Image description

দেশে রেকর্ড উৎপাদন, মজুত এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতন- সব মিলিয়ে চালের দাম কমার কথা। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টো। দাম বাড়ছে লাগামছাড়া হারে। চালের বাজার প্রায় পুরোপুরি করপোরেট কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় এটি ঘটছে। বাজার বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, অস্বাভাবিক এ পরিস্থিতি শুধু ভোক্তাকে নয়, শেষ সময়ে এসে সরকারকেও বড় ধরনের সংকটে ফেলতে পারে।

 

এ অবস্থায় ভোক্তারা একপ্রকার অসহায়। কারণ শুধু বাজার নয়, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এখন উৎপাদনব্যবস্থার ওপরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। মাঠপর্যায়ের মিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বড় কোম্পানিগুলো পরিকল্পিতভাবে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে চালের দাম বাড়িয়ে চলেছে। এতে একদিকে যেমন ভোক্তা ঠকছে, অন্যদিকে সরকারও হারাচ্ছে বাজার নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা।

বর্তমানে দেশে চালের উৎপাদন ও সরকারি মজুত- দুইই রেকর্ড পর্যায়ে। সরকারি তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ১৭ নভেম্বর চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর থেকে ২০২৫ সালের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত চাল আমদানি করা হয় ১০ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৯ টন। এছাড়া বোরো মৌসুমেও ফলন ভালো হয়েছে। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে ক্রমাগত এ খাদ্যশস্যের দাম কমতির দিকে। এরপরও দেশের বাজারে অনেক দিন ধরেই চালের দাম বাড়তি। জুলাই মাসেও বাজারে চালের দাম কেজিতে ৫-৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এমনকি চালের ভরা মৌসুমেও বাজারে কয়েক দফা দাম বেড়েছে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, করপোরেট কোম্পানিগুলো কেজিপ্রতি চালের দাম মাত্র এক টাকা বাড়ালেই দিনে ১০ কোটির বেশি অতিরিক্ত লাভ তুলতে পারে। বাস্তবে তারা কেজিতে ২০ টাকা পর্যন্ত বেশি নিচ্ছে। দেশের ভোগ্যপণ্যের প্রায় সব খাতই করপোরেটদের কবজায় চলে যাচ্ছে। শুধু চাল নয়; ডাল, মসলা, আটা- সবকিছুই তারা নিয়ন্ত্রণ করছে।

এসএম নাজের হোসাইন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, করপোরেট কোম্পানিগুলো এখন কৃষকদের কাছ থেকে বড় আকারে জমি লিজ নিয়ে নিজেরাই ধান আবাদ শুরু করেছে। এতে উৎপাদন বাড়লেও ভবিষ্যতে তারা পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়াও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারে। জমি, গুদাম ও বাজার- সবই চলে গেলে বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ কার্যত শূন্য হয়ে যাবে।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের এ নীরবতা রহস্যজনক। অনেকেই বলছেন, বাণিজ্য উপদেষ্টার নিজস্ব করপোরেট চাল ব্যবসা থাকায় ভোক্তার স্বার্থরক্ষায় তিনি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেননি।

চাল ব্যবসায়ীদের পর্যবেক্ষণ

রাজধানীর বাবুবাজারের চাল ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন বলেন, চালের বাজার এখন আর চাতাল মালিকদের হাতে নেই। করপোরেট হাউসগুলোই সব নিয়ন্ত্রণ করছে।

এ ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, ঈদের আগ মুহূর্তে করপোরেট কোম্পানিগুলো অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দেয়। ঈদের পর আবার বাজারে বস্তাপ্রতি ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা দাম বাড়িয়ে চাল সরবরাহ করে। এটি স্পষ্ট ‘কৃত্রিম সংকট’।

নয়াবাজার ও কারওয়ান বাজারে দেখা গেছে, বিভিন্ন করপোরেট কোম্পানির ব্র্যান্ড মিনিকেট চাল ৮০-৮৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। অথচ একই চাল বিআর-২৮ বা বিআর-২৯ ধান থেকে পলিশ করে তৈরি, যেটি প্রকৃত মিনিকেট নয়। এটি প্রতারণা হলেও সরকার নীরব।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর একবার মিনিকেট ও জিরাশাইল চালের বাজারজাতকরণ বন্ধে নির্দেশ দিলেও পরে তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাতিল করে।

মূল্যস্ফীতির চাকা উল্টা ঘুরছে

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, সরু চালের দাম এক বছরে কেজিতে সাত টাকা, মাঝারি চাল ১৭ টাকা এবং মোটা চাল পাঁচ টাকা বেড়েছে। এর প্রভাবে জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশে এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশে।

বাংলাদেশের খাদ্যতালিকায় চালের আধিপত্য এতটাই বেশি যে, চালের দাম বাড়লেই সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। ফলে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ না করলে সামগ্রিক অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

করপোরেটদের অবস্থান

চালের দাম বৃদ্ধির পেছনে করপোরেট কোম্পানিগুলোর দায় অস্বীকার করে নাবিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলাম স্বপন বলেন, দেশে এখনো আমরা চাল উৎপাদনে পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। সরকার সময়মতো আমদানির অনুমতি না দেওয়ায় বাজারে ঘাটতি তৈরি হয়।

তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, নতুন করে আমদানি করা চাল বাজারে এলে দাম কমে আসবে।

তবে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু আমদানি নয়, করপোরেট হাউসগুলো নিয়ন্ত্রণেও সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। অন্যথায় বাজার ও ভোক্তা- দুই করপোরেটদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়বে।