Image description
জুলাই জাতীয় সনদ

দফায় দফায় আলোচনার পর অবশেষে জুলাই জাতীয় সনদের সমন্বিত চূড়ান্ত খসড়া গত শনিবার রাজনৈতিক দল ও গণমাধ্যমে পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। দলগুলোর মতামত নিয়ে আগামী সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে জুলাই সনদ ঘোষণার প্রত্যাশা করছে কমিশন। একই সঙ্গে সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদেরও মতামত নিচ্ছে কমিশন। আইনজীবী-বিচারপতিদের নিয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ প্যানেল জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে যেসব পরামর্শ দেবেন, সেগুলো পরবর্তী সংলাপে রাজনৈতিক দলের কাছে তুলে ধরা হবে। তবে জুলাই সনদ নিয়ে নানা আলোচনা থাকলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপির অবস্থান- আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গঠিত হলে নির্বাচিত সংসদই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে। তবে ঠিক বিপরীত অবস্থানে আছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল। এসব দল গণভোট-গণপরিষদ নির্বাচন কিংবা অধ্যাদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে অনড়। পাশাপাশি সনদ বাস্তবায়ন ও কার্যকরের ব্যাপারে এ নিয়ে দলগুলো পর্যালোচনা করছে। সনদে দলগুলোর মতের বাইরে কোনো বিষয় লেখা হয়েছে কি না, এসব পর্যবেক্ষণ করছেন রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্ট নেতারা। অর্থাৎ সনদ নিয়ে দলগুলোর মতভেদ থাকলেও এ বিষয়ে একটি সমাধানের প্রত্যাশা করছে কমিশন। সবমিলিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে কমিশন। দলগুলো ইশারা দিলেই সনদ ঘোষণার বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে ঐকমত্য কমিশন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

প্রসঙ্গত, গত শনিবার রাতে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বহুল আলোচিত ও প্রত্যাশিত জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫-এর সমন্বিত চূড়ান্ত খসড়া দলগুলোকে দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। মূলত সংস্কার কমিশনের বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাবের ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দুপর্বের ধারাবাহিক আলোচনায় ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। সনদে বাস্তবায়নের আটটি অঙ্গীকারনামা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার স্পষ্ট বর্ণনা উল্লেখ নেই। উল্লেখ্য যে, ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক মাস বাড়ানো হয়েছে। সনদ চূড়ান্তকরণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলতি মাসেই আবারও বৈঠক করার কথা রয়েছে।

ঐকমত্য কমিশন বলছে, সনদে এমন অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলো কোনো কোনো দল একমত হননি। সেসব বিষয়ে দলগুলো নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছেন। ওই সব বিষয়ও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমতের বিষয়গুলোও উল্লেখ করা হয়েছে জুলাই সনদের খসড়ায়।

প্রথম পর্বের আলোচনায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন, জেলা সমন্বয় কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক দলকে তথ্য অধিকার আইনের আওতায় আনা, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা, আইনজীবীদের আচরণবিধি, গণহত্যা ও ভোট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন, তথ্য অধিকার আইনের সংশোধন, দুর্নীতিবিরোধী কৌশলপত্র প্রণয়নসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা রয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় ২০টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে ১১টি বিষয়ে ভিন্নমতসহ ঐকমত্য হয়। আর ৯টি বিষয়ে ভিন্নমতসহ সিদ্ধান্ত হয়।

ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, এই জুলাই জাতীয় সনদ একটি রাজনৈতিক ডকুমেন্ট। যেটি সব ঐকমত্যের ভিত্তিতেই তৈরি করা। আগামী সংসদের আগে কী প্রক্রিয়ায় আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করা যাবে, সেটাই মূল প্রশ্ন। জুলাই সনদের আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হলে সেটা নির্বাচনের আগে থেকেই বহাল হবে নাকি পরে বহাল হবে, সেটি নিয়েও বলবেন রাজনীতিবিদরা। আমরা শুধু বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রস্তাবনা তাদের কাছে তুলে ধরব।

বিএনপি বলছে অসামঞ্জস্য আছে

জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় কিছু বিষয়ে বিএনপি অসামঞ্জস্য দেখছে বলে জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, এ বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে শিগগির মতামত জানানো হবে। গতকাল রোববার গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, গত শনিবার সন্ধ্যায় আমরা সনদের খসড়া হাতে পেয়েছি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই মতামত জানাব। আপাতত মনে হচ্ছে কিছু বিষয়ে অসামঞ্জস্যতা আছে এবং কিছু বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালবেলাকে বলেন, জুলাই সনদে ঐক্যের স্বার্থে বিএনপি ছাড় দিয়েছে এবং সহযোগিতা করেছে। এখন বাস্তবায়ন করা সরকারের দায়িত্ব। তিনি আরও বলেন, সনদকে সাংবিধানিক রূপ দিতে হলে সংসদে যেতে হবে; কিন্তু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে যারা নানা দাবি তুলছে, তারা আসলে ব্যর্থ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করছে।

