
ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে নেওয়া ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ প্রকল্পের যাত্রা একযুগের বেশি সময় আগের হলেও এখনো বাস্তবায়নে গতি আসেনি। গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্প বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। নির্ধারিত স্টপেজ, মার্কিং, কাউন্টার প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রকল্পটি বাধার মুখে পড়েছে নানা কারণে। পরিকল্পনার ঘাটতি, রাজনৈতিক প্রভাব, মালিক ও শ্রমিকদের অনীহা এবং প্রশাসনিক সমন্বয়ের অভাবে কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসেনি।
২০১৬ সালে প্রথম চিন্তা করা হয় ঢাকার বাসগুলোকে একটি নির্দিষ্ট কম্পানির আওতায় আনার। ২০১৮ সালে কমিটি করা হয়, আর ২০২১ সালে চালু হয় ঢাকা নগর পরিবহন।
২০০৪ সালে ঢাকার জন্য করা ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনায় ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ বা বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি চালুর পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) তৎকালীন মেয়র আনিসুল হক তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিলেন।
ডিটিসিএ বলেছে, বাস রুট রেশনালাইজেশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ৯টি ক্লাস্টার (৯টি ভিন্ন ভিন্ন রঙের), ২২টি কম্পানি ও ৪২টি রুটের প্রস্তাব দিয়েছিল ডিটিসিএ। এর মাঝে আরবান ক্লাস্টার (নগর পরিবহন) ছয়টি (রুট ৩৪টি) ও সাব-আরবান (শহরতলি পরিবহন) ক্লাস্টার তিনটি (রুট আটটি)। এই প্রস্তাব ২০২০ সালের ১২ আগস্ট কমিটির ১৪তম সভায় অনুমোদিত হয়। ২৩তম সভার সিদ্ধান্তে ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনটি রুটে বাস চালু করলেও তা এখন বন্ধ।
পরিকল্পনা আছে, বাস্তবায়ন নেই : বারবার পরীক্ষামূলকভাবে বাস নামানো হলেও কাঙ্ক্ষিত সফলতা মেলেনি। গুলিস্তান-নারায়ণগঞ্জ রুটে সীমিত আকারে কিছু বাস চলাচল করছে বটে, তবে রাজধানীর অন্যান্য রুটে এ প্রকল্প কার্যত থমকে আছে। এই সার্ভিসটিই গত বছর চালু করা হয়েছিল গাবতলী থেকে নারায়ণঞ্জ পর্যন্ত। কিন্তু সফলতার দেখা না মেলায় সেটির রুট ছোট করে আনা হয়। পরিকল্পনার ঘাটতি, বাস্তবায়নে সমন্বয়ের অভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং পরিবহন মালিকদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব—সব মিলিয়ে এ প্রকল্প আজও পরীক্ষা-নিরীক্ষার গণ্ডি পেরোতে পারেনি।
বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের পরিচালক ধ্রুব আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটা সার্ভিস গুলিস্তান-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলছে। আরো কিছু চালুর চেষ্টা করছি। নানা দিক থেকে নানা ধরনের উদ্যোগ চলছে। আমরা বলেছি, সমন্বয় দরকার।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সুপারিশ করি, আরটিসি অনুমোদন দেয়। তবে ডিটিসিএর পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে কোনো রুট পারমিট দেওয়া যাবে না, এটা ২০২২ সালের সড়ক পরিবহন বিধিমালায় পরিষ্কারভাবে বলা আছে।’
জানা যায়, ডিটিসিএ (ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ) রুট পরিকল্পনা দিলেও রোড পারমিট দেয় আরটিসি (ঢাকা মেট্রোপলিটন রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি)। ফলে দুই সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব প্রকল্পকে বারবার বাধাগ্রস্ত করছে।
গোলাপি বাস ছিল, নেই, আবার আসবে : সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সহায়তায় ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির চালু করা গোলাপি বাস সার্ভিস কয়েক মাস চলার পর হঠাৎ করেই হারিয়ে গেছে। সমিতির দপ্তর সম্পাদক কাজী জুবায়ের মাসুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কিছু দাবি আদায়ে ধর্মঘটসহ নানা ব্যস্ততায় গোলাপি বাস কার্যক্রম পিছিয়ে যায়। এখন আবার কাজ শুরু করব।’
তবে বাধা কেবল ধর্মঘট নয়। তিনি বলেন, ‘স্টপেজ, মার্কিং, যাত্রী ছাউনি—এসব এখনো তৈরি হয়নি। সিটি করপোরেশন জায়গা নির্ধারণ করে না দিলে আমরা কাউন্টার বসাতে পারি না। আবার কাউন্টার বসালেও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়।’
বাসরুট রেশনালাইজেশন অথবা গোলাপি বাস সার্ভিসের মূলকথা হচ্ছে কাউন্টারভিত্তিক বাস চলাচল। কিন্তু মালিকরা বলছেন, এটি বাস্তবায়নে অতিরিক্ত খরচের চাপ পড়বে। প্রতিটি কম্পানির গড়ে ১০-১২ লাখ টাকা বাড়তি খরচ হবে কাউন্টার পরিচালনায়। জানা গেছে, শ্রমিকরাও এই পদ্ধতিতে খুশি নন। অনেক মালিক যাঁরা আগে চালক ছিলেন, তাঁরাও অসহযোগিতা করছেন।
রাস্তায় শৃঙ্খলা নেই, পরিবেশও নেই : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় এখনো গণপরিবহন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। সরু সড়ক, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দাপট, অতিরিক্ত মোটরসাইকেলসহ সব মিলিয়ে গণপরিবহন ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্প ভালোভাবেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ গোলাপি বাস নামানোর মতো ঘটনায় প্রকল্পটি বাধাগ্রস্ত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এখন প্রকল্প আর এগোচ্ছে না। কম্পানি না পাওয়ার দায় সরকারেরও আছে। মালিকদের বোঝাতে হবে তাঁদের লাভ কোথায়। আর এক রুটে একাধিক কম্পানি চললে নতুন কেউ ইনভেস্ট করবে না। কারণ প্রতিযোগিতায় তারা টিকবে না।’