
রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকার শব্দের মানমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেশি। গত সেপ্টেম্বরে ওই এলাকাকে নীরব ঘোষণা করে সরকার। এ ঘোষণা কার্যকর হওয়ার পর অক্টোবরে শব্দদূষণ সামান্য কমেছিল। তবে চলতি বছর আবার তা বেড়ে গেছে।
গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের ১.৫ কিলোমিটার উত্তর থেকে ১.৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পর্যন্ত মোট তিন কিলোমিটার এলাকাকে নীরব এলাকা ঘোষণা করে, যা গত বছরের ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়।
এর আগে রাজধানীতে সচিবালয় এলাকা, গণভবন, বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো), বিজয় সরণি, আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবনের সামনের এলাকা, সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ সড়ক, বেগম রোকেয়া সরণি, শহীদ শাহাবুদ্দিন সড়ক ও বীর-উত্তম খালেদ মোশাররফ এভিনিউকে নীরব এলাকা ঘোষণা করে সরকার।
২০০৬ সালের শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালায় বিভিন্ন এলাকাকে নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প শ্রেণিতে ভাগ করে এসব এলাকায় শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বিধিমালায় হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত বা একই জাতীয় অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এবং এর চারপাশের ১০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাকে ‘নীরব এলাকা’ বলা হয়েছে। এসব এলাকায় যানবাহন চলাচলের সময় হর্ন বাজানো নিষেধ।
বিধিমালা অনুযায়ী, নীরব এলাকায় শব্দের মানমাত্রা দিনে (ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা) ৫০ ডেসিবেল ও রাতে (রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা) ৪০ ডেসিবেল।
বিমানবন্দর এলাকা নিয়ে ক্যাপস মোট চার পর্বে গবেষণা করে। পুরো গবেষণায় বিমানবন্দর সংলগ্ন চারটি স্থান থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এগুলো হলো বিমানবন্দরের মূল প্রবেশপথ, অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল প্রবেশপথ, স্কলাস্টিকা স্কুল ও লা মেরিডিয়ান হোটেলের সামনের অংশ।
বিমানবন্দরসংলগ্ন এলাকাকে নীরব এলাকা হিসেবে কার্যকর হওয়ার আগের পাঁচ দিন অর্থাৎ গত বছরের ২৬ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর এবং কার্যকরের দিন থেকে পরের পাঁচ দিন অর্থাৎ, ১ থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত দুই দফায় এই এলাকার শব্দদূষণের উপাত্ত সংগ্রহ করে ক্যাপস। তৃতীয় পর্বে গত বছরের ২৮ নভেম্বর ও ২ থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত আরো পাঁচ দিনের উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। সর্বশেষ চতুর্থ পর্বে নীরব এলাকা কার্যকর করার ৯ মাস পর চলতি বছরের ২২ থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত পাঁচ দিনের উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়।
ক্যাপসের গবেষণায় দেখা গেছে, নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার পরও বিমানবন্দরের আশপাশে শব্দের মাত্রা অনুমোদিত সীমার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। নীরব এলাকা কার্যকরের আগের পাঁচ দিনে বিমানবন্দর এলাকায় গড় শব্দমাত্রা ছিল ৮৭.৮১ ডেসিবেল। নীরব এলাকা কার্যকরের দিন থেকে পরের পাঁচ দিনে অর্থাৎ অক্টোবরের শুরুতে এখানে শব্দদূষণ ১.৩৩ ডেসিবেল কমে যায়। তবে দুই মাস পর পরিচালিত জরিপের তৃতীয় পর্বে দেখা যায়, অক্টোবরের পাঁচ দিনের চেয়ে শব্দদূষণ বেড়ে গেছে ০.৮১ ডেসিবেল। সর্বশেষ চলতি বছরের জুন মাসে পরিচালিত জরিপে গড় শব্দমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৮৯.২৩ ডেসিবেল, যা গত নভেম্বর-ডিসেম্বরের তুলনায় ১.৯৩ ডেসিবেল ও সেপ্টেম্বরের তুলনায় ১.৪২ ডেসিবেল বেশি।
সর্বশেষ চতুর্থ পর্বের পাঁচ দিনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিমানবন্দরসংলগ্ন চারটি স্থানে তৃতীয় এবং পঞ্চম দিনে শব্দের মাত্রা ৯০ ডেসিবেলের বেশি ছিল এবং অন্য দিনগুলোতেও ৯০ ডেসিবেলের কাছাকাছি ছিল। অর্থাৎ ৯ মাস পরও শব্দের মাত্রা ধারাবাহিকভাবে বেশি ছিল।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিমানবন্দরের মূল প্রবেশপথ ও লা মেরিডিয়ান হোটেলের সামনের অংশে শব্দদূষণ গত সেপ্টেম্বরের তুলনায় চলতি জুন মাসে সামান্য কমেছে। তবে বেড়ে গেছে অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল প্রবেশপথ ও স্কলাস্টিকা স্কুলের সামনের অংশে।
নীরব এলাকা হিসেবে কার্যকর হওয়ার আগে গত বছরের ২৬ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দরের মূল প্রবেশপথে শব্দের গড় মাত্রা ছিল ৮৯.১৯ ডেসিবেল। চলতি বছরের জুনে এখানে গড় শব্দমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৮৮ ডেসিবেল। অর্থাৎ ৯ মাসে বিমানবন্দরের মূল প্রবেশপথে শব্দ কমেছে ১.১৯ ডেসিবেল। অন্যদিকে গত সেপ্টেম্বরে লা মেরিডিয়ান হোটেলের সামনের অংশ ৯২.০৩ ডেসিবেল শব্দ রেকর্ড করা হলেও চলতি বছরের জুনে এখানে গড় শব্দমাত্রা ছিল ৮৯.৬০ ডেসিবেল। অর্থাৎ ৯ মাসে এখানে শব্দদূষণ কমেছে ২.৪৩ ডেসিবেল।
তবে বিস্ময়করভাবে শব্দদূষণ বেড়ে গেছে অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল প্রবেশপথ অংশে। গত সেপ্টেম্বরে এখানে ৮৩.৭১ ডেসিবেল শব্দ রেকর্ড করা হলেও চলতি বছরের জুনে গড় শব্দমাত্রা গিয়ে ঠেকেছে ৯০.১৭ ডেসিবেলে। অর্থাৎ ৯ মাসে অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল প্রবেশপথে শব্দদূষণ বেড়েছে ৬.৪৬ ডেসিবেল। ৯ মাসে স্কলাস্টিকা স্কুলের সামনেও শব্দদূষণ বেড়েছে ৩.৪৬ ডেসিবেল।
গবেষণা সম্পর্কে ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আবারও প্রমাণিত হলো, যথাযথ পরিকল্পনা ছাড়া যদি কোনো এলাকাকে নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তা বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। নীরব এলাকা হিসেবে কার্যকরের জন্য জনসম্পৃক্ততা ও প্রচার-প্রচারণা দরকার, যাতে মানুষ তা জানতে পারে। নীরব এলাকার একটা উদাহরণ বা দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হবে সরকারকে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে নীরব এলাকা কেমন হয় এবং মানুষ তখন এই বার্তাও পাবে যে নীরব এলাকা কার্যকর ও বাস্তবায়নে সরকার কাজ করছে। এতে মানুষ সচেতন হবে ও অংশগ্রহণ বাড়বে।’