সনদ বাস্তবায়ন ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়: জামায়াত

জামায়াতে ইসলামী বলছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। অবশ্য আগামী নির্বাচনের আগে সনদ বাস্তবায়ন না হলে আন্দোলনে নামারও ঘোষণা দিয়েছে দলটি। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ গতকাল কালবেলাকে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংস্কার প্রয়োজন এটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরই প্রতিশ্রুতি জাতির কাছে। যে কারণে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নাই। তিনি বলেন, এটা (সনদ) যেভাবে আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারিত হইছে। খসড়ায় সেই জিনিসগুলো কোনো ধরনের গ্যাপ আছে কি না, দেখতে হবে। অনেক সময় প্রিন্টিংয়েরও মিস্টেক (ছাপায়ও ভুল) হয়। ঐকমত্য কমিশনসহ সবাই মিলে কষ্ট পরিশ্রম করছে। অনেক সময় গেছে। এটার জন্য রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যদিয়ে একটি খসড়া তৈরি হইছে। এটা চূড়ান্ত করার পরে আইনি বাধ্য বাধকতার মধ্যে আনা হবে। তারপর বাস্তবায়ন করা হবে। এই ধাপগুলো এখনো অবশিষ্ট। সেগুলো না হলে তো, এটা লিখিত সনদ লাভ নেই। আইনি দলিল না হলে তো লাভ নেই। প্রথমে আইনি দলিল, দ্বিতীয় হচ্ছে এটার বাস্তবায়ন। এই দুটি যদি হয়, তাহলে এই দলিল বা আইনি ভিত্তি রচিত হয়ে জুলাই সনদ যদি কার্যকর হয় এবং তার ভিত্তিতে যদি নির্বাচন হয়, সংস্কারের বিষয়গুলো নিশ্চিত হবে। নির্বাচনও সুষ্ঠু হবে, এটা আমরা আশা করছি। সরকার এটাই করবে আমরা প্রত্যাশা রাখি।

অন্য দলগুলোর অভিমত

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা সাইফুল হক গতকাল কালবেলাকে বলেন, জুলাই সনদের খসড়া আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, অনেক প্রশ্ন আছে, যেগুলো আমরা একমত হয়েছি। যেগুলোর সঙ্গে সংবিধান সংশোধনটা যুক্ত না। সেগুলো তো সরকার অনেক আগেই কার্যকর করতে পারে। আর যেগুলো সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে যুক্ত, তার জন্য তো ইলেক্টেড পার্লামেন্ট লাগবে, ইলেক্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ লাগবে। সেগুলো আমরা সেখানে আলোচনা করব। একটি আলোচনা হচ্ছে যে, এটার একটি আইনি সুরক্ষা কীভাবে দেওয়া যায়। এ বিষয়ে সবাই যদি একমত হয়, তাহলে আমাদেরও সম্মতি থাকবে। আমরা আপত্তি করব না। সব মিছিলে সোমবার (আজ) গণতন্ত্র মঞ্চের বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও দলীয় মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান কালবেলাকে বলেন, আসলে সংকটের মূল জায়গা, নিম্ন কক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি—সেটা খসড়ায় উল্লেখ হয়নি। তবে অন্য সংস্কারগুলো সব ঠিক আছে; কিন্তু এই মূল জায়গাটা (নির্বাচন পদ্ধতি) বাদ গেল, এটা নিয়ে আমাদের অনেক দলের দাবি ছিল। এটাকে আমরা একটা জুলাই সনদের অপূর্ণতা বলব। নির্বাচনে এটা নিয়ে সংকট থেকে যাবে।

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়া আমরা পেয়েছি। আগে যেটি পেয়েছিলাম তার আলোকে আমরা কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলাম, তবে কিছুটা পরিমার্জিত হয়েছে সেজন্য আমরা সন্তুষ্ট। এরপরও আমরা আমাদের চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ ও মতামত সহসা ঐকমত্য কমিশনকে জানাব।

১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম গতকাল কালবেলাকে বলেন, ঐকমত্য কমিশনে আমরা অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য একমত-দ্বিমতটা প্রতিফলিত হয়নি। আমরা এসব ব্যাপার নিয়েও কথা বলব। আজ সোমবার আমরা নিজেরা বসে কথা বলে একটি সিদ্ধান্ত নেব। সেখানে আমরা একমত এবং দ্বিমতের জায়গাটাকে আরও কমিয়ে আনা যায় কি না, সে ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেব। জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, ১২ দলীয় জোট ২১টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ৯টিতে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে; কিন্তু সনদে ৬টি বিষয়ের ১২ দলীয় জোটের নোট অব ডিসেন্টের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা সংস্কার কমিশনের কাছে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাব। এ ছাড়া অঙ্গীকারনামায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের কোনো টাইম ফ্রেম বেঁধে দেওয়া হয়নি এবং সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি নিয়ে আমাদের মতামত কমিশনকে ২০ তারিখের মধ্যে জানাব।

এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি—এনসিপি বলছে, জুলাই অভ্যুত্থানে এত প্রাণহানির পর সংস্কার প্রস্তাবনা নিয়ে যে সনদ তৈরি হচ্ছে, সেটি যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এর বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হতে পারে। এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন কালবেলাকে বলেন, জুলাই সনদকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে আইনি ভিত্তি দিতে হবে। গণপরিষদ নির্বাচনই আমাদের সমাধান। জুলাই সনদকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আইনি ভিত্তি না দিয়ে কোনো বাধা সৃষ্টি করলে কঠোর আন্দোলনে নামার ঘোষণাও দিয়েছে এনসিপি।

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হবে মাইলফলক: বিশ্লেষক

জুলাই সনদের সমন্বিত খসড়া প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামছুল আলম সেলিম গতকাল রোববার কালবেলাকে বলেন, জুলাই সনদের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলগুলো একমত; কিন্তু এটা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে দু-চারটি দলের মধ্যে মতবিরোধ থাকতে পারে। তারপরও আমি মনে করি যে, এটাকে সামনে রেখে সব রাজনৈতিক দলেই যেন ঐকমত্য পোষণ করে। তা নাহলে ফ্যাসিবাদী শক্তি ফিরে আসার সুযোগ পাবে। আর বিএনপি তো বড় দল, তাদেরও এই ব্যাপারগুলো নিয়ে আরও যত নমনীয় হওয়া যায়, তত ভালো। তাদের আরও ছাড় দেওয়া দরকার। যদি লাগে ছাড় দিতে, ছাড় দিয়ে সমন্বিতভাবে যদি আমরা এগিয়ে যাই, তাহলে এটা একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। আগামীদিনে কোনো শক্তি জনগণের বিরুদ্ধে আর কাজ করতে পারবে না।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মো. সাহাবুল হক গতকাল কালবেলাকে বলেন, জুলাই সনদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। দীর্ঘ ১৭ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ছাত্র গণঅভ্যুত্থান শুধু একটি আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; এটি একটি বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক রূপান্তরের দলিল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই সনদটি ৬টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি সুপারিশের ভিত্তিতে গঠিত হওয়ায় একে বলা যায় জনগণের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা, সংগ্রাম এবং রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। যে কোনো নথি বা প্রতিশ্রুতির মতো এর প্রকৃত শক্তি নির্ভর করছে বাস্তবায়নের ওপর, এবং এটাই বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অতীত রাজনৈতিক ইতিহাসে দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার পর নানা অঙ্গীকারকে উপেক্ষা করেছে, কিংবা রাজনৈতিক সুবিধাবাদে সেগুলোকে ভুলে গেছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একই ধারা পুনরাবৃত্তি হলে জনগণের মধ্যে হতাশা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে। তাই এই সনদকে শুধু রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির পর্যায়ে না রেখে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা অপরিহার্য।

তিনি আরও বলেন, সনদের ইতিবাচক দিক হলো—এখনো কোনো রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে সনদের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলেনি। এখানেই একটি ঐকমত্যের ভিত্তি তৈরি হয়েছে। তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তিনটি ধাপকে জরুরি হিসেবে দেখা যেতে পারে: প্রথমত, সনদের মূল দিকগুলোকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে ভাগ করে একটি সময়সূচি তৈরি করতে হবে। কোন সুপারিশ তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করা সম্ভব, আর কোনগুলো দীর্ঘমেয়াদে প্রয়োজন, তা নির্ধারণ জরুরি। দ্বিতীয়ত, একটি স্বতন্ত্র বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করতে হবে, যেখানে শুধু রাজনৈতিক দল নয়, নাগরিক সমাজ, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, এবং আইন বিশেষজ্ঞরা থাকবেন। এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে। তৃতীয়ত, জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। কারণ জনগণের চাপই রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের প্রতিশ্রুতির প্রতি দৃঢ় রাখবে।

সবমিলিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হবে বাংলাদেশের জন্য একটি যুগান্তকারী রাজনৈতিক মাইলফলক, যদি এটিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সুবিধাবাদী সমঝোতার বাইরে নিয়ে গিয়ে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ করা যায়। অন্যথায় এটি কেবল ইতিহাসের আরেকটি ব্যর্থ দলিলে পরিণত হবে। তাই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রা আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর দায়িত্ব পড়েছে—কথায় নয়, কাজে দেখানোর।