
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে কুমিল্লাজুড়ে ভোটের জন্য মাঠে চলছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণাসহ অন্যান্য তৎপরতার যুদ্ধ। দিনরাতে, ঘরে-বাইরে নানা কৌশলে আগাম প্রচারণায় নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। চায়ের দোকানে বসলেই চলছে ভোটের আলোচনা। পথে চলতে চলতে চোখে পড়ছে মনোনয়নপ্রত্যাশীর আগাম প্রতিশ্রুতির বাণী।
পর্যবেক্ষক মহল বলছে, অতীতে এই জেলা বিএনপির ‘দুর্গ’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। তবে গত পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্গ দখল করা হয়। এবার দুর্গ উদ্ধারের জন্য ভোটের কঠিন লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি।
কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি ও তিতাস) : এ আসনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের পক্ষে প্রচারণা চলছে। তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ। শেষ পর্যন্ত দলের এই জ্যেষ্ঠ নেতা নির্বাচনে অংশ না নিলেও তাঁর ছেলে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য আইনজীবী ড. খন্দকার মারুফ হোসেন চাইতে পারেন মনোনয়ন। বাবার অবর্তমানে তিনি দাউদকান্দি ও তিতাসে ভোটের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। এবার নতুন আসন বিন্যাসের খসড়ায় দাউকান্দিকে মেঘনার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এখানে জামায়াতের প্রার্থী কুমিল্লা উত্তর জেলা জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য ও দাউদকান্দি উপজেলা জামায়াতের আমির মনিরুজ্জামান বাহলুল। তিনিও প্রচারযুদ্ধে আছেন। এখানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম।
কুমিল্লা-২ (হোমনা ও মেঘনা) : এ আসনটি ১৯৯১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিএনপির দখলে ছিল। এখানে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকায় আছেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক (কুমিল্লা বিভাগ) অধ্যক্ষ মো. সেলিম ভূঁইয়া। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাবেক এপিএস-২ আবদুল মতিন ও হোমনা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান মোল্লা। বর্তমান সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিকও প্রার্থী হতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। তবে তিতাস উপজেলাকে হোমনার সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাবের পর এ আসনে আবারও আলোচনায় আছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি কুমিল্লা-১ ও ২ আসন থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন। এখানে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য নাজিম উদ্দিন মোল্লা। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মাওলানা বশির আহমাদ ও গণ অধিকার পরিষদের প্রার্থী নাজমুল হাসান।
কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) : এ আসনে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদের পক্ষে অনুসারীদের প্রচারণা চলছে। অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও এনসিপির প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে প্রচার রয়েছে। এ আসন থেকে বিএনপির শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ অতীতে পাঁচবার এমপি হয়েছিলেন। কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর দেশে ফিরে মুরাদনগরের সাধারণ মানুষের চোখে-মুখে যে ভালোবাসা দেখেছি এবং তাদের অনুরোধেই মূলত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব। তবে এখনো আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। এ আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী কুমিল্লা উত্তর জেলার কর্মপরিষদ সদস্য ও মুরাদনগর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ইউসুফ হাকিম সোহেল।’
কুমিল্লা-৪ (দেবীদ্বার) : এ আসনে অতীতে বিএনপি থেকে টানা চারবার এমপি হয়েছিলেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মঞ্জুরুল আহসান মুন্সি। আগামী নির্বাচনে তিনি দল থেকে মনোনয়ন পাবেন বলে আশা করছেন তাঁর অনুসারীরা। তবে বর্ষীয়ান এই নেতা অসুস্থ থাকলে তাঁর ছেলে কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রিজভীউল আহসান মুন্সি দল থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন।
বিএনপি থেকে প্রার্থী হতে চান কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব এ এফ এম তারেক মুন্সি ও রাজধানীর গুলশান থানা বিএনপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবদুল আউয়াল খান।
এখানে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহও দল থেকে নির্বাচনী যুদ্ধে অংশ নিতে চান বলে প্রচার রয়েছে। তাঁর সমর্থকরা এলাকায় এ জন্য ব্যানার-ফেস্টুন লাগিয়েছে। হাসনাত আবদুল্লাহও এলাকায় নিয়মিত সভা-সমাবেশ ও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন।
এখানে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী কুমিল্লা উত্তর জেলার সেক্রেটারি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম শহীদ। এখানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মোহাম্মদ আব্দুল করিম। কমিউনিস্ট পার্টি থেকে প্রার্থী হতে পারেন পরেশ কর।
কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া) : এখানে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকায় রয়েছেন বুড়িচং উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ টি এম মিজানুর রহমান, ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মো. জসিম উদ্দিন, প্রধান উপদেষ্টা ড মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন। এখানে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. মোবারক হোসেন।
কুমিল্লা-৬ (সদর) : কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা, সিটি করপোরেশন ও সেনানিবাস এলাকা নিয়ে গঠিত এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন চান দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য হাজি আমিন উর রশিদ ইয়াছিন। এ ছাড়া প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নেতা ও কুমিল্লা সিটি কপোরেশনের সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু। বিএনপির বিভাগীয় কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়া ও কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সদস্য কাউসার জামান বাপ্পিও মনোনয়ন আশা করছেন বলে জানা গেছে। এখানে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী দলের মহানগর আমির কাজী দ্বীন মোহাম্মদ। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী এম এম বিলাল হুসাইন, গণ অধিকার পরিষদের প্রার্থী রাশেদুল হক রিয়াদ।
কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) : এখানে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ প্রার্থী হতে চান। বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন আতিকুল আলম শাওন, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান জাহিন, জাতীয়তাবাদী ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী শাখাওয়াত হোসেনসহ আরো কয়েকজন। এখানে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী উপজেলা জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা মোশাররফ হোসেন।
কুমিল্লা-৮ (বরুড়া) : এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেতে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির কর্মসংস্থানবিষয়ক সম্পাদক ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার আহ্বায়ক জাকারিয়া তাহের (সুমন)। এখানে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী অধ্যক্ষ শফিকুল আলম হেলাল। এখানে গণ অধিকার পরিষদের প্রার্থী দলের জেলা শাখার সভাপতি ফয়েজ উল্লাহকে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন।
কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) : বিএনপির হয়ে ভোটের মাঠে লড়তে প্রস্তুতি নিচ্ছেন দলের কেন্দ্রীয় শিল্প বিষয়ক সম্পাদক ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবুল কালাম। এখানে জামায়াত ইসলামীর প্রার্থী দলের কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ও লাকসাম উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ড. সারোয়ার উদ্দিন সিদ্দিকী। আসনটি পুনর্বিন্যাস করে লাকসাম-লালমাই উপজেলাকে নতুন আসন হিসেবে প্রস্তাব করেছে। আর সাবেক কুমিল্লা-৯ আসনের মনোহরগঞ্জ উপজেলাকে কুমিল্লা-১০ আসন নাঙ্গলকোটের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে।
কুমিল্লা-১০ (সদর দক্ষিণ, লালমাই ও নাঙ্গলকোট) : এখানে এবার বিএনপির মনোনয়ন চান দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরী, সাবেক এমপি আবদুল গফুর ভূঁইয়া এবং মোবাশ্বের আলম ভুঁইয়া। নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট খসড়া তালিকায় কুমিল্লা সদর দক্ষিণকে কুমিল্লা-১১-এর (চৌদ্দগ্রাম) সঙ্গে এবং লালমাই উপজেলাকে কুমিল্লা-৯ (লাকসাম)-এর সঙ্গে এবং নাঙ্গলকোট উপজেলার সঙ্গে মনোহরগঞ্জ উপজেলাকে যুক্ত করার প্রস্তাব করেছে। এখানে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ইয়াছিন আরাফাত।
কুমিল্লা-১১ (চৌদ্দগ্রাম) : এখানে বিএনপির মনোনয়ন পেতে চান উপজেলা বিএনপির সভাপতি কামরুল হুদা, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য গোলাম কাদের চৌধুরী নোবেল, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি কাজী নাসিমুল হক। জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা হওয়া সত্ত্বেও প্রতি সপ্তাহে এলাকায় আসছেন তিনি। মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন, কর্মীদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। এলাকাভিত্তিক তালিকা করে ছোট-বড় সভা-সমাবেশ করে ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করছেন বর্ষীয়ান এই নেতা। আসনটি পুনরুদ্ধারে সক্রিয়ভাবে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন জামায়াতের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা।