেছে। বাংলাদেশে দূষণের পরিমাণের আশপাশে নেই অন্য দেশগুলো। যার তথ্য উঠে এসেছে বৈশ্বিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘আইকিউ এয়ার’। এখানে বিশ্বের প্রায় ১০০টি বড় শহরের বায়ুদূষণ নিয়ে লাইভ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে রাজধানী ঢাকার বাতাসের মান সূচক ৩০০-৪০০-এর মধ্যে ওঠানামা করে। বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষ শহরের তালিকায় টানা অবস্থান থাকে বাংলাদেশের।
একিউআই মান ০-৫০ এর মধ্যে থাকলে সেই বাতাসকে ভালো বলা হয়। ২০১-৩০০ থাকলে তাকে খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১-৫০০ পর্যন্ত বায়ুর মানকে বিপজ্জনক বলা হয়। এই মাত্রার বায়ু বিরজমান থাকলে সেখানে রেড এলার্ট জারি করা হয়।
এ বিষয়ে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজধানীর বায়দূষণের জন্য সাভার ছাড়াও গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ অঞ্চল দায়ী রয়েছে। পরিপত্রের দেওয়া বাধ্যবাধকতা সব এলাকার জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু সেটি মানা হচ্ছে না কিংবা বাস্তবায়নের ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু প্রাথমিকভাবে সাভার এলাকাকে পাইলট হিসেবে নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়াই সাধুবাদ জানাচ্ছি